১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রতিভার অন্বেষণে মুক্তবুলি

-

মেঘনার কলকল অনুরণন ও শঙ্খচিলের প্রসারিত ডানায় সুদূর প্রান্ত ছুঁয়ে যায় যেমন, তেমনি মুক্তবুলি নীরবে ছুঁয়ে গেছে পাঠক ও লেখকের কল্পিত মন। ততক্ষণে পৃথিবীও সূর্যকে ছয়বার প্রদক্ষিণ করেছে। বলছি মুক্তবুলি ম্যাগাজিনের সাত বছরে পদার্পণের কথা। ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু হলেও আমি মুক্তবুলির সংসারে যুক্ত হই ১৯ মে ২০২০ সালে ওয়েবসাইটে একটি সনেট লেখার মাধ্যমে। করোনাকালীন তখন প্রিন্ট ভার্সন তেমন বের হতো না। এখন অবশ্য দুটো মাধ্যমই বেশ সচল রয়েছে এবং আমিও স্বাচ্ছন্দ্যে নিয়মিত লিখছি।
মুক্তবুলিতে যুক্ত হওয়াটা বেশ কাকতালীয় ঘটনা। কারণ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক প্রিয় আযাদ আলাউদ্দীন একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আমার দেখা অন্যতম সেরা মানুষ। যিনি একাধারে সাংবাদিক, লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক, সংগঠক, উদ্যোক্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও লেখক গড়ার কারিগর। আমি তাকে দূর থেকে চিনতাম বহুদিন আগে থেকেই কিন্তু কখনো একান্তভাবে তার সাথে আলাপচারিতার সুযোগ হয়নি। আমি যেমন চাকরি করি একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে অনেকটা গৃহপালিত ময়নার মতো আর আযাদ ভাইয়ের কর্মক্ষেত্র অবারিত। আমার মন উড়াল দিলেও দেহ সব আকাশে উড়তে পারে না অমোঘ নিয়মে বন্দী। যাইহোক, মাঝে মধ্যে আমাদের অফিসের কিছু কাজ তার প্রতিষ্ঠান সাতরং সিস্টেমস থেকে করে থাকে সেই সুবাদে ফোনে আমার সাথে একদিন স্বল্পদৈর্ঘ্য কথোপকথন হয়। একপর্যায়ে আমি তাকে কাজের বাইরে ব্যক্তিগত আলাপে টেনে নিয়ে আমার লেখালেখির অভ্যাসের কথা ব্যক্ত করি। তখন তিনি আমাকে মুক্তবুলিতে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং ই-মেইল ঠিকানা দেন। সেই থেকে লিখছি। লেখা ছাপানোর পাশাপাশি লেখার নিয়ম পদ্ধতিসহ সময় সময় বিভিন্ন উপদেশ ও উৎসাহ দিয়ে আসছেন প্রিয় আযাদ ভাই। তিনি আমার কাব্যগ্রন্থ ‘কল্পিত নগরে’ এর একটি চমৎকার রিভিউ লিখেছেন জাতীয় দৈনিকে। এখন তাকে খুব কাছ থেকে দেখছি মুক্তবুলিকে নিয়ে তিনি অক্লান্ত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন পরম মমতায়।
আমার অবশ্য লেখালেখির অভ্যেস ছাত্রজীবন থেকেই ছিল। দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক সংস্কার’ ও ‘মাসিক মাদরাসা’ পত্রিকায় গল্প ও কবিতা ছাপা হয়েছিল। চাকরির পর দীর্ঘদিন লেখালেখি বন্ধ ছিল। মুক্তবুলির মাধ্যমে আবার শুরু করেছি এখন জাতীয় দৈনিকেও নিয়মিত বা অনিয়মিত লিখছি।
‘প্রতিভার অন্বেষণে মুক্তবুলি’ লেখার শিরোনাম দিয়ে নিজের তবলা অনেক বাজিয়ে ফেলছি এবার এ বিষয়ে আলোকপাত করা যাক, ম্যাগাজিনটির স্লোগান বেশ সুন্দর ও গভীর ‘পাঠক যারা, লেখক তারা।’ স্লোগান থেকে খুব সহজে অনুমেয় ম্যাগাজিনটির অন্য কোনো কমার্শিয়াল চিন্তা-ভাবনা নেই। এতে বুঝা যায় এর মহৎ উদ্দেশ্য হচ্ছে লেখক তৈরি এবং সবার মাঝে পাঠাভ্যাসের মন মানসিকতা জাগিয়ে তোলা।
ঠিক তাই, ম্যাগাজিনটিতে চোখ বুলালেই দেখতে পাই প্রতিটি সংখ্যায়ই নিয়মিত প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নতুন প্রতিভাবান লেখকদের লেখা। সাহিত্য চর্চার পরিসর দিন দিন কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। যুগ যতই ডিজিটাল হচ্ছে ততই বই ও পত্রপত্রিকা থেকে মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। এমনকি লেখকদের অনেকে পাঠ না করে লিখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পকেটের সামান্য টাকা খরচ করে কেউ বই ও পত্রিকা কিনতে চায় না। কারণ মুঠোফোনে আঙুল স্ক্রল করলেই ভেসে ওঠে বিনোদনমূলক যত আজেবাজে ভিডিও যা যুবসমাজকে সাময়িক আনন্দ দিলেও ভবিষ্যৎকে নিয়ে যাচ্ছে অতল অন্ধকারে।

সাহিত্য সমাজ ও সভ্যতার দর্পণ। একেবারেই যে সাহিত্য চর্চা হয় না তা আমি বলব না। বর্তমানে জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে সাহিত্য সাময়িকী বের হচ্ছে নিয়মিত। তবে এসব সাহিত্য সম্পাদকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। তারা তাদের নির্দিষ্ট লেখক বলয় থেকে বের হয়ে নতুন লেখক সৃষ্টির বিষয়ে উদাসীন। বড় বড় সাহিত্য পাতা ও ম্যাগাজিনে পরিচিত প্রতিষ্ঠিত লেখক ছাড়া নতুনদের ঠাঁই নেই। আবার সম্পাদকদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমরা মানসম্মত লেখা ছাপানোর জন্য মুখিয়ে আছি।’ এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আর বর্তমানে পত্রিকার সাহিত্য পাতার লেখার মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার যোগ্যতা আমার নেই, তবে মাঝে মধ্যে কবিতাগুলোর কবিদের নাম ঢেকে কবিতা পড়লে মনে হচ্ছে একই কবির লেখা সব কবিতা দু’চারজন ছাড়া। নিজস্ব কোনো স্টাইল খুঁজে বের করা দুষ্কর। কে যে কাকে অনুসরণ করে বুঝা মুশকিল। তবে ব্যতিক্রমও আছেন।
সেই ক্ষেত্রে মুক্তবুলি দেশের আনাচে-কানাচে প্রতিভাবান নতুন লেখকদের লেখা তার স্বল্প কলেবরে ঠাঁই দিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। এতে নতুন লেখকরা তাদের লেখা ঝকঝকে ছাপার হরফে দেখে তাদের মনও চকচকে এবং লিখতেও উৎসাহবোধ করে। ম্যাগাজিনে বা যেকোনো পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা হলে নবীন লেখকদের মনের মধ্যে যে কিরকম খুশির বুদবুদ ওঠে তা তারাই ভালো জানেন। শরীরে কেমন যেন সাহিত্য সাহিত্য ভাবসাব আসে।
নবীন লেখকদের লেখা যদি কোথাও ছাপা না হয় তাহলে অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণও হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে যায় গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা এবং মান্না দের সেই বিখ্যাত গানের কথা-
‘কবি কবি চেহারা, কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ
মুছে যাবে অমলের নামটা,
একটা কবিতা তার হলো না কোথাও ছাপা
পেল না সে প্রতিভার দামটা।’
এভাবে আশার ডানা মেলতে পারি যে, কিছু নবীন লেখক উঠে আসুক ভিন্ন স্বাদের লেখা নিয়ে। যাদের লেখায় থাকবে নিজস্ব জগৎ। তবে জানা ও বোঝার জন্য পড়তে হবে সবাইকে কারো স্টাইল নকল করা যাবে না।
মুক্তবুলির কী সীমাবদ্ধতা নেই? হ্যাঁ, সবকিছুরই একটি নির্দিষ্ট সীমা পরিসীমা রয়েছে। বলাবাহুল্য দিন দিন ম্যাগাজিনটি জনপ্রিয়তা পাওয়ায় যেমন পাঠক বেড়েছে তেমন লেখকের সংখ্যাও বেড়েছে। তাই হয়তো সবার লেখা একসাথে ছাপানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ আমাদের আবেগ অসীম কিন্তু প্রকাশের জমিন খুব ছোট। তবে মানসম্মত লেখা হলে এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সহজ। মানুষ সুন্দরের পূজারি। সুন্দর ও ব্যতিক্রমী যা মনকে আকৃষ্ট করে তাই সবাই গ্রহণ করে। মুক্তবুলিও নাম এবং মুখ দেখে নয়, মানসম্মত লেখাটা ছাপানোর জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সেটা যেকোনো লেখকই হতে পারে।
বাতির নিচে অন্ধকার বলে একটা কথা আছে। মুক্তবুলি তার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার নিচে কিছুটা অন্ধকার লুকোচুরি করছে তা কি আমরা দূর থেকে অনুমান করি? আমি আগেই বলেছি ম্যাগাজিনটির কোনো কমার্শিয়াল উদ্দেশ্য নেই তবুও এর পিছনে কিছু অর্থনৈতিক বিষয় রয়েছে। ম্যাগাজিনটি ছাপাখানা থেকে ঝকঝকে প্রচ্ছদে পাঠকের হাতে পৌঁছাতে প্রতিবারে বেশ খরচ হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত বিজ্ঞাপন না পাওয়ায় সম্পাদক অনেকটা নিজের থেকেই বহন করেন।
এভাবে একা কতদিন টেনে নেয়া যায়। আমাদের সবারইতো সংসার রয়েছে, সম্পাদকও তার ব্যতিক্রম নন। এভাবে অনেক ম্যাগাজিন চাঁদ হয়ে আসে আবার এরকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অমাবস্যায় হারিয়ে যায়। আমরা চাই মুক্তবুলি টিকে থাকুক হাজার বছর। যেহেতু ‘পাঠক যারা, লেখক তারা’ তাই আমরাই এটিকে টিকিয়ে রাখতে এগিয়ে আসতে পারি। সেটা হতে পারে বিজ্ঞাপন সংগ্রহের মাধ্যমে অথবা পর্যাপ্ত খরিদ করে। কিছু লেখক মনে করেন আমি লিখছি সৌজন্য কপি তো পাবো, আমি বলব সৌজন্য কপির পাশাপাশি আরো কপি সংগ্রহ করে বন্ধুবান্ধবসহ অনেকের কাছে এটিকে পৌঁছে দিয়ে টিকিয়ে রাখার ভিত মজবুত করা উচিত।


আরো সংবাদ



premium cement