১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

কুয়াশার অন্ধকার

কুয়াশার অন্ধকার -

দক্ষিণের উঁচু ভিটেয় ভাদ্রের শেষে বেগুন লাগাল দুলু। বেগুন চাষে অনেক ঝামেলা। ঘন ঘন চাষ দিয়ে জমি রোদে শুকাতে হয়। গোবরের সাথে জিপসাম ফসফেট মিশিয়ে ভাঁপ দিয়ে রাখতে হয়। দিন পনের পরে জমি গ্যাসমুক্ত করে পিঁপড়াজাতীয় পোকা দমনে প্রয়োগ করতে হয় হেপ্টাক্লোর বা গ্যামাক্সিন। জমিতে জো এলে লাইন টেনে করতে হয় চারা রোপণ।
দুলুর বেগুন ক্ষেতে চারা লাগানোর পর উৎপাত শুরু করল উরচুঙ্গা পোকা। রাতে কচি চারা কেটে সাবাড় করতে লাগল। আলোর ফাঁদে মারতে না পারলে ওরা একটা চারাও রাখবে না। পোকার আপদ দূর করে চারাগুলো সবল করে তোলে দুলু। ছোট লাঙ্গলে মাটি নরম করে বেগুনের শেকড় মাটির বন্ধনে দৃঢ় করার টেকনিক তার ভালো জানা আছে। দেখতে দেখতে বেগুনের কালো পাতা আশি^নের পরিচ্ছন্ন সোনালি আলোয় হাসতে লাগল। এখন শুরু হল লেদা পোকার উপদ্রব। এই পোকা বেগুনের বর্ধিষ্ণু ডগা কেটে পয়মাল করে। দুলু ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করে। শরতের মেঘচ্ছায়া আকাশের নীল থেকে সুগভীর মায়া ঝরে পড়ে তার ক্ষেতে। প্রাণখোলা বাতাস মাঠের ওপর দিয়ে ছুটে এসে কৃষ্ণবরণ গাছগুলোকে পরশ বুলিয়ে যায়। কালো মোষের রক্তাভ চোখের মতো বন্যতার আবেশ ছড়িয়ে গাছগুলো উদ্ধত গৌরবে দাঁড়িয়ে থাকে। দুলু ক্লান্তি ভুলে ক্ষেতের যত্ন করে। একটি দুটি করে ফুল আসা শুরু হয়েছে প্রতিটি গাছে। আদুরে বধূর নোলকপড়া নাকে যেন মেঘের ত্রিভুজ। দূর গগনের রক্তিম রোদে আলোমাখা দিনের স্বপ্নে ঢুলুঢুলু নয়ন। গভীর রাতে জোনাকির নিষ্প্রভ আলো বাদামি পাখার ভাঁজ খুলে ক্ষেতের আলে গড়াগড়ি খায়।
দুলু চোখ ভরে উপভোগ করে ক্ষেতের সৌন্দর্য। তারই আনাড়ি হাতের পরশে সৃষ্ট এই দৃশ্য তার কাছে অবিশ^াস্য মনে হয়। মাঝে মাঝে ক্ষেতের আলে শুয়ে থাকে সে। দূরাকাশ থেকে তার চোখে সুখকর তন্দ্রা নেমে আসে। সবুজ পাতায় যেন বাঁশির সুর। এক চঞ্চল নীলাঞ্জনা, চপল পাখায় বাতাস করে যায় প্রকৃতির বুকে। শরৎকান্তির ষোড়শি দিন পানের রসে রাঙানো ঠোঁটের হাসি ঢালে। আত্মভোলা মেঘ শিশুরা সাগরের উদ্দাম ঢেউ হয়ে উড়ে এসে লুকোচুরি খেলে বেগুন ক্ষেতে।
দেখতে দেখতে দুলুর জমি বেগুনের গভীর কালো পাতা, হরিদ্রাভ ফুল এবং ফলবান ডালে ছেয়ে গেল। প্রতিদিন নিজ হাতে পরিপুষ্ট বেগুন তোলে দুলু। জমিতে বসে সে তা নগদ দামে বিক্রি করতে লাগল। তার ক্ষেতটা আগুর বাতের। সেজন্য সে সঠিক মূল্য পাচ্ছে। বাঁশের ফালা দিয়ে ক্ষেতের চারদিক ভালো করে ঘিরে দেয় সে। বেগুন বড় স্পর্শকাতর ফসল। একবার চোরহাত লাগলে আর হতে চায় না। রাতের বেলা ছুটে আসা উড়ান্ত গরু-মহিষ ক্ষেতের ক্ষতি করতে পারে। ক্ষেতের কোণে বাঁশের পাটাতন দিয়ে উঁচু করে টঙ বানায় সে। টঙের উপর সুন্দর ছই দেয় সে মজবুত খুঁটি দিয়ে। কাজের লোক নিয়ে রাতে ক্ষেত পাহারা দেয় দুলু। নতুন ঘেরার ভেতর বেগুনের লকলকে বাড়ন্ত ক্ষেত। লাজনম্র উচ্চাশায় তার পল্লব আঁধারের প্রলেপ গায়ে মাখে। কার্তিকের ফিনফিনে কুয়াশা ডালপালার ফাঁকে জোসনার স্বর্গ রচনা করে। মনে হয় এ ক্ষেতটুকু আলাদা স্বপ্নের ভুবন। যেন এক মনোহর চিত্রল হরিণের মায়াময় কাটা কলিজা।
কালসন্ধ্যা কেটে গেলে দুলুর নবীনা স্ত্রী বেগুন ক্ষেতের আলে এসে দাঁড়ায়। এদিক উদিক দেখে ছইয়ের তলে এসে বসে সে। ক্ষেতের বাহার দেখে তার মন চঞ্চল হয়। ঠোঁটে তার উজ্জ্বল চাঁদের কিরণ। বেগুনের ফুল-ডগা ও কালো-কাজল মেদবহুল পাতায় তার অন্তরের বাঁধভাঙ্গা খুশি ছড়িয়ে পড়ে।
দুটো টুনটুনি এসে বেগুনের গাছে বাসা বেঁধেছে। ডালে বসে টুনটুন করে গান গায়। ফুরফুর শব্দ করে উড়ে বেড়ায়। তাদের পাখা যেন হালকা হাওয়ার মেঘ। মনে মনে দুলু পাখির বাসা খোঁজে। তারা এত সতর্ক হয়ে বাসা তৈরি করেছে, দুলু অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পায় না। বেগুনের ধূসর পাতায় অত্যন্ত গোপনে টুনটুনি বাসা বানায়। ডালের সাথে বাসা এমন পোক্ত করে বেঁধে রাখে যে সহজে পড়ে যায় না। খুঁজে খুঁজে দুলু একদিন ওদের বাসার সন্ধান পায়। নিখুঁত শিল্পের কারুকার্যখচিত একটি মনোরম বাসা। মোড়ানো পাতার ভেতর নরম নীড়ে পড়ে আছে খয়েরি রঙের দুটো ডিম। ডিমের গায়ে হালকা কালো কালো ফোঁটা। কী মায়াময়, কী অনুপম! দুলু অপলক চেয়ে থাকে ডিমের দিকে। সে দূরে দাঁড়িয়ে পাখির ডিমে তা দেয়ার দৃশ্য উপভোগ করে। ওদের ছোট্ট বুকে লুকিয়ে আছে যে গভীর মমতা, তারই উত্তাপে আগামী দিনের জন্য জন্ম নেবে দুটো ক্ষুদ্র পাখি। জগতের সুরের মেলায় স্রষ্টার মহিমা প্রকাশে নীরবে যুক্ত হবে দুটো কচি প্রাণ। সংসারের বিশাল পরিমণ্ডলে তারাও একদিন হারিয়ে যাবে সত্য; কিন্তু তাদের অনুচ্চ শব্দের দ্যোতনা অসংখ্য শব্দের সাথে একাকার হয়ে মিশে থাকবে।
নাদিরাকে বেগুন ক্ষেতে ডেকে নিয়ে যায় দুলু। ওকে জড়িয়ে পাখির বাসা দেখায়। টুনটুনির ডিমের অতুলনীয় সৌন্দর্যে সেও মুগ্ধ হয়। অস্তিত্ব লাভের সূচনায় প্রাণবীজ যে স্বর্গীয় রূপের ঝরনায় অবগাহন করে তা উপলব্ধি করে তারা বিস্ময়ে আপ্লুত হয়। সারাদিন ওদের চেতনায় মিষ্টি সুরে গান গায় দুটো উড়ন্ত পাখি। হৃদয়ের পারাপারে কোথায় যেন এক গোপন যোগবন্ধন, সমতার নদিতটে খেলা করে। সেখানে সুর করে গান গায় অদৃশ্যলোকের দুটো অচিন বিহঙ্গ।
দুলুর বেগুন ক্ষেতে সহসা মড়ক লাগল। ফলভর্তি গাছগুলো পুড়ে বিবর্ণ হয়ে ঢলে পড়তে লাগল। দুলু গাছে ঔষধ ছিটিয়ে দিলো; কিন্তু কোনো কাজ হলো না। কৃষি অফিস থেকে লোক এসে সব দেখেশুনে বলল, ‘এ মড়কের উৎপত্তি এক ধরনের ভাইরাস থেকে। এ ভাইরাস বীজের ভেতর সুপ্তাবস্থায় থাকে। গাছে ফল ধরা শুরু হলে, ভাইরাস গাছকে আক্রমণ করে। এ বালাইয়ের সঠিক চিকিৎসা এখনোআবিষ্কার হয়নি।’ দুলুর সব পরিশ্রম বিফল হয়ে গেল। গাছ মরে মরে তার ক্ষেত ফাঁকা হয়ে যায়। অসুস্থ গাছগুলো উপড়ে আগুনে পোড়ানোর কারণে একটা নিষ্প্রাণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। টুনটুনি যে গাছে বাসা বেঁধেছে, সে গাছটাও রোগাক্রান্ত হয়। গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে গেলে পাখির বাসা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। বাসার জন্য যে নির্জনতা প্রয়োজন তা নষ্ট হওয়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে পাখিরা।
ডিম থেকে সবেমাত্র দুটো বাচ্চা বের হয়েছে। বড় হয়ে উড়তে শেখার অনেক দেরি আছে। সব গাছ মরে গিয়ে ক্ষেত ফাঁকা হয়ে গেছে। দুলু মরে যাওয়া বেগুন গাছের জায়গায় জঙ্গল থেকে ভাঁটিগাছ চার কেটে এনে লাগিয়ে দেয়। যাতে পাখিরা নির্ভয়ে যাওয়া আসা করতে পারে। বেগুন ক্ষেত যে নষ্ট হয়ে গেল, সেদিকে দুলুর খেয়াল নেই। তার একান্ত প্রচেষ্টা টুনটুনির বাচ্চাকে রক্ষা করা। গাছ মরে যাওয়ায় কারণে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করা দুলুর পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। ভয় পেয়ে পাখিরা বাসায় আসা একদম বন্ধ করে দেয়। তারা ক্ষেতের চারদিকে আর্তনাদ করে উড়ে বেড়াতে থাকে। এভাবে তারা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে দূরে উড়ে চলে যায়। বাবা-মার ক্রোড়বঞ্চিত হয়ে ছানা দুটি শূন্য বাসায় মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনতে থাকে। দুলু ওদের মুখে খাবার ও পানি তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। তারা সে খাবার গ্রহণ না করে রোদের খরতাপে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। একটা শূন্য রিক্ত হাহাকার দৃশ্যমান জগতের অসহায় ধ্বনিকে উচ্চকিত করে বেগুন ক্ষেতের শুষ্ক ডালে আছড়ে পড়ে। টুনটুনি ছানার মৃত্যুদৃশ্য দেখে নাদিরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। অপ্রতিরোধ্য ভাইরাসের আক্রমণে ঝলসে যাওয়া ক্ষেতের বিস্মৃত কাজল কালো রূপ সে মনের গহনে খুঁজে বেড়ায়। তার ভগ্ন কৃষ্ণ বিরুক্ষ হৃদয় রাতের তমসাবৃত দেয়ালে মাথা ঠুকে কাঁদতে থাকে। অশ্রুর অতল নদিতে সাঁতার কাটে সে। নাদিরার মনোলোকে দীপ্যমান দুটো অতনু পাখিসত্তাকে মেঘের আড়ালে অদ্ভুত রাক্ষস গিলে খায়।
নাদিরার মনোবৈকল্য তার সুশ্রি অবয়বে ক্লান্তির ছাপ ফেলে। তার মনের প্রফুল্লতা ও ভাব সম্মিলন নষ্ট হয়ে যায়। এক খণ্ডিত জটিল মনস্কতা অনালোক সঙ্কীর্ণপথে তাকে ঘনকৃষ্ণ কুহেলিকার রাজ্যে নিয়ে যায়। তার চোখ দিনের আলোয় দেখে রাতের আঁধার। ভাবনার ঘূর্ণি দৌড়বাজ অশে^র মতো বিশুষ্ক প্রান্তরে ছুটে ছুটে অবসন্ন হয়ে যায়। সাধের বেগুন ক্ষেতে নাদিরা আর যায় না। সব সময় তার বুক ভেঙে দীর্ঘশ^াস বের হয়। অনিদ্রা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। খাবারে তার একটুও আগ্রহ হয় না। যদিও মুহূর্তের জন্য তার চোখে ঘুম আসে কিন্তু টুনটুনি-ছানার করুণ মৃত্যুদৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠে। কে যেন আঁধারের আড়াল থেকে তাকে ব্যথিত সুরে ডাকে। দুলু নাদিরার এমন অশুভ লক্ষণ দেখে বিচলিত হয়। বেগুন ক্ষেতের ক্ষয়ের বিবর্ণ রূপ, দুটো শিশুপাখির অকালমৃত্যু এবং নাদিরার অসহায় মলিন চেহারা দেখে সে বিহ্বল হয়ে পড়ে।
নাদিরাও তো মা হতে যাচ্ছে। তার সন্তান ধারণের এই লগ্নে এই আকস্মিক ঘটনাগুলো কী গভীর রেখাপাত করতে পারে না? তার জঠরের নিভৃতে বর্ধিঞ্চু ভ্রুণের কোষকলায় কী এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে না?
দুলু তার বন্ধুর সাথে পরামর্শ করে নাদিরাকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তার কাছে সব কথা খুলে বলে। তার মতিবৈকল্যের পেছনে দায়ী বিষয়সমূহ ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে শোনে। গর্ভস্থ সন্তানের ওপর এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে ডাক্তার। সনোগ্রামের ইমেজে ভ্রুণের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে। নাদিরাকে বিশ্রাম ও নিয়মিত ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেয় ডাক্তার। ডাক্তার আরও বলে, ‘এসব নিয়মের ব্যতিক্রম হলে গর্ভপাত হতে পারে।’ এক রাতে নাদিরার তলপেটে তীব্র ব্যথা হয়। প্রচুর রক্তপাতের সাথে খসে যায় গর্ভস্থ ভ্রুণ। যে ভ্রুণটিতে নির্দয়ভাবে ছায়া ফেলেছিল রুক্ষ প্রকৃতির রূঢ় তাণ্ডব। একটি নষ্ট বেগুন ক্ষেত এবং দুটো পাখিছানার অনাকাক্সিক্ষত ক্ষয় ও ধ্বংসের প্রত্যক্ষ প্রভাব সেখানে স্পষ্ট হয়ে আছে।


আরো সংবাদ



premium cement