চলতি বছর পোল্ট্রি ব্রিডার শিল্পে ক্ষতি ৭৫০ কোটি টাকা
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:০৩
চলতি বছরে পোল্ট্রি ব্রিডার শিল্পে ৭৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি)।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর বসুন্ধরায় সংগঠনের কার্যালয়ে বিএবি-এর বার্ষিক সাধারণ সভায় তথ্য জানানো হয়।
এ সভায় সরকার নজর না দিলে ডিম, মুরগি ও ফিডের উৎপাদনে ধ্স নামতে পারে বলে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। এছাড়াও সভায় ব্রিডার শিল্পসহ সামগ্রিকভাবে পোল্ট্রি ও ফিড শিল্প রক্ষায় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।
সভায় ২০২৪ সালকে ব্রিডার্স শিল্পের জন্য দুঃসময় বলে মন্তব্য করেন এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চা (ডিওসি) উৎপাদনকারীদের সংগঠন বিএবি-এর সভাপতি মাহাবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রান্ড প্যারেন্টস্টক (জিপি) ও প্যারেন্টস্টক (পিএস) বাচ্চার দর বৃদ্ধি, ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, কোটাবিরোধী ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, কারফিউ, অপ্রত্যাশিত বন্যা, অতিবৃষ্টি, হিট-ওয়েভ, রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সরকারের ডিম আমদানির সিদ্ধান্তসহ নানান কারণে পোল্ট্রি ব্রিডার্স শিল্পের জন্য চলতি বছর ছিল একটি ক্ষতির বছর।’
তিনি আরো বলেন, ‘এ বছর অনেক ছোট-মাঝারি এমনকি বড় ব্রিডার ও বাণিজ্যিক খামারও বন্ধ কিংবা বিক্রি হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বড় অংকের দেনার মুখে পড়েছে। কখনো উৎপাদন কমেছে আবার কখনো অতিরিক্ত উৎপাদন হয়েছে। আর এ অস্থিরতায় ব্রিডার খামার ও হ্যাচারি প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান করলেও সুযোগ সন্ধানি মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ঠিকই মুনাফা করেছেন। মূলত, মধ্যস্বত্ত্বভোগী এ শ্রেণিটিই তাদের মুনাফা-সহায়ক পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখতে গণমাধ্যমের কাছে মনগড়া তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে উৎপাদনকারীদের ভিলেন হিসেবে চিত্রায়িত করেছে এবং তা এখনো অব্যাহত রয়েছে।’
বিএবি সভাপতি বলেন, ‘উৎপাদনকারীদের শত্রু বানিয়ে কিংবা ক্ষতি করে উৎপাদন, অর্থনীতি কিংবা উন্নয়ন কোনোটাই বেগবান করা সম্ভব নয়। উৎপাদনশীল খাত বড় হলেই বিনিয়োগ বাড়বে, উদ্যোক্তা বাড়বে, দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে।’
তিনি বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ব্রিডার্স শিল্পে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। এ লোকসান সমন্বয়ের সুযোগ দিতে হবে, শিগগিরই সম্ভব নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্য পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে, প্রয়োজনে আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।’
বিএবি-এর সাধারণ সম্পাদক শাহ্ ফাহাদ হাবীব বলেন, ‘অংশীজনদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চার যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে, এমনকি চাহিদা ও সরবরাহের মাঝে ভারসাম্য রক্ষায় একটি কৌশলপত্রও প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু তারপরও সরকার নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্য ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘যেই দিন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় সেই দিনই তা হ্যাচারি থেকে বিক্রি করে দিতে হয়। এটি এমন একটি প্রোডাক্ট যা কোনোভাবেই সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিরই সুযোগ নেয় পাইকারি ক্রেতারা। তারা সারা দিন বাচ্চা না কিনে বিকেল-সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখে যেন হ্যাচারিরা কম দামে বাচ্চা বিক্রি করতে বাধ্য হন।’
তিনি আরো বলেন, ‘মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারীরা পাইকারি ক্রেতাদের হাতে আটকে পড়েছেন। এ অবস্থা থেকে মুক্তি না মিললে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
বিএবি-এর সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘মার্চ ও এপ্রিল এবং অক্টোবর ও নভেম্বর এ চার মাসে সামান্য কিছু লাভ হলেও বছরের বেশিভাগ সময় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে বাচ্চা বিক্রি করতে হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এক দিন বয়সী ব্রয়লার বাচ্চার সর্বোচ্চ যৌক্তিক মূল্য ৫৩ টাকা নির্ধারণ করেছিল। অতিরিক্ত উৎপাদন খরচ এবং লোকসান সমন্বয় করতে মূল্য সংশোধনের জন্য একাধিকবার সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হলেও আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। চলতি বছর ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রি হয়েছে গড়ে প্রায় ৪৫ টাকায় যেখানে সরকারের অনুমোদিত মূল্য ৫৩ টাকা। কোনো কোনো মাসে লক্ষ্যণীয়ভাবে দরপতন ঘটেছে যেমন জুলাই ও আগষ্ট মাসে সর্বনিম্ন দাম ছিল ২৫ টাকা, মে মাসে ৩০ টাকা, জুনে ৩২ টাকা, সেপ্টেম্বরে ৩৮ টাকা এবং ডিসেম্বরে ৩৮ টাকা।’
প্রভিটা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুন নবী ভূঁইয়া বলেন, ‘ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের সুদের হার, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ডলারের দাম আরো একধাপ বেড়েছে কিন্তু মুরগির বাচ্চার দর বাড়ছে না বরং কমছে। আজকে অর্ডার দিলে ন্যূনতম ৪৫ দিনের আগে পিএস বাচ্চা পাওয়ার আশা করা যায় না। আর বিদেশ থেকে পিএস বাচ্চা পেতে হলে ন্যূনতম ১২০ দিন আগে বুকিং দিতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘ঋণপত্র (এলসি) খুলে বাচ্চা আমদানি করে উৎপাদন খরচ যা পড়ছে, ডিওসি বিক্রি করে সেই খরচ তোলা যাচ্ছে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘পাইকারি বিক্রেতারা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এমআরপি-এর চেয়েও অধিক মুল্যে বাচ্চা বিক্রি করেছেন অথচ এজন্য ব্রিডার ফার্মগুলোকে দোষী করা হয়েছে কিন্তু অন্যায্য মুনাফা লুটেছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। এদের দৌরাত্ম্য কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।’
নুরুন নবী বলেন, ‘ব্রিডার কোম্পানিগুলো সাধারণ খামারিদের কথা ভেবেই নূন্যতম দামে ডিওসি বিক্রি করছে। তারা যদি এমআরপি-এর অতিরিক্ত দামে বাচ্চা না কিনত তবে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা অতিরিক্ত মুনাফা করতে পারত না।’
তিনি বলেন, ‘উৎপাদনকারীরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, ব্যাংকের ঋণে জর্জরিত হচ্ছে কিন্তু মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ঠিকই দিন দিন ফুলে ফেঁপে বড় হচ্ছে কারণ তাদের তো কোনো ঝুঁকি নেই।’
নারিশ পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারির পরিচালক শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ‘ব্যাংকের সুদের হার ১৪ শতাংশ অথচ মুরগির বাচ্চার যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের সময় নাম মাত্র মুনাফার হার ধরা হয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদফতর ডিমের যে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে সেখানে উৎপাদক পর্যায়ে মুনাফার হার ধরা হয়েছে মাত্র তিন দশমিক ৮০ শতাংশ, প্রতি কেজি সোনালী মুরগি উৎপাদনে চার শতাংশ এবং ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে মাত্র পাঁচ শতাংশ। দেশে এমন একটি খাতও নেই যেখানে ১৫ শতাংশের কম লাভ অনুমোদন করা হয়েছে। তাই সবচেয়ে সংবেদনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ খাত পোল্ট্রি ও ব্রিডার্স ইন্ডাষ্ট্রি-এর জন্য নির্ধারিত মুনাফার হার পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন।’
নাহার এগ্রো-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: রকিবুর রহমান টুটুল বলেন, ‘আমাদেরকে যেকোনো মূল্যে বাজার স্থিতিশীল রাখতে হবে। যে সিজনে যতটুকু চাহিদা, সে অনুযায়ীই উৎপাদন করতে হবে।’
বিএবি নেতারা বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উদ্যোগে যে কৌশলপত্রটি প্রণয়ন করা হয়েছে তা প্রতি তিন মাস পর পর পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে, সরকার নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্য উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে, সরকার যেহেতু সর্বোচ্চ যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছেন সেহেতু উৎপাদনকারী ব্রিডার ফার্মগুলো যেন সে দামে বাচ্চা বিক্রি করতে পারেন সেটি নিশ্চিতেও সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে, ঝুঁকি বিবেচনায় পোল্ট্রি ও ব্রিডার্স শিল্পের জন্য সুদের হার ন্যূনতম করতে হবে, সর্বোপরি প্রান্তিক খামারিরা যেন ডিম ও মুরগির নায্য দাম পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’
তারা বলেন, ‘পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের জন্য একটি মহল সুপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করছে। প্রান্তিক খামারিদের নাম ভাঙ্গিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। ১ জানুয়ারি থেকে ডিম ও মুরগির উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার নতুন এক চক্রান্তে মাঠে নেমেছে। এদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নিলে তারা দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংস করবে এবং দেশের বাজারকে অপশক্তির হাতে তুলে দিতে সফল হবে।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা