কালীগঞ্জে প্রাণের শিল্পপার্ক : সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে আটা-ময়দার উৎপাদন শুরু
- হামিদ সরকার, কালিগঞ্জ (গাজীপুর) থেকে ফিরে
- ১২ নভেম্বর ২০২৪, ২০:০৮
শীতলক্ষ্যা নদীর কোলঘেঁষে গাজীপুরের কালিগঞ্জে স্থাপিত হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের আট, ময়দা ও সুজি উৎপাদনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের শিল্প প্রতিষ্ঠান। ১৮০ বিঘা জমিতে ৭১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয়েছে এই কারখানা। আটা-ময়দা ছাড়াও প্রাণের এ শিল্পপার্কে ভোজ্যতেল, লবণ, ডাল, মসলা, বেভারেজ, নুডলস, বিস্কুট, কনফেকশনারি, পোল্ট্রি ফিড ও ফ্লেক্সিবল প্যাকেজিংসহ বেশ কয়েকটি পণ্য উৎপাদিত হবে।
‘কালীগঞ্জ এগ্রো প্রসেসিং লিমিটেড’ নামের এ শিল্পপার্ক স্থাপনে প্রাথমিকভাবে দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে প্রাণ-আরএফএল। তবে শিল্পপার্কটি পুরোপুরি চালু হলে সেখানে তিন হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। বর্তমানে প্রায় ৯০০ লোক কাজ করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা জানান, শুধু ফ্লাওয়ার মিলের মেশিনারি ও অন্য বিল্ডিং নির্মাণে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১১০ কোটি টাকা। শিগগিরই উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করা হবে।
সম্প্রতি একদল গণমাধ্যমকর্মী শিল্পপার্কটি সরেজমিনে পরির্দশন করেন। সেখানে দেখা যায়, কালীগঞ্জে প্রাণের শিল্পপার্কে আটা-ময়দা ছাড়াও ডাল, প্রাণিখাদ্য ও প্যাকেজিংসহ কয়েকটি কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি কারখানার যন্ত্রপাতি বসানো হচ্ছে। বাকি কারখানাগুলো নির্মাণাধীন। আগামী দুই বছরের মধ্যে সব কারখানা উৎপাদনে যাবে বলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা জানান।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ কিছু কারণে আড়াই বছর ধরে দেশীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো চাপে রয়েছে। তাদের দাবি, যে পরিমাণে ব্যয় বেড়েছে, সে তুলনায় তারা পণ্যের দাম বাড়াতে পারছে না। এ রকম অবস্থায় এ খাতে নতুন বিনিয়োগে এসেছে প্রাণ।
পরিদর্শনকালে দেয়া এক উপস্থাপনায় গ্রুপটির দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, শিল্পপার্কটিতে প্রায় ২১ বিঘা জায়গায় ১০ তলার সমান উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় ফ্লাওয়ার মিল বা আটা-ময়দা ও সুজির কারখানা। কারখানার সব যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি আনা হয়েছে ইউরোপ থেকে। পণ্যের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক পরীক্ষাগার। কারখানা নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপনে এ পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১১০ কোটি টাকা।
প্রাণ গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, কাঁচামাল সংরক্ষণের জন্য এই শিল্পপার্কে বর্তমানে ১০ হাজার টন সক্ষমতার ছয়টি ও এক হাজার টন সক্ষমতার তিনটি সাইলো (শস্যাগার) রয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরো ছয়টি সাইলো তৈরি করা হবে। আমদানি করা গম লাইটার জাহাজ থেকে সরাসরি সাইলোতে নেয়া হয়। সেখান থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গম চলে যায় প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রে। এরপর কয়েকটি ধাপে গম থেকে ময়লা আলাদা করে পরিষ্কার গম চূর্ণ করা হয়। এরপর উৎপাদিত আটা, ময়দা ও সুজি সরাসরি মোড়কজাত করে পাঠানো হয় বাজারে তথা ভোক্তার কাছে।
শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, কারখানাটিতে দৈনিক ৫০০ টন আটা, ময়দা ও সুজি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে শিগগিরই উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। উৎপাদিত এসব পণ্য ‘প্রাণ’ ব্র্যান্ডের নামেই বাজারজাত করা হচ্ছে। এখন ৫০ কেজির বস্তায় করে নিজস্ব সরবরাহকারীর মাধ্যমে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আটা-ময়দা পৌঁছানো হয়। পরীক্ষামূলকভাবে এক কেজি ও দুই কেজির প্যাকেট বাজারে ছাড়া হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক নাসের আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, তারা রাশিয়া, ইউক্রেন, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি করে আটা-ময়দা উৎপাদন করছেন। কারণ, এসব অঞ্চলের গমে প্রোটিনের মাত্রা ভালো থাকে। তবে স্থানীয়ভাবেও দেশের কয়েকটি জেলা থেকে ভালো মানের গম সংগ্রহ করা হবে। এ ছাড়া প্রাণ জমি ইজারা নিয়ে ভালো প্রোটিন পাওয়া যায় এমন জাতের গম উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। এ জন্য দেশের উত্তরাঞ্চলে ৬০০ একর জমি ইজারা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সাইলো থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গম চলে যায় মেশিনে। এরপর সেপারেটর মেশিনের মাধ্যমে গম থেকে বালিসহ অন্যান্য ময়লা আলাদা করা হয়। পরে স্টোন সেপারেটর মেশিনের মাধ্যমে পাথর আলাদা করার পর কোকো সিলিন্ডার মেশিনের মাধ্যমে ভাঙ্গা ও অপরিপক্ক গম আলাদা করা হয়। এরপরও কয়েকটি ধাপে ক্লিনিং ও ম্যাগনেট সেপারেটর মেশিন হয়ে সম্পূর্ণ ফ্রেশ গম পাওয়ার পর ক্র্যাশিং কার্যক্রম শুরু হয়। ক্র্যাশিং পর্যায়ে কয়েকটি ধাপ পার হয়ে আটা-ময়দা তৈরি হওয়ার পর প্যাকেটজাত করা হয়। গমের পুষ্টি পরিমাণের জন্য কারখানায় রয়েছে অত্যাধুনিক ল্যাব যার মাধ্যমে গমের গুনগতমান পর্যবেক্ষণ করা হয়।
অন্য কর্তাব্যক্তিরা বলেন, দেশে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী বিভিন্ন কারখানায় বছরে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। যার বেশির ভাগই আমদানিনির্ভর। উৎপাদিত আটা-ময়দার প্রায় ৭৫ শতাংশ ব্যবহার হয় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও হোটেলে, বাকিটা ভোক্তারা বাসাবাড়িতে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহার করেন। সব মিলিয়ে দেশে আটা, ময়দা ও সুজির বাজার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার। প্রতিবছর এ বাজার ৮-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, বর্তমানে আমরা যেসব ভোগ্যপণ্য তৈরি করছি, যার মূল কাঁচামাল আটা-ময়দা। এ কারণে প্রথম দিকে পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) হিসেবে কালীগঞ্জে আটা-ময়দার কারখানা করতে চেয়েছি। তবে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে আটা-ময়দার চাহিদাও ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে। আবার বিস্কুট, বেকারি, নুডলস ও ফ্রোজেন ফুডসের বাজারও দিন দিন বড় হচ্ছে। এসব কারণে কারখানা বড় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তিনি বলেন, আমরা দেশে ভোগ্যপণ্যের বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভালো অবস্থান তৈরি করতে চাই। এর মাধ্যমে ভোক্তারা ভালো মানের পণ্য পাবেন বলে আশা করছি।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এই শিল্পপার্কে ফিডমিল চালু রয়েছে। যা প্রোটিন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখছে। আমরা ভোগ্যপণ্যের বাজারে ভালো অবস্থান তৈরি করতে চাই। এজন্য সিড ক্র্যাশিং, ভোজ্যতেল, লবণসহ বেশ কয়েকটি পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কারখানায় কাজ চলমান। আশা করছি আগামী দুই বছরের মধ্যে ভোক্তারা প্রাণ-এর বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য হাতে পাবেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা