সিলেটের আকস্মিক বন্যার কারণ কী এবং পানি নামবে কবে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০১ জুন ২০২৪, ১৮:০৮
সিলেটে যে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা পুরোপুরি কাটতে এক সপ্তাহের মতো সময় লাগতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
গত কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট জেলার সাত উপজেলায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমে আসায় নতুন করে পাহাড়ি ঢল আসছে না। যদি আবারো অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হয়, তাহলে সিলেটের বন্যা কবলিত স্থানগুলোর পানি নামতে থাকবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ‘আরো তিন দিন ধরে যদি বৃষ্টিপাত কমে আসার ধারাবাহিকতা থাকে, তাহলে আশা করা যায়, আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মাঝে সিলেটের পানিগুলো নিম্নাঞ্চলে নেমে যাবে।’
তিনি বলেন, এই বন্যার মূল কারণ চেরাপুঞ্জির টানা বৃষ্টি। তবে গত তিন দিন ধরে সিলেটের ও ভারতের চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিপাতের হার কমে আসছে।
সিলেট জেলা প্রশাসন বলছে, আকস্মিক বন্যার কারণে কয়েক হাজার বানভাসি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, বন্যার শুরুতে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এখন তারা ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।
তবে তারপরও বর্তমানে জেলার মোট ৫৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে তিন হাজার ৩৪২ জন আছেন।
এমনিতে এই বন্যায় প্রায় ছয় লাখ ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে বলে জানায় জেলা প্রশাসন।
‘সিলেটের পরিস্থিতি এখন ভালো’
২৯ মে রাতে উজানের ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। তবে ৩০ মে সকাল থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসায় নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে।
পাউবোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সুরমা নদীর কানাইঘাট ও সিলেট স্টেশন এবং কুশিয়ারা নদীর আমালশিদ ও শেউলা স্টেশনের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, ‘বৃষ্টিপাত না হলে এটাও দ্রুত চলে যাবে। বন্যার শুরুতে প্রত্যেকটা নদীর পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছিল। এখন বেশিভাগ পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে এসেছে। শুধু সুরমাও কুশিয়ারার যে চারটি পয়েন্ট থেকে পানি বের হচ্ছে, সেখানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি বইছে। তবে সেটাও খুব বেশি না। এক-দুই ইঞ্চি বা হাফ ইঞ্চি।’
বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সিলেটের স্থানীয় সাংবাদিক মঞ্জুর আহমেদ জানান, সিলেটে এখন বৃষ্টি হচ্ছে না। সেখানের আকাশে এখন ঝকঝকে রোদ।
তিনি বলেন, ‘কালকে সিলেটে বৃষ্টি হয়নি। আজকেও হালকা থেমে বৃষ্টি হয়েছে। সবমিলিয়ে ধীরে ধীরে পানি নামছে। আর ওদিকেও (চেরাপুঞ্জিতে) যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে না, তাই নতুন করে আবার পাহাড়ি ঢল নামার এবং পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই এখন।’
সিলেট জেলার আরেকজন সাংবাদিক আজহার উদ্দিন শিমুলও জানান যে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, ‘আকাশে রোদ আছে, বৃষ্টি নেই। রাস্তাঘাটের পানি নেমে যাচ্ছে, মানুষ বাড়ি ফিরছে।’
তবে যেসব বানভাসি মানুষ এখনো বাড়ি ফিরতে পারেননি, বা যারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদেরকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে শুকনা খাবার, রান্না করা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
সিলেটের যে সাতটি উপজেলা বন্যা কবলিত পড়েছে, সেগুলো হলো জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, বিয়ানিবাজার, জকিগঞ্জ, সিলেট সদর এবং ফেঞ্চুগঞ্জ। এসব উপজেলার কিছু কিছু এলাকার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও পানি পুরোপুরি নামেনি এখনো।
শনিবার বেলা ১১টার দিকে নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ‘সিলেট সদরের পানিও বিপৎসীমা থেকে সাত সেন্টিমিটার ওপরে আছে। যে সব অঞ্চল আরো বেশি প্লাবিত হয়েছে, সেখানে এটি আরো বেশি।’
এত বৃষ্টির কারণ কী?
পানি উন্নয়ন বোর্ড, আবহাওয়া অফিস, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয়রা অন্যান্যবারের মতো এবারো সবাই বলছেন, এই আকস্মিক বন্যার কারণ অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢল।
মূলত, গত সপ্তাহের সোমবার, অর্থাৎ ২৭ মে থেকে সিলেটে বৃষ্টি শুরু হয় এবং তা অব্যাহত থাকে বৃহস্পতিবার, মানে ৩০ মে পর্যন্ত। মে মাসের শেষ সপ্তাহেই আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় রেমাল।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, চলতি বছরের মে মাসে শুধুমাত্র সিলেট জেলায় ৭৭৫ মিলিমিটার এবং মৌলভীবাজার জেলায় ৭০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
একইসাথে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতেও রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৯৩ মিলিমিটার এবং তারও আগের ২৪ ঘণ্টায় হয়েছিল ৬৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে চেরাপুঞ্জিতে।
এছাড়া অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মৌসুমী বায়ু আগে সেট হয়ে গেছে। সাধারণত মৌসুমী বায়ু সেট হতে জুনের প্রথম সপ্তাহ, কখনো কখনো দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যায়।
আবহাওয়াবিদ মো: ওমর ফারুক বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে বাতাসে জলীয় বাষ্প এমনিতেই বেশি ছিল। পাশাপাশি মৌসুমী বায়ুও সেট হয়ে গেছে। এ কারণে ওখানে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রি-মনসুন থেকে মনসুনে যাওয়ার সময়টা যদি আগে এসে যায়, তখন এমন ঘটনা বেশি ঘটে।’
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের মেঘালয়, এই দুই এলাকায় অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় সাধারণত।
এটিকে আবহাওয়াবিদ ফারুক ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প গিয়ে ওখানে বাঁধা পায়। তারপর সেটি ওপরে উঠে গিয়ে বজ্রমেঘ তৈরি করে এবং ওই অঞ্চলে ভারী বৃষ্টি হয়।’
বাংলাদেশের বেশিভাগ এলাকার তাপমাত্রা এখন ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে বিরাজ করছে। তিনি বলেন, ‘কিন্তু তারপরও সবার একটা ভ্যাপসা গরম লাগছে। এর কারণ, জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি খুবই বেশি।’
আবহাওয়া অফিসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সিলেটে মে মাসে মোট ৩২৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। মৌলভীবাজারে হয়েছিল ১৮৪ মিলিমিটার।
আর ২০২২ সালের মে মাসে সিলেট জেলায় ৮৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। শুধুমাত্র শ্রীমঙ্গলে হয়েছিল ৬২৫ মিলিমিটার। ওই বছর চেরাপুঞ্জিতে এক হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল।
সিলেটের এই বন্যা কী অস্বাভাবিক?
সাধারণত মে, জুন ও আগস্ট মাসে সিলেটে বছরে তিন থেকে চারবার ছোট-বড় বন্যা হয়ে থাকে। কিন্তু মে মাসের শেষভাবে এরকম বন্যা সিলেটে কখনো হয়নি।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ‘২০২২ সালে এবং এ বছরের এই সময়ে যেটা হয়েছে, তা রেকর্ডব্রেকিং। এরকম কখনো হয়নি।’
এবারের এই আকস্মিক বন্যাকে তিনি ‘আর্লি ফ্লাড’ হিসেবে সঙ্গায়িত করেছেন।
তিনি মনে করেন, ২০২২ সালে সিলেটে যে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, এবারের বন্যার ভবাবহতাও সেবারের থেকে বেশি ছাড়া কম না।
তিনি এর কারণ ব্যাখ্যা বলেন, ‘সুরমা নদীর যে স্থানে আমরা ওয়াটার লেভেল মাপি, তা কানাইঘাট। সেখানে ওয়াটার লেভেল ২০২২ সালে ছিল ১৭ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার। এবার সর্বোচ্চ হয়েছে ১৭ দশমিক ৫৭ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ ২০২২ সালের বন্যার চেয়ে ৪২ সেন্টিমিটার ওপরে। পানির সমতলের কথা চিন্তা করলে অবশ্যই ২০২২ সালের চেয়ে এবার বেশি পানি এসেছে।’
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের জুনের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে যে বন্যা হয়েছিল, তাতে ওই দুই জেলায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
সিলেটে ঘন ঘন বন্যার কারণ
বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় প্রতিবছর যে বন্যা হয়, তার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরো কয়েকটি কারণ দেখছেন গবেষকরা।
নদী গবেষকরা মনে করেন, এ আকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরো কিছু উপাদান কাজ করেছে।
তার মাঝে একটি হলো নদীর পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। ওই অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্যতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যেতে পারে না।
একই সাথে, সিলেটসহ হাওর এলাকার অপরিকল্পিত উন্নয়নও এর পেছনে দায়ী।
২০২২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘সিলেট বা সুনামগঞ্জ এলাকায় আগে ভূমি যেরকম ছিল, নদীতে নাব্যতা ছিল, এত রাস্তাঘাট ছিল না বা স্থাপনা তৈরি হয়নি।’
তিনি বলেছিলেন, ‘ফলে বন্যার পানি এখন নেমে যেতেও সময় লাগে। আগে হয়তো জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারতো। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না।’
তিনি আরো বলেছিলেন, ‘হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট পকেট আমরা রোড করে ফেলেছি। ফলে পানি প্রবাহে বাধার তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর গ্রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা আমরা বেশি অনুভব করছি। এসব কারণে আগাম বন্যা হচ্ছে এবং অনেক তীব্র বন্যা হচ্ছে।’
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা