বাংলাদেশের শিল্পকলা
- ড. মোজাফফর হোসেন
- ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রঙতুলি হাতুড়ি বাটাল দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর যারা শিল্পচর্চা করেছেন তাদের কর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন জয়নুল আবেদিন। তিনি ১৯৪৮ সালে ঢাকায় স্থাপন করলেন চারুকলা ইনস্টিটিউট। এ কাজে জয়নুল আবেদিনকে সহযোগিতা করেছিলেন ড. মুহম্মদ কুদরতে খুদা; সলিমুল্লাহ ফাহমী প্রমুখ। এরপর জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের উদ্যোগে গড়ে তোলা ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’ নামে একটি সংগঠন বাংলাদেশে শিল্প আন্দোলনের যাত্রা আরম্ভ করে। ধর্মকে উপেক্ষা করে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে শিল্পকলার চর্চা বিশেষ করে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যকলা চর্চা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ইউরোপ থেকে শিক্ষা শেষে আমিনুল ইসলাম ১৯৫৬, হামিদুর রহমান ১৯৫৬ ও নভেরা আহমেদ শিল্প আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে চারুকলা শিক্ষাকে মূল ধারার শিক্ষার সাথে যুক্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এই আন্দোলনের সাথে আরো যারা যুক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন- আব্দুর রাজ্জাক ১৯৫৭, সৈয়দ জাহাঙ্গীর ১৯৫৭, রশীদ চৌধুরী ১৯৫৮, মুর্তজা বশীর ১৯৫৮ ও সফিউদ্দিন আহমেদ ১৯৫৯; এস এম সুলতান, কাইযুম চৌধুরী। বাংলাদেশের শিল্পকলার বয়স স্বাধীনতার পূর্ব ২০-২২ বছর এবং স্বাধীনতা পরবর্তী এখন পর্যন্তু। ঢাকা আর্ট গ্রুপের সাথে যুক্ত শিল্পীবৃন্দের সরব প্রভাব শিল্পে লক্ষ করা গেছে ৮০-৯০ দশকেও। এই দশকে স্বতন্ত্র প্রতিভা নিয়ে একজন শিল্পীর উন্মেষ ঘটে। তিনি আব্দুস সাত্তার (১৯৪৮-)। তার শিল্পকর্ম মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি বংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর চিত্রশিল্পের গবেষক শিল্পী। পাশ্চাত্য শিল্পের প্রভাবে বাংলার শিল্পীরা যখন নিজেদের শেকড় ভুলে গা ভাসিয়েছেন ইউরোপের আদর্শে; তখন প্রাচ্যকলার সৌন্দর্যকে শিল্পী আব্দুস সাত্তার গর্বের সাথে বিশ্ব মঞ্চে পরিচিত করিয়েছেন নিজের প্রতিভায় শিল্পকর্মের মাধ্যমে। বাংলার ঐতিহ্যকে তিনি চিত্রায়িত করেছেন শিল্পের নানান মাধ্যমে। ছাপচিত্রে আবদুস সাত্তারের কৃতিত্ব গৌরবের। বাংলাদেশে ‘এশিয়ান চারুকলা প্রদর্শনী’তে ‘পোড়াকাঠে গোলক’ শীর্ষক বিমূর্তের ধারায় উডকাঠ শিল্পকর্মটি ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক শিল্পকর্ম এবং স্বর্ণপদক জয়ী এই শিল্পকর্মটি যুদ্ধকালীন বর্বরতাকে জনসম্মুখে তুলে ধরে। আবদুস সাত্তার বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি চিত্র আন্দোলনেরও উদ্যোক্তা। আরবি ও বাংলা ক্যালিগ্রাফি নিয়ে তার বিস্তর কাজ রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি প্রশংসিত। এই খ্যাতিমান শিল্পী নন্দনতত্ত্বের বিশ্লেষণ করেছেন আধুনিক টেকনিকে। তার লেখা নন্দনতত্ত্বের বই ‘প্রকৃত শিল্পের স্বরুপ সন্ধানে’ বহুল পরিচিত। তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন; শিল্পকলা যুগে যুগে; বাংলাদেশের নতোন্নত দারুশিল্প; অলঙ্কার; শিল্পের আনন্দ; পশ্চিমা শিল্পের আগ্রাসন ও পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দ্ব; সোমনাথ হোরের পত্র ও কলকাতার চিত্র; প্রাচ্যচিত্রের সৌন্দর্য, প্রভৃতি। শিল্পী আবদুস সাত্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদে শিক্ষকতা করেছেন শেষাবোধি। ঐতিহ্যকে ধারণ করে ছবি এঁকেছেন। তাঁর শিল্পে ফুল পাখি, লতাপাতা, ইত্যাদির ফিগার ও বিমূর্ততা নিজস্ব ফর্মে তুলে এনেছেন। রেখার মাধ্যমে ডেকরেশান করেছেন। কম্পোজিশনে তার চমৎকার আইডিয়া ধরা পড়েছে। প্রচুর নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিত্রশালায় এই গুণী শিল্পীর চিত্রকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে। শিল্পকলা, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। মালয়েশিয়ার জাতীয় চিত্রশালায় শিল্পী ড. আবদুস সাত্তারের ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শিত হয়ে থাকে। আবদুস সাত্তার মানুষকে ভালোবাসেন। নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেন এবং শিল্পের মাধ্যমে তিনি মানুষের রুচি ও অভ্যাসকে সুন্দর করে গড়ে তোলার প্রয়াসে শিল্পকর্ম সজ্জিত করেন। বাংলাদেশে শিল্পকলার অঙ্গনে এই শিল্পীর অবদান স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করেছে।
এরপর এসেছে নবীন শিল্পীবৃন্দ। স্বাধীনতা উত্তর সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা তরুণ শিল্পীদেরকে বক্তব্য প্রধান শিল্পকর্ম সৃজনে উদ্বুদ্ধ করেছে। সামাজিক অস্থিরতা, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অনৈতিকতা, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি নবীন শিল্পীদের কাজের বিষয়বস্তু হলেও নতুন পুরাতন কেউই ইসলামী মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে শিল্পে ধারণ করার চেষ্টা করেননি। তবে ইসলামী শিল্পকলার কিছু বিষয় স্বভাবতই অনেকের কাজের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন লতাপাতা, ফুলফল, বাসনকোসন, হাঁড়িপাতিল, প্রকৃতি, নদী, পাহাড় পর্বত ইত্যাদি। জীবজন্তুর চিত্র বাদ দিলে সবই ইসলামী চিত্রকলা এবং মূর্তি-ভাস্কর্য বাদ দিয়ে স্থাপত্য কর্ম সৃষ্টি ইসলামে নিন্দার কিছু নয়। তবে বাংলাদেশের শিল্পকর্মে জীবজন্তুকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা অব্যাহত থেকেছে। নবীনদের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার ভঙ্গি, আঙ্গিক ও মাধ্যমেও বৈচিত্র্য লক্ষ করা গেছে। নবীন শিল্পীরা বিভিন্নভাবে মানব অবয়বকে বিকৃত করে প্রকাশ করেছে। পরাবস্তব পরিবেশন, ব্যাঙ্গাত্মক, রঙের ব্যতিক্রমী প্রয়োগ ও স্থাপত্যের দৃষ্টিনন্দন কৌশল সৃজন করে চোখ ধাঁধানো শিল্পকর্ম তৈরিতে পারজ্ঞম হয়ে উঠেছে। কমবেশি সব শিল্পকর্মে নারীকে ঘুরেফিরে কৌশলে প্রতীকে উপস্থাপন করার প্রবণতা বিস্তার লাভ করেছে। নবীন শিল্পীদের মধ্যে কালিদাস কর্মকার. হামিদুজ্জামান খান, মাহববুর রহমান, ওয়াকিলুর রহমান, অশোক কর্মকারসহ আরো অনেকেই আছেন। যারা শিল্পকর্মের বিষয়বস্তুতে ইসলামী ঐতিহ্যকে রাখার চেষ্টা করেননি। বরং তাদের সৃষ্টি চিত্র ও ভাস্কর্য মুসলমানদের মূল্যবোধকে অনেকখানি খাটো করলেও এসব শিল্পীদের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তুতে বাঙালি ঐতিহ্য উঠে এসেছে গুরুত্বের সাথে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা