১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

কবিতায় মায়াবী শরৎ

-

বর্ষার অবিরাম বর্ষণের পর প্রকৃতি নিজেকে ধুয়েমুছে নতুনরূপে উপস্থাপন করে তোলে শরতের মাধ্যমে। আষাঢ় শ্রাবণের অবিরত মেঘ বৃষ্টি যখন প্রকৃতিকে একগুঁয়ে করে তোলে ঠিক তখনই শুভ্রতার রূপ আবেশে আগমন ঘটে ঋতরানী শরতের। বাংলার প্রকৃতিতে শরত আসে নানা মাত্রিকরূপে। এ সময় আকাশ যেমন থাকে সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত ঠিক শুভ্র প্রকৃতিও সেজে উঠে আপন রূপ মহিমায়। প্রকৃতি পড়ন্ত বিকেলে আকাশের শুভ্র মেঘমালাকে নানান রূপচিত্রে উপস্থাপন করে তোলে। পড়ন্ত বিকেলের আকাশে ঘন ঘন রঙধনু উঠে। মেঘমালাকে বিশাল বিশাল পাহাড়ের মতোসহ নানান আকৃতিতে দেখা যায়। এই রূপ প্রকৃতি কবিদের ভাবুক মনকে নতুনভাবে উদ্বেলিত করে তোলে। বাংলা সাহিত্যের সমকালীন কবি সাহিত্যিকরা এই শরতের প্রেমে পড়ে সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন ছন্দ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো কবি নেই যিনি প্রকৃতির রূপ চিত্রকে কল্পনার পরশে ছন্দ তুলিতে আঁকেননি। শরতের রূপ চিত্রে অঙ্কিত হয়েছে হাজার হাজার ছন্দ কবিতা। যে ছন্দ কবিতা বাংলা কাব্য সাহিত্যকে সত্যিকার অর্থে সমৃদ্ধ করে তুলছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অসংখ্য কবিতা ছড়া গানে বাংলার রূপ বৈচিত্র্য তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নিপুণতার সাথে। যা পাঠক মনে ভাবাবেগ জাগিয়ে তুলে যুগ যুগ ধরে। তিনি শরতকে ছন্দে গাঁথেন ঠিক এভাবে-

‘শরৎ তোমার অরূণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির ধোয়া কুন্তলে
বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’
শরতের মেঘমুক্ত আকাশ, ধানক্ষেত, বিশাল আকাশে শাদা মেঘের আনাগোনার চিত্রকল্প এঁকেছেন ঠিক এভাবে-
‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।’
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বরাবরই আশাজাগানিয়া বিদ্রোহমূলক কবিতায় মজে থাকলেও তিনি প্রেম-বিরহ প্রকৃতির রূপ চিত্রও সমভাবে তুলে ধরেছেন তার অমর সৃষ্টি গান কবিতায়। কবি শরতের রূপ কল্পনার মাধুরিতে ফুটিয়ে তোলেন এক অন্যন্য উপস্থাপনায়। তার বিখ্যাত কবিতা ‘রাখি বন্ধন’-এ শরতের রূপচিত্র এঁকেছেন ঠিক এভাবে-
‘সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরনী!
অলাকার পানে বলাকা ছুটেছে মেঘদূত মন মোহিয়া
চক্ষু রাঙা কলমীর কুড়ি মরতের ভেট বহিয়া।
সখির গাঁয়ের সেঁউতি বোটার ফিরোজায় ঢঙ পেশোয়াজ
আসমানী আর মৃন্ময়ী সখি মিশিয়াছে, মেঠোপথ মাঝ।’
কবি আবার শরতের রূপ লাবণ্যময় দৃশ্যের অবতারণা করেন তার অমর গান ‘শিউলি ফুলের মালা’ ‘দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ’ ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’ গানে। এসো শারদ প্রাতের পথিক গানের চিত্রকল্প এঁকেছেন এভাবে-
‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে/ এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ কিরণ রথে/ দলি শাপলা শালুক শতদল এসো রাঙায়ে তোমার পদতল/ নীল লাল ঝরায়ে ঢলঢল এসো অরণ্য পর্বতে।’
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাস তার কবিতায় বাংলার চিরায়ত রূপ সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন নানান ছন্দ উপমায়। শরতের রূপ সৌন্দর্যের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে কবি লিখেছেন-

