২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চিন্ময় দাসের গ্রেফতার নিয়ে আক্রমণাত্মক ভারত

বাংলাদেশ উপরাষ্ট্রদূতাবাসের দিকে এগোচ্ছে বিজেপি বিধায়কদের মিছিল - বুধবার কলকাতায় - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশের সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার ও সেদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে কথিত হামলার ঘটনা নিয়ে ভারতের হিন্দুত্ববাদী দলগুলি বেশ আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। গণমাধ্যমেও গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ।

ভারতের প্রধান হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি এখনো পর্যন্ত শুধুমাত্র কড়া বিবৃতির মধ্যেই তাদের প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ রেখেছে, তবে পশ্চিমবঙ্গে দলটির নেতারা কর্মী-সমর্থকদের রাস্তায় নেমে বাংলাদেশের ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানাচ্ছেন। টেলিভিশনে বক্তব্য দিতে গিয়েও বিজেপি নেতাদের একাংশ বাংলাদেশ নিয়ে বেশ আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করছেন।

অন্যদিকে কেন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করছেন না, তা নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে দলের একাংশের নেতা-কর্মীদের মধ্যে।

আবার ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের গত দু’দিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দু’ধরনের প্রতিবেদন দেখা যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এক্ষেত্রে জাতীয় স্তরের ইংরেজি ও হিন্দি গণমাধ্যমের সাথে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনের স্পষ্ট ফারাক আছে বলেই মনে করছেন গণমাধ্যমের বিশ্লেষকরা।

যেখানে জাতীয় গণমাধ্যমগুলিতে বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রাসী ‘প্রতিবাদী’ ধাঁচে খবর দেখানো হচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের খবরের কাগজগুলোতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসে গ্রেফতার ও তার পরবর্তী ঘটনাক্রম নিয়ে যা লেখা হচ্ছে, তা যথেষ্ট মাপা এবং নিরপেক্ষ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এর মধ্যেই অবশ্য মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় অপরাধীরা যেখানে ধরা ছোয়ার বাইরে সেখানে একজন ধর্মীয় নেতা এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন কথা বলেছে তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বিবৃবিতে বাংলাদেশের হিন্দুসহ সকল সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের আহবান জানানো হয়।

অন্যদিকে ভারতের উদ্বেগ প্রকাশের পাল্টা বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, অতিশয় হতাশা ও গভীরভাবে অনুভূতিতে আঘাতের সাথে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখ করছে যে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতারের পর থেকে কিছু মহল তা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমন অপ্রমাণিত বিবৃতি শুধু সত্যের অপলাপই নয়, একই সাথে তা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার চেতনার পরিপন্থী।

কী বলছে বিজেপি?
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-ই প্রথমে মুখ খুলেছিলেন। ‘হিন্দুদের ওপরে হামলা’র মতো বিষয়ে তাকে আগেও কড়া প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা গেছে।

কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বাইরে শুভেন্দুর নেতৃত্বে বিজেপির বিধায়করা বিক্ষোভ দেখান মঙ্গলবার।

সেখানে শুভেন্দু সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানাচ্ছি আমরা।’

‘সারা পৃথিবীর সব হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আজ কলকাতায় বিজেপি বিধায়করা বিক্ষোভ দেখালেন। তবে বাংলাদেশে যদি হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার অতি সত্বর বন্ধ না হয় তাহলে আমরা আরো জোরালো বিক্ষোভ শুরু করব।”

মঙ্গলবার রাতে কলকাতার বেহালা অঞ্চলে কোনো দলীয় পতাকা ছাড়াই হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠনের নেতা কর্মীরা মশাল মিছিল করেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের প্রতিবাদে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপরে কথিত হামলার বিরুদ্ধে স্লোগানও দিতে শোনা গেছে ওই মিছিলে।

মঙ্গলবার রাত থেকে চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের নানা জায়গায় সহিংসতার অনেক ভিডিও গণমাধ্যমে দেখানো হয়েছে।

এরপরে বুধবার সকালে বিজেপির সংসদ সদস্য ও রাজ্যে দলটির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘ইথিওপিয়াতে মার্কিন অবরোধ, গাজা স্ট্রিপে ইসরাইলের হামলা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় মিছিল হয় আর আজ এত বড় অত্যাচার হচ্ছে পাশের বাংলাদেশে (কোথায় প্রতিবাদ)?

শমীক বলেন, ‘তারা আমাদের ভাই, তারা মারা যাচ্ছেন সেখানে, একটা শব্দ কেউ উচ্চারণ করতে পারছেন না? কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে?’

বিজেপি নেতা ও ‘কমিটি অ্যাগেইনস্ট অ্যাট্রসিটিস অন মাইনরিটিস অফ বাংলাদেশ’ বা ‘ক্যাম্ব’-এর আহ্বায়ক মোহিত রায় দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপরে কথিত অত্যাচার নিয়ে সরব।

তিনি বলছিলেন, ‘একটা রাজনৈতিক দল যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, যেমন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ বা মিছিল করা, সেরকম কিছু কিন্তু দল হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টি এখনো পর্যন্ত দেখায়নি। মঙ্গলবার রাতে যে মিছিল হয়েছে কয়েকটি স্থানীয় হিন্দু সংগঠন আয়োজন করেছিল, সেখানে আমিও ছিলাম, অনেক বিজেপি কর্মী সমর্থকও ছিলেন, কিন্তু সেখানে কোনো দলীয় পতাকা ছিল না। এটা নিয়ে বিজেপি কর্মীদের মধ্যে একটা হতাশাও কাজ করছে।’

বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে সরব হলেও এখনো পর্যন্ত অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে সেরকম কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়নি।

বিজেপির লক্ষ্য স্থানীয় হিন্দু ভোট?
বিজেপি বা অন্য কোনো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন মুখে বেশ আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া দেখালেও রাস্তায় নেমে বিশেষ কোনো প্রতিবাদ যে এখনো দেখা যাচ্ছে না, তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কেউ কেউ বলছেন যে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলার ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ হিন্দুত্ববাদীদের আসল লক্ষ্য নয়।

ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিশ্লেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘটনাক্রম নিয়ে বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো যে কড়া প্রতিক্রিয়া বা বিবৃতি দেয়, তার আসলে লক্ষ্য হল পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে হিন্দু ভোট এক-জোট করা। আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে এই পদ্ধতি তারা দীর্ঘদিন ধরেই অনুসরণ করছে, সম্প্রতি একই নীতি তারা প্রয়োগ করছে ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশাতেও। এই গোটা অঞ্চলে নানাভাবে তারা বাংলাদেশটাকেই ইস্যু করে তুলেছে।’

তার কথায়, ‘এই পুরো অঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করছে, আবার হিন্দুদের বলছে তোমরা যদি বাংলাদেশের মতো টালমাটাল পরিস্থিতিতে পড়তে না চাও তাহলে এলাকা থেকে মুসলমান হটাও।’

তিনি বলেন, আগে কথায় কথায় মুসলমানদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলা হত, এখন সেটা বদলিয়ে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে চলে যাও।

চিন্ময় দাসের গ্রেফতার নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম
মঙ্গল ও বুধবার দু’দিনই ভারতের সংবাদপত্রগুলিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার, চট্টগ্রামের আদালতে তাকে পেশ করার পরবর্তী সহিংসতার খবরাখবর গুরুত্ব পেয়েছে। এই সংক্রান্ত খবরাখবর দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনের প্রাইম টাইম বুলেটিনগুলিতেও।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেয় বাংলাদেশের ঘটনাক্রম নিয়ে, তারপর থেকেই জোরেশোরে কভারেজ শুরু করে ভারতীয় মিডিয়া।

ভারতের জাতীয় সংবাদপত্রগুলিতে বুধবার চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারি ও বাংলাদেশের সহিংসতা নিয়ে যেধরণের শিরোনাম হয়েছে, তার বেশিরভাগেই রয়েছে ভারত সরকার যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, সেটি। যেমন ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসের শিরোনাম হল ‘Monk arrest: india flags safety of Hindus, Dhaka says it is deeply hurt’ অর্থাৎ সন্ন্যাসী গ্রেফতার – হিন্দুদের সুরক্ষার বিষয়ে উল্লেখ ভারতের, ঢাকা জানাল তারা ব্যথিত।

হিন্দুস্তান টাইমসের শিরোনাম হয়েছে ‘Protect all minorities, India tells bangladesh after arrest of hindu priest’ অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের রক্ষা করুন, হিন্দু সন্ন্যাসীকে গ্রেফতারের পরে বাংলাদেশকে বলল ভারত।

এই দু’টি কাগজ ভারতের বিবৃতিকে গুরুত্ব দিলেও অন্যতম বেশি বিক্রির ইংরেজি পত্রিকা টাইমস অফ ইণ্ডিয়ার শিরোনাম একটু আলাদা। তারা লিখেছে India bangladesh tensions mount as hindu priest jailed for ‘sedition’, অর্থাৎ ‘দেশদ্রোহে’র জন্য হিন্দু সন্ন্যাসীর জেলের পরে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে টানাপোড়েন বাড়ল

দু’টি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দি দৈনিক অমর উজালা এবং দৈনিক জাগরণ প্রায় একই শিরোনাম করেছে, যেখানে তারা ভারত সরকারের বিবৃতিটিকে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছে যে হিন্দুদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করুক বাংলাদেশ, বলল ভারত।

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা পত্রিকাগুলিও প্রথম পাতাতেই বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবর ছেপেছে।

আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় এক কলমের খবরের শিরোনাম হলো ‘চিন্ময়কৃষ্ণকে নিয়ে কড়া বিবৃতি দিল্লির, পাল্টা ঢাকারও’। তবে তারা ভেতরের পাতায় তিন কলাম জুড়ে বড় ছবি দিয়ে বিস্তারিত খবর ছেপেছে। তার শিরোনাম ছিল ‘চিন্ময়কৃষ্ণ জেলে, রণক্ষেত্র চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী’।

বর্তমান কাগজের শিরোনাম হলো ‘বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা ভারতের’।

বাংলা কাগজগুলির মধ্যে বাংলাদেশের এ সংক্রান্ত খবর দিয়ে সবথেকে বড় করে প্রতিবেদন ছেপেছে প্রতিদিন কাগজ।

তারা শীর্ষ খবরের শিরোনাম দিয়েছে এভাবে ‘সন্ন্যাসী গ্রেফতারে উত্তাল বাংলাদেশ, পুলিশের লাঠি, খণ্ডযুদ্ধে মৃত এক’।

প্রথম পাতায় আরো একটি খবর রয়েছে প্রতিদিন কাগজে, যেটি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইস্কনের বিবৃতি সংক্রান্ত।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি কাগজ ‘দ্য টেলিগ্রাফ’এর শিরোনাম করা হয়েছে ‘Hindu preacher arrest triggers bangla clashes’, অর্থাৎ হিন্দু সন্ন্যাসী গ্রেফতারে বাংলায় সংঘর্ষ’।

বাংলা ও জাতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে ভিন্ন সুর
সংবাদ পোর্টাল দ্য ওয়ালের কার্যকরী সম্পাদক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক অমল সরকার বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যম যেভাবে গত দু’দিনের ঘটনাক্রম দেখাচ্ছে, সেটাকে দু’টি ভাগে ভাগ করতে হবে আমাদের। একটা জাতীয় স্তরে কী দেখানো হচ্ছে বা ছাপা হচ্ছে আর অন্যটা পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার কাগজ-টিভিতে কী দেখানো হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘সর্বভারতীয় গণমাধ্যম ইংরেজি এবং হিন্দি দুই ভাষাতেই বাংলাদেশের এই ঘটনা নিয়ে যা দেখানো হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে সংবাদমাধ্যম যেন একটা রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মতো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তুলে ধরছে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা প্রথম সারির গণমাধ্যম কিন্তু সবসময়েই এ ধরনের ঘটনায় তা বাংলাদেশের হোক বা অন্য কোনো জায়গায় খুব সতর্কতা এবং সংযতভাবে উপস্থাপন করে।’

তার কথায়, ‘সেই ধারাবাহিকতায় কিন্তু এবার একটু ব্যত্যয় ঘটেছে। জাতীয় টিভি চ্যানেলগুলির যেসব বাংলা শাখা চ্যানেল আছে, তাদের কভারেজও কিন্তু জাতীয় স্তরের গণমাধ্যমের মতোই হচ্ছে। সেটা বেশ আগ্রাসী প্রতিবেদন করছে, সাংবাদিকতা ছাপিয়ে প্রতিবাদের স্বর উঠে আসছে যেন।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement

সকল