২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

দুর্বল ব্যাংকে রাখা আমানতকারীদের টাকা কতটা ঝুঁকিতে

- ছবি : বিবিসি

গত মঙ্গলবার ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের রিং রোড ব্রাঞ্চে বেতনের টাকা তুলতে যান মার্জিয়া প্রভা। কিন্তু ব্রাঞ্চের ডেস্ক থেকে তাকে জানানো হয় যে একদিনে পাঁচ হাজারের বেশি টাকা তোলা যাবে না।

এ নিয়ে ব্রাঞ্চের ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে তার রুমে যান মিজ প্রভা। তিনি বলেন, ‘আমি গিয়ে দেখি ওখানে আট-দশ জনের মতো মানুষ বসে আছে। ম্যানেজার জানান, আপা, আমি পাঁচ হাজারের চেয়ে একটা টাকাও বেশি দিতে পারবো না। দেখেন, আরো মানুষ বসে আছে।’

অনেকটা একই অবস্থা একটি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নারীর।

একই ব্যাংকে তার ১৬ লাখ টাকার একটি এফডিআর করা ছিল। অগাস্টের ২৭ তারিখ নিজস্ব প্রয়োজনে গুলশান ব্রাঞ্চ থেকে এফডিআর ভেঙ্গে ১০ লাখের মতো টাকা অন্য একটি অ্যাকাউন্টে পাঠানোর আবেদন করলে ব্যাংক থেকে তাকে একটি পে-অর্ডার দেয়া হয়।

কিন্তু পরপর তিনবার সেই পে-অর্ডারটি বাউন্স করে। ভুক্তভোগী জানান, এই বিষয়ে ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আপা, আপনার কাছে তো লুকানোর কিছু নেই। আপনি তো পেপারে পড়ছেনই ব্যাংকের কী অবস্থা। তারপরও আমি চেষ্টা করছি, দেখি আপনাকে কতটুকু হেল্প করতে পারি।পরের সপ্তাহে চারদিন ব্যাংকে যাওয়ার পর ম্যানেজার তাকে এক লাখ টাকা ক্যাশ করে দেন।

পরের সপ্তাহেও তিন থেকে চারদিন ব্রাঞ্চে যান বলে বিবিসিকে জানান তিনি। কিন্তু সেসময় কোনো টাকা তুলতে পারেননি। তিনি বলেন, পরের সপ্তাহে তিনি আবার আমাকে এক লাখ আরটিজিএস করে দিলো। তো এই একমাসে আমি সর্বসাকুল্যে দুই লাখ টাকা তুলতে পারছি।’

কেবল এই দুই গ্রাহকই নয়, টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যায় পড়ার অভিযোগ আসছে আরো কয়েকটি ব্যাংকের গ্রাহকের কাছ থেকে।

রিং রোডের ঘটনা নিয়ে ব্রাঞ্চটির ম্যানেজার সালেহ আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তো আসলে রেগুলারই একটু সমস্যা হচ্ছে। আমরা মনে হয় একটু লিকুইডিটি ক্রাইসিসের মধ্যে আছি, আপনারা জানেন। যে পরিমাণ ক্যাশ আমার কাছে আসছে, তা দিয়ে এত বেশি অ্যাকাউন্টের জন্য পর্যাপ্ত সাপোর্ট আসলে দিতে পারছি না।’

হেড অফিস থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ না পাওয়ায় গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী পেমেন্ট দেয়া যাচ্ছে না বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

ব্রাঞ্চের জন্য বরাদ্দ টাকার ওপর নির্ভর করে প্রতিদিন গ্রাহকদের সর্বোচ্চ কত টাকা দেবেন তা নির্ধারণ করা হয় বলেও জানান তিনি।

মিজ প্রভা বলছেন, ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর থেকেই ব্যাংকটি থেকে টাকা তোলার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি। এরই মধ্যে অচল হয়ে পড়েছে ব্যাংকটির অনলাইন ব্যাংকিং।

এছাড়াও আগে একদিনে অ্যাকাউন্ট থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা তুলতে পারলেও পরে ১০ হাজার এবং সবশেষ পাঁচ হাজার টাকা তুলতে পারছে বলে জানান এই গ্রাহক।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নতুন বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান অবশ্য মনে করেন, এ সমস্যা সাময়িক, শিগগিরই কেটে যাবে।

বিবিসি বাংলাকে মান্নান বলেন, ‘বেশ কিছু ব্যাংকে রেশনিংয়ের মতো অবস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’

ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট
এর আগে ১১ আগস্ট ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আগের দিন রাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাঠানো এক জরুরি বার্তায় এই নির্দেশনা দেয়া হয়। পরে ৭ সেপ্টেম্বর থেকে নগদ টাকা উত্তোলনের সীমা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও তারল্য সঙ্কটে ভুগছে কিছু ব্যাংক।

সর্বশেষ ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে পরিচালিত বেসরকারি খাতের নয়টি ব্যাংকের চলতি হিসেব প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোতে এই ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৬৭ টাকা।

এসব ব্যাংকের মধ্যে ছিল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, ন্যাশনাল, ইউনিয়ন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কমার্স, পদ্মা, এক্সিম ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। সঙ্কটে পড়া এসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার তারল্য-সহায়তা চেয়েছে।

এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ৫ হাজার কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭ হাজার ৯০০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক সাড়ে ৩ হাজার কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৫ হাজার কোটি ও এক্সিম ব্যাংক ৪ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে।

ব্যাংক খাতের দুর্নীতি নিয়ে লম্বা সময় ধরেই ছিল আলোচনা।

এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে ব্যাংকগুলোতে দুর্নীতির ফলে তারল্য সঙ্কট তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে দুর্নীতির খবর প্রকাশ হবার পর আস্থা হারিয়ে এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে শুরু করেছে গ্রাহকরা। ফলে তারল্য সঙ্কটের মুখোমুখি হয় এসব ব্যাংক।

দুই কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নতুন বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, ‘কিছু সংখ্যক গ্রাহকের হাতে দেশের সম্পদের বড় অংশ পুঞ্জীভূত হয়েছে। সারাদেশে কেবল ডিপোজিটরের সঙ্কট তৈরি হয়নি, বিনিয়োগেরও সঙ্কট তৈরি হয়েছে।’

‘ডিপোজিটররা ব্যাংকের প্রকৃত মালিক। ৯০ শতাংশ টাকা তাদের। সেই মালিকদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। ১০ শতাংশ শেয়ার হোল্ডিং যাদের তারা নিজেদের মালিক হিসেবে দাবি করেছেন বা মালিক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। পরিচয় দিয়ে এই ব্যাংকগুলো কুক্ষিগত করে এক ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ঘটে গেছে ব্যাংকিং সেক্টরে।’

তারল্য সঙ্কটে পড়ে সরকারের কাছে সহায়তা চাওয়া ব্যাংকগুলোর একটি ন্যাশনাল ব্যাংক।

ব্যাংকটির পরিচালক আবদুল আউয়াল মিন্টু বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘গত ১০ বছরে বাংলাদেশের অনেকগুলো ব্যাংক থেকে অনিয়ম করে অনেকগুলো লোন দেয়া হয়েছে, যেগুলো ফেরত আসছে না। অনেকে টাকা পাচার করে ফেলেছে। তারা দেশেও নাই।’

এছাড়াও পত্র-পত্রিকায় সবল-দুর্বল ব্যাংক নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হওয়ার প্রভাবও পড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘এসব খবরের কারণে যারা টাকা রাখে তাদের আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এই আস্থার সঙ্কট যতদিন থাকবে, ততদিনই এই সঙ্কট থাকবে।’

তবে ‘ব্যাংক টাকা দিতে পারবে না কিংবা বন্ধ হয়ে যাবে- কোনো ব্যাংকই এখনো এমন অবস্থায় পৌঁছায়নি’ বলে মনে করেন ব্যাংকটির পরিচালক মন্টু।

‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে বলে বলেন তিনি।

ব্যাংকগুলোর নতুন বোর্ড অনেক শক্তিশালী দাবি করে মান্নানও বলছেন, এই ব্যাংকগুলোতে ডিপোজিটরদের টাকা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে নেই। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে কখনো ব্যাংকিং ডিপোজিটররা সেই ধরনের ঝুঁকিতে পড়েননি।

যা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক
এক বছর সময় দিলে এই ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তবে গ্রাহকরা অপ্রয়োজনে টাকা উত্তোলন করতে গেলে সমস্যা বাড়বে বলে মত তার।

২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে এক গোলটেবিল বৈঠকে একথা বলেন মনসুর।

এদিকে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর তারল্য ঘাটতি মেটাতে নতুন উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অতিরিক্ত তারল্য আছে এমন ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ নিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আর এতে মধ্যস্থতা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘টাকা ছাপিয়ে কাউকে দেয়া হবে না। ফলে যে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত অর্থ আছে, তাদের থেকে নিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেয়া হবে।’

এর মাধ্যমে বাজারে থাকা টাকা দিয়েই সমস্যার সমাধান করা হবে বলে জানান তিনি।

এর আগে আর্থিক অনিয়মে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে রাজি হয় ১০টি ব্যাংক। এগুলো হলো- ব্র্যাক, ইস্টার্ণ, দি সিটি, শাহ্‌জালাল ইসলামী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, সোনালী, পূবালী, ঢাকা, ডাচ্‌–বাংলা ও ব্যাংক এশিয়া।

মিজ শিখা বলেন, ‘দুর্বল আর সবল ব্যাংকগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে যে ঋণ দেয়া হচ্ছে তা যদি তারা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই টাকা দেবে।’

অর্থাৎ ধার দেয়া টাকার গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এছাড়াও কোন ব্যাংক কত টাকা পাবে তা নির্ধারণ করে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ঋণের সুদহার কত হবে দুই ব্যাংকের সমঝোতায় সেটি নির্ধারিত হবে।

এরইমধ্যে তারল্য–সহায়তা পেতে ন্যাশনাল, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী- এই পাঁচটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে চুক্তি করেছে।

তাহলে কি দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকার নিশ্চয়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক? – এমন প্রশ্নের জবাবে মিজ শিখা জানান, একসাথে সবাই টাকা তুললে তারল্য সঙ্কট কাটবে না।

সবাই যদি ধৈর্য ধরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় টাকা লেনদেন করে তবে সমস্যার সমাধান হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
তুলে নিয়ে বেঁধে মারধর, মৃত ভেবে দুই ছাত্রদল নেতাকে ফেলে গেল দুর্বৃত্তরা সাকিবের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে না বিসিবি সার্চ কমিটি থেকে বুলবুলকে অব্যহতি শান্তির জন্য জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দুই বন্দর দিয়ে ৬১ টন ইলিশ গেল ভারতে রাষ্ট্র সংস্কার করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সময়ের দাবি: সৈয়দ ফয়জুল করীম মোদির সাথে ট্রাম্পের সাক্ষাৎ কেন হলো না মিত্রদের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, লেবাননে সর্বশক্তি দিয়ে হামলার নির্দেশ নেতানিয়াহুর গোলাপগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ হাবিপ্রবি থেকেই দ্রুত ভিসি নিয়োগের দাবিতে আবারো মানববন্ধন দুর্বল ব্যাংকে রাখা আমানতকারীদের টাকা কতটা ঝুঁকিতে

সকল