২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পালিয়ে আসা মিয়ানমারের সৈন্যদের চলতি সপ্তাহেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে?

-

মিয়ানমারের অভ্যন্তরের সংঘাতের মধ্যে পালিয়ে আসা দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি সদস্যদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রস্ততি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সঠিক কোনো দিন-তারিখ জানাননি, তবে সরকারের একাধিক কর্মকর্তা বিবিসিকে নিশ্চিত করেছে এ সপ্তাহের মধ্যেই পাঠানো হচ্ছে তাদের।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘মিয়ানমার সেনাদের খুব শিগগিরই ফেরানোর বিষয়ে কাজ চলছে।’ তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে দিনক্ষণ প্রকাশ করেননি তিনি।

বিবিসি বাংলাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন অঞ্চলের নৌরুট দিয়েই তাদের পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এবং সেটি এই সপ্তাহের মধ্যেই হতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজারে দায়িত্বরত একজন সরকারি কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ১৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবারই পাঠানো হতে পারে আটককৃত মিয়ানমার বাহিনীর সবাইকে।

যদিও তাদের ফেরত পাঠানো প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘পানিসীমা ব্যবহার করে কোনো জাহাজ অন্য দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম ও প্রটোকলের বিষয় আছে।’ সেই প্রক্রিয়া শেষ হলেই পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

এদিকে, উখিয়ার হাইক্যং সীমান্ত ও লম্বার বিল এলাকায় সোমবার ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ পেয়েছেন সীমান্তের বাসিন্দারা। এমন পরিস্থিতিতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের একটি এসএসসি পরীক্ষার পরীক্ষার কেন্দ্র পরিবর্তন করেছে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড।

কবে ফেরত যাচ্ছে মিয়ানমার বাহিনী?
সীমান্তের স্থলভাগ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল মিয়ানমারের বিজিপি ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য। তারা সীমান্তের যেসব এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল এখন সেগুলো বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখলে।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বিজিপি সদস্যসহ ৩৩০ জন মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

তাদেরকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে তাই মিয়ানমার সরকারের সাথে গত সপ্তাহ থেকে যোগাযোগ শুরু করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

দিল্লী সফর শেষে দেশে ফিরে সোমবার সংবাদ সম্মেলন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে এই রিজিওনে সংকট তৈরি হয়েছে। দেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে যে সব বর্ডার সিকিউরিটি গার্ড, সেনাবাহিনী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা এসেছেন সহসাই আমরা তাদের ফেরত পাঠাবো। তবে, সিকিউরিটি ইস্যুর কারণে আমরা দিনক্ষণ বলতে চাই না।’

দুই দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত যে আলোচনা হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা তাদের বাহিনীকে ফেরত পাঠাতে দুই দেশের সব প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে।

এই বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে নানা গুঞ্জনও রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, তাদের ফেরত পাঠাতে কতদিন লাগতে পারে এ নিয়ে কারো তেমন কোনো ধারণাও নেই। এমন অবস্থায় বিবিসি বাংলা কথা বলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দফতরের সাথে।

কোন পথে, কিভাবে পাঠানো হবে?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করা মিয়ানমারের নাগরিকদের নৌপথে টেকনাফ সীমান্ত অঞ্চল থেকে ফেরত পাঠানোর বিষয়েই কথা হয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে। তাদের পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ কিছু ‘সেইফটি ও সিকিউরিটি’ ধাপ অনুসরণ করে করার কথাও জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে যে জাহাজটি আসবে সেটি অবস্থান করবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার পানিসীমার মাঝ সমুদ্রে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এখানে সিকিউরিটির বিষয় যেমন আছে তেমনি সার্বভৌমত্বের বিষয়ও জড়িত আছে। এটার সিদ্ধান্ত এমনই হয়েছে।’

বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বিজিবির হাতে আটক সবাইকে একইসাথে এক জাহাজেই পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। নৌ-রুটে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রটোকল রয়েছে। এই প্রটোকল শেষেই তাদেরকে হস্তান্তর করা হবে।’

কী ধরনের প্রটোকল? জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার টেরিটোরিতে আসা বা যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রটোকল আছে। এ জন্য আগে থেকে মিয়ানমারকে কিছু ইনফরমেশন দিতে হবে। আমাদেরও কিছু ইনফরমেশন দিতে হবে। আমাদের যে ইনফরমেশনটা ওরা দিয়েছে, আমরা সেটা অ্যাসেস করছি।’

ফেরত নিতে আসা জাহাজ কবে, কিভাবে আসবে? কোথায় নোঙ্গর করবে, সেই স্থানের গভীরতা কত সব বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করা হবে। টেকনিক্যাল এই বিষয়গুলো দেখভাল করবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার ওই কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘তারা যে জাহাজে আসবে সেই জাহাজের ক্রু কারা থাকবে, সেখানে কর্মকর্তা কারা থাকবে, সেগুলো আগে থেকেই আমাদের জানাতে হবে। এখন সেই প্রক্রিয়াগুলো চলছে দুই দেশের মধ্যে। আমরা তাদের কাছে সেই বিষয়গুলো জানতে চেয়েছি। তারা আমাদের সেগুলো সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে। সেই অ্যাসেসমেন্ট শেষেই তাদের ফেরত পাঠানোর কাজ শুরু হবে।’

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশে মিয়ানমার দূতাবাসের মাধ্যমেই এই পুরো প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। শিগগিরই তার বাস্তবায়নের কথাও বলছেন তারা।

আটককৃত মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীরা কোথায় আছে?
গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের অন্তত ৩২৮ জন। পরের দিন বৃহস্পতিবার প্রবেশ করে আরো দুজন। এখন পর্যন্ত বিজিবি যে তথ্য দিচ্ছে সে অনুযায়ী ৩৩০ জন বিজিপি, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।

এরমধ্যে সবচেয়ে বড় অংশটি আসে গত ৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার। ওইদিন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। গ্রামবাসীদের সহায়তায় তারা আশ্রয় নেয় রহমতের বিল এলাকায়। সেই সংখ্যা ছিল ১১১ জন। তাদের মধ্যে বাহিনীটির পদস্থ কর্মকর্তাও ছিলেন।

প্রথমে তাদের রাখা হয়েছিল রহমতের বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। অস্ত্রমুক্ত ও সব প্রক্রিয়া শেষ করে তাদের রাখা হয়েছিল বান্দরবনের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে।

দু’দিন সেখানে রাখার পর বৃহস্পতিবার তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয় কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয়ে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো: মাহফুজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানান, তুমব্রুর যে স্কুলটিকে তাদের রাখা হয়েছিল সেটি সীমান্তের খুব কাছাকাছি ছিলও। তাই সেখানে নিরাপত্তাজনিত কিছুও বিষয় ছিল। পরবর্তী সময়ে তাদের টেকনাফের হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে।

তাদের মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি), সেনাবাহিনী, ইমিগ্রেশন সদস্য, পুলিশসহ তাদের পরিবারের সদস্যদেরও পেয়েছেন বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা। তাদের মধ্যে অন্তত দুইজন নারী ও তিনজন শিশুও রয়েছে।

সীমান্ত পরিস্থিতি এখন কেমন?
সোমবার ভোর রাত থেকে থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল হোয়াইক্যং সীমান্ত থেকে। ঘুমধুম সীমান্ত থেকে অন্তত দুটি জায়গায় আগুন জ্বলতে দেখার কথা জানিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয় সাংবাদিক আজিম নিহাদ বিবিসি বাংলাকে জানান, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বা বিল ও উনচিপ্রাং সীমান্তের ওপারে নাফ নদে একটি ছোট দ্বীপ রয়েছে। ওটা তোতারদিয়া দ্বীপ নামের পরিচিত। ওই দ্বীপের কাছাকাছি মিয়ানমারের চাকমাকাটা, কোয়াংচিমন ও কুমিরখালী এলাকায় বিজিপির ঘাঁটি দখলে নিতে যুদ্ধ চলছে। এর জের ধরে দ্বীপে থাকা কিছু রোহিঙ্গাদের নাফ নদীতে নেমে যেতে দেখা গেছে।

তিনি বিবিসিকে জানান, হ্যোয়াইক্যং-তোতারদিয়া সীমান্তে অস্ত্রধারী বেশ কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। আরাকান আর্মি ও আরএসও একসাথে অবস্থান করছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই দ্বীপে কিছু রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে; যারা অনুপ্রবেশ করতে পারেন। তবে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কঠোর নজরদারি দেখা যাচ্ছে।

ঠিক এই এলাকা থেকে চলে গেছে নির্মাণাধীন সীমান্ত সড়ক। এই সড়কটি পড়েছে বাংলাদেশ অংশেই। এতদিন এখানে বিজিবির টহলও দেখা যেত।

আজিম নিহাদ জানান, সোমবার সকালে ওই রাস্তায় অস্ত্র হাতে যাদের দেখা গেছে ধারণা করা হচ্ছে তারা আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা সংগঠন আরএসও সদস্য।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement