নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিনে
- সেতারা কবির সেতু
- ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৩:১২
'আমি কবি, সেই কবি-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি
ঝরাপালকের ছবি’
আজ নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশের ১২৩তম জন্মদিন। রূপসী বাংলার কবি ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার মা কবি কুসুম কুমারী দাশ ও বাবার নাম সত্যানন্দ দাশ। তার মা কুসুম কুমারী দাশ কবি। জীবনানন্দ ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর ৫৫ বছর বয়সে কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যান।
জীবনানন্দ বরিশাল ব্রজমোহন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯১৫), বি এম কলেজ থেকে আইএ (১৯১৭) এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ (১৯১৯) ও ইংরেজিতে এম.এ (১৯২১) পাস করেন। আইন কলেজে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি পরীক্ষা দেননি।
জীবনানন্দ কলকাতা সিটি কলেজে ১৯২২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে যোগ দেন, কিন্তু কিছু দিন পর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। ওই বছরই (১৯২৯) তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে যোগ দেন, ১৯৩০-এ আবার দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে কিছুকাল বেকার থেকে জীবনানন্দ ১৯৩৫ সালে বরিশালের বিএম কলেজে যোগদান করেন। এভাবে তাঁর কর্মজীবন বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনায় এবং মাঝে মাঝে অন্য পেশায় অতিবাহিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের কিছু আগে তিনি সপরিবারে কলকাতা চলে যান।
জীবনানন্দ দাশ একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, গীতিকার। স্কুলজীবনেই কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখি শুরু করেন।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), রূপসী বাংলা (রচনাকাল ১৯৩৪, প্রকাশকাল ১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)। এছাড়াও বহু অগ্রন্থিত কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
দুঃখের বিষয় জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকাকালীন তার লেখাগুলো সমাদৃত হয়নি। কবি তার রচিত কবিতাগুলো নিয়ে বারবার পত্রিকা অফিসে গিয়েছেন। প্রকাশকদের বলেছেন তার কবিতাগুলো প্রকাশ করার জন্য। প্রত্যেক জায়গাতেই কবি নিরাশ হয়েছেন। কাউকে কিছু বলতে পারেননি। এক বুক কষ্ট নিয়ে কবি ফিরে এসেছেন। কবির দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। অর্থ কষ্টে ছিলেন কবি। স্ত্রীর কাছে ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন। কিন্তু পেয়েছেন শুধু অবহেলা আর অপমান। তাইতো কবি আবার আসিব ফিরে কবিতায় জীবনের অব্যক্ত কষ্টগুলো প্রকাশ করেছেন এভাবে-
আবার আসিব ফিরে
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।
জীবনানন্দ দাশ পৃথিবীর দিকে তাকিয়েছিলেন বিপন্ন বিস্ময়ে। জানিয়ে দিয়েছেন জ্যোৎস্নায় ঘাইহরিণীর ডাকে ছুটে আাসা, শিকারির গুলিতে নিহত হরিণের মতো আমরা সবাই। হাজার, হাজার পৃষ্ঠা লিখেছেন, প্রকশ করেছেন সামান্য অংশ। বাকিটা তালাবন্দী করে রেখেছেন ট্রাঙ্কে। এই হলো বিপন্ন মানবতার নীলকন্ঠ জীবনানন্দ দাশ।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট