১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪ মাঘ ১৪৩১, ১৭ রজব ১৪৪৬
`
আল-জাজিরার বিশ্লেষণ

হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগ

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান - ছবি : আল জাজিরা

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান সম্প্রতি বৈঠক করেছেন।

এটি ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানের পাকিস্তানের রাজধানী সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এ সময় তিনি পাকিস্তানের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তার সাথেও সাক্ষাৎ করেন।

মঙ্গলবার জেনারেল আসিম মুনির ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানের এই বৈঠক সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিডিয়া শাখা উভয় দেশকে ‘ভ্রাতৃপ্রতীম জাতি’ হিসেবে বর্ণনা করে।

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হওয়ার পর গত ৫৪ বছরের বেশিরভাগ সময় ধরে ঢাকা ও ইসলামাবাদ তাদের সম্পর্ককে এভাবে দেখেনি।

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে দু’দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন আরো গভীর হয়। গণবিক্ষোভের পর আগস্ট মাসে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

কিন্তু হাসিনার বিদায়ের পর থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ একে অপরের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। দৃশ্যত তা এমন এক সময়, যখন উভয় দেশের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধী মনোভাব বিরাজ করছে, যা ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে ঐতিহাসিক শত্রুতাকে ছাপিয়ে গেছে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জানায়, আসিম মুনির এবং এস এম কামরুল হাসান সামরিক সম্পর্ক জোরদার করার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন এবং এই অংশীদারিত্বকে যেকোনো বহিরাগত বাধা থেকে মুক্ত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তাদের বৈঠকটি ছিল দু’দেশের মধ্যে উচ্চ-স্তরের বিনিময়ের ধারাবাহিকতার একটি।

গত মাসে মিসরের রাজধানী কায়রোতে এক আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করেন। সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদেও তারা দেখা করেছিলেন।

এদিকে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগামী মাসে বাংলাদেশ সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১২ সালের পর এটিই প্রথম এ ধরনের সফর। বিশ্লেষকরা বলছেন যে এতে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তন হতে পারে।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে ভারতের সাথে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা গ্রহণ করে। তবে ইসলামাবাদ এবং ঢাকার মধ্যে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো রয়েই যায়। এর মধ্যে ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের নৃশংসতার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া, বাংলাদেশ থেকে উর্দুভাষী মানুষদের প্রত্যাবাসন করা, যারা পাকিস্তানি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয় এবং ১৯৭১ সালের আগের সম্পদের দু’দেশের মধ্যে ভাগাভাগি চায়।

শেহবাজ শরিফের সাথে কায়রোতে সাক্ষাতের সময় মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানকে দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বার্তাসংস্থা অনুসারে, মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘বিষয়গুলো বারবার উঠে এসেছে। আসুন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এগুলো চিরতরে সমাধান করি।’

শেহবাজ শরিফ উত্তরে বলেন যে তিনি ‘অমীমাংসিত বিষয়গুলো’ খতিয়ে দেখবেন।

বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত আশরাফ কুরেশি আল জাজিরাকে জানান, হাসিনার ‘স্বৈরাচারী’ সরকারের প্রতি নয়াদিল্লির দীর্ঘ সমর্থনের কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন ঢাকার নতুন প্রশাসনকে তাদের পদক্ষেপ পুনর্বিবেচনা করতে প্ররোচিত করেছে।

গত মাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ‘বিচারিক প্রক্রিয়ার’ জন্য নয়াদিল্লির কাছে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের দাবি জানায়। হাসিনার বিরুদ্ধে তার শাসনামলে একাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে তার ক্ষমতাচ্যুতির আগের সপ্তাহগুলোতে বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ভারত সরকার এখনো এই অনুরোধের কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

অন্যদিকে, ভারত বারবার বাংলাদেশের হিন্দুদের ভাগ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যারা বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগের শক্তিশালী সমর্থক। নয়াদিল্লি অভিযোগ করেছে যে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।

তবে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে যে ভারতীয় গণমাধ্যমের মিথ্যা তথ্য দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে।

আশরাফ কুরেশি জানান, ভারত হাসিনাকে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। তিনি বলেন, ‘ভারত হাসিনাকে সহজে হস্তান্তর করতে পারে না। কারণ এটি এই বার্তা যাবে যে ভারত তাদের সমর্থনকারী যে কাউকে ত্যাগ করতে সম্মত হতে পারে।’

তবে কিংস কলেজ লন্ডনের সিনিয়র লেকচারার ওয়াল্টার ল্যাডভিগ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ও সামরিক বিনিময়ের তাৎপর্যকে অতিরঞ্জিত করার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন।

উভয়েই একমত যে বাংলাদেশের ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা ভারত-বিরোধী অবস্থানকে অসম্ভব করে তোলে, যদিও আরো স্বাধীন নীতির দিকে পরিবর্তন আসতে পারে। আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি পুনর্গঠনের জন্য উল্লেখযোগ্য নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নতুনভাবে সাজানোর প্রক্রিয়ার মধ্যেই পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আফগানিস্তানের তালেবান শাসকদের সাথে ভারতের উল্লেখযোগ্য যোগাযোগও ঘটেছে।

সম্প্রতি তালেবানের সাথে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক পাকিস্তানকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। পাকিস্তান কয়েক দশক ধরে তালেবানকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় এর নেতাদের আশ্রয় দিয়ে আসছে।

কিন্তু গত বছর পাকিস্তানে হামলার পর তালেবানের ওপর ইসলামাবাদের প্রভাব মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকেই তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে (টিটিপি), যা পাকিস্তানি তালেবান নামেও পরিচিত, এর জন্য দায়ী করে।

লাডউইগ মনে করেন যে গণঅভ্যুত্থানের ফলে সাময়িকভাবে হোঁচট খেলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে তা ইসলামাবাদকে আরো ভালো সম্পর্কের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের যত বেশি অর্থনৈতিক অংশীদার থাকবে, ততই তাদের জন্য মঙ্গলজনক। এটা ইসলামাবাদের জন্য সম্পর্ক উন্নত করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।’

ল্যাডউইগ বিশ্বাস করেন যে বাণিজ্য এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে আগামী দিনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় পাকিস্তান সরকার একটি সুযোগ দেখতে পাচ্ছে এবং সম্পর্ক উন্নত করার সম্ভাবনা অনুভব করছে।’

সূত্র : আল-জাজিরা


আরো সংবাদ



premium cement