‘এখানে আকাশ নীল,
নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম সাদা রঙ আশ্বিনের আলোর মতোন;
আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল
এইখানে করে গুন্জরণ।’
পল্লী কবি জসিম উদ্দীন বাংলার গাঁও গেরামের মোহনীয় রূপ ছবি এঁকেছেন তার কল্পনার ছন্দ শিল্প মাধুরিতে। রূপের রানী শরতকে নিয়ে তিনি লিখেছেন অনবদ্য এই কবিতা-
‘গুনিতে গুনিতে শ্রাবণ কাটিল/আসিল ভাদ্র মাস/বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস/আজকে আসিবে কালকে আসিবে/ হায় নিদারুণ আশা/ ভোরের পাখির মতোন শুধুই ভোরে ছেয়ে যায় বাসা।’
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ ঋতুরানী শরতকে এঁকেছেন তার কল্প মাধুরিতে ঠিক এ ভাবে-
‘ঋতুর অতীত আমি/ কে জিজ্ঞাসে এটা কোন মাস?/বাতাসে গড়িয়ে পড়ে বিদায়ের বিষণœ নির্যাস/শ্রবণেরও শক্তি নেই/কিন্তু ভাবি কোলাহল আছে প্রতিটা বাড়ির রন্ধ্রে/ ইটে ইটে আনাচে-কানাচে!/ এটা কি শরৎ সন্ধ্যা?/ বাংলাদেশ?/কাশফুল ছেয়ে গেছে চর?’
তিতাস কবিতায় কবি শরতকে এভাবে চিত্রিত করেছেন-

‘কিছুই খুঁজিনি আমি যতবার এসেছি এ তীরে
নীরব তৃপ্তির জন্য আনমনে বসে থেকে ঘাসে
নির্মল বাতাস টেনে বহুক্ষণ ভরেছি এ বুক।
একটি কাশের ফুল তারপর আঙুলে আমার
ছিঁড়ে নিয়ে এই পথে হেঁটে চলে গেছি। শহরের
শেষপ্রান্তে যেখানে আমার ঘর, নরম বিছানা
সেখানে রেখেছি দেহ।’
বাংলা কবিতার অন্যতম পুরোধা কবি ফররুখ আহমেদ তার বিখ্যাত ছড়ায় শরতের রূপকল্প আঁকেন ভিন্ন উপমা ভঙিতে। যা আমাদের ছোট বড় সবার মুখে মুখে সুখপাঠ্য-
‘বৃষ্টি এলো কাশবনে/জাগলো সাড়া ঘাসবনে/ বকের সারি কোথায় রে/ লুকিয়ে গেল বাঁশবনে।’
কবি সৈয়দ শামসুল হক তার কবিতায় রূপের রানী শরতের দৃশ্যপট এঁকেছেন এভাবে-
‘সে কী বিস্ময়! কী যে বিস্ময়! কী করে ভুলি/
আকাশের নীল ঘন শাদা মেঘ, কবেকার গ্রাম পথে ডুলি।’
কবি শামসুর রাহমান শরৎ নিয়ে তার কবিতায় লিখেন- ‘জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে/নিমিষে শরতের খুশির জ্যোতিকনা’
কবি আসাদ চৌধুরী শরতকে তুলে ধরেছেন ভিন্ন উপমায়, শরত বন্দনায় লিখেছেন-
‘শাদা কাগজের ওপর রেগে যাই, সাড়ে চুয়াত্তরে এসে, বাক্যালাপে মেতে ওঠে, অসমাপ্ত পদ্যগুলো, স্মৃতিরাশি শাদা মেঘমালার চেয়েও, অধিক এলোমেলো।’
বর্তমান সময়ের শক্তিমান কবি জাকির আবু জাফর বাংলার রূপ সৌন্দর্যকে মনের মাধুরি মিশিয়ে তুলে আনেন তার অসংখ্য ছড়া গান কবিতায়। দেশের মোহমায়া প্রকৃতি, দেশ প্রেম, জাগানিয়া তার কবিতা গানের প্রধান উদ্দীপক বলা যায়। তিনি শরত বন্দনায় ‘শরৎ পাখি’ কবিতায় লিখেছেন-

‘শরৎ জোছনা যখন আমার হৃদয় ধুয়ে রাখে
প্রেমের তশতরিতে
তখন শরৎ পাখির কণ্ঠে শুনি নিশি রহস্যের সুর
যে সুরে বাজতে থাকে সুধাকান্ত ঘুমহীন মনের বেদন
তখনও দেখি জোছনা জ্বলতে জ্বলতে পৃথিবীর বুকের উপর
শুয়ে থাকা রাতকে স্বচ্ছতায় ভাসিয়ে দিতে
তখনও শিউলির গন্ধ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে পৃথিবীর বাতাসেরা
এভাবে আমার বুকের ভেতর ডানা ঝাপটায়
সুখ দুঃখের শরৎ পাখি
এভাবেই পাখিগুলো গেয়ে যায় শরৎ সুখের গান।’
কবি হাসান হাফিজ শরতে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন-
‘শরতে জন্মেছি, তাই শরতেই হোক ছুটি
আলগোছে নিভৃতে প্রস্থান। শরৎ মানব
মনে সঞ্চারিত করো তুমি কিঞ্চিত দয়া ও
ধর্ম, পয়দা করো হৃদয়ে রহম তারা যেন
ভালোবাসে নিষ্কলঙ্ক শিউলি ফুল, সামান্য দরদি
হয়। মানবিক হয়। শরৎ হে প্রিয় বাঞ্ছিতা ঋতু
সামান্য কবির এই অনুল্লেখ্য গরিবি আরজ;
অবহেলে দিয়ো না দোয়া না ফেলে, করুণাবশত
করো প্রীতি বিবেচনা।’
কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা তার ডাহুকের বুক কবিতায় লিখেছেন-
‘শরতেও ঘুরছে ডাহুক
শরতেও উড়ছে ডাহুক
ঋতুর বদল হয়
বদল হয় না শুধু
ডাহুকের বুক।’
শরতের অপার নান্দনিক রূপের মোহনীয় সৌন্দর্য, স্নিগ্ধ প্রভাতের মৃদু সমীরণ আবেশ, রাতের চাঁদ জোছনা আর জোনাক দলের লুকোচুরি খেলা, নদী তীরে কাশফুলের মন মাতানো দোল, পড়ন্ত বিকেলে বিহঙ্গের ডানা ঝাঁপটিয়ে ওড়া, দিনমান আকাশের বুকে শুভ্র মেঘের আনাগোনা কাব্যিক মনে ভাবাবেগ তুলেছে যুগ যুগান্তরে। এই অপরূপ সৌন্দর্যকে পুঁজি করে সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবিরা এঁকেছেন তাদের কালজয়ী ছন্দ। শরত ছন্দে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের আধুনিক বাংলা সাহিত্য।


আরো সংবাদ



premium cement
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেফতার সোনারগাঁয়ে শেখ হাসিনা-শেখ রেহেনাসহ ২৩৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা গাজার চলমান ঘটনাবলী সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভুল : বসনিয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে ভারতের আসাম-মেঘালয় সীমান্তে আটক ৬৫ বাংলাদেশী ঐক্যের মাধ্যমেই কেবল মুসলিম উম্মাহ'র মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হোসেনপুরে স্কুলশিক্ষকের বসতঘর পুড়ে ছাই রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টির আভাস 'শ্রম আইন সংস্কার করে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে' সিংগাইরে ধলেশ্বরী নদী থেকে লাশ উদ্ধার সাতক্ষীরায় বজ্রপাতে মৎস্যচাষির মৃত্যু সাংবাদিক শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল বাবুর ওপর ডিম নিক্ষেপ

সকল