০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

নজরুল সাহিত্যে বিদেশী শব্দ

-

বাংলা সাহিত্যে ধূমকেতুর মতো যার আবির্ভাব, তিনিই হলেন আমাদের জাতিসত্তার প্রধানতম কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ধূমকেতুর সাথে তুলনাটি মোটেই অমূলক নয়। যখন তাঁর লেখালেখির জীবন সবেমাত্র যৌবন ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছে, তখন তিনি লেখার ক্ষমতা হারালেন, বাকশক্তি হারালেন। ভাগ্যের এই নিষ্ঠুর পরিহাসে ধূমকেতুর মতো আলো জ্বেলে সহসাই সাহিত্য অঙ্গন থেকে বিদায় নেন। আমরা তথা গোটা বাংলা সাহিত্য বঞ্চিত হলাম ধারালো তলোয়ারের মতো ক্ষুরধার লেখনী থেকে। সাহিত্যপ্রেমী সব মানুষ তখন শোকে কাতর, মুহ্যমান। হয়তো নজরুল সারাজীবন লিখতে পারলে বাংলা সাহিত্য রবি ঠাকুরের পর আরো একটি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির গৌরব করতে পারত, অহঙ্কার করতে পারত। নজরুল কে ছিলেন, আসুন আমরা তার নিজের মুখেই শুনি- ১৯২৭ সালে এক সাহিত্য সভায় তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভণ্ডামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।’
যেকোনো ভাষাতেই অন্য ভাষার শব্দ আত্তীকরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ঔপনিবেশিক কিংবা অন্য কোনো কারণে এই আত্তীকরণের ঘটনা ঘটে যাকে। তবে আত্তীকরণের এই প্রভাব সব কবি, সাহিত্যিকের বেলায় সমান নয়। কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রভাব কম আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রভাব বেশি। সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে যার লেখায় বিদেশী শব্দের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি তিনিই হলেন আমাদের প্রাণের কবি, বিদ্রোহী কবি, দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুল অভিধান শব্দসূত্রে জানা যায়, মুসলিম সংস্কৃতির মন, মনন ও চিন্তনের দিকেই শুধু নয়, হিন্দু সংস্কৃতির গভীর থেকে গভীরতর এবং বাঙালি সংস্কৃতির দ্যোতনার দিকেও সবাইকে যিনি উদ্বুুদ্ধ করেছিলেন, তিনিই আমাদের প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দেশী-বিদেশী শব্দের নিত্যনতুন বাহারে কিংবা যথার্থ ব্যবহার দিয়ে তিনি সব শ্রেণীর পাঠককে বেঁধে রেখেছেন। কখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়েছেন আবার কখনো মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
তাঁর সাহিত্যকর্মে আরবি-ফারসি শব্দের বেশ ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। যদিও কবি নজরুলের আগেও অনেক কবি এবং লেখক আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তবে তা ছিল নিতান্তই সীমিত, সীমিত মাত্রায়। এখানেই নজরুল সত্তার স্বাতন্ত্র্য। তিনি পদ্য, গদ্য, কিংবা গান সব ক্ষেত্রেই বিদেশী শব্দের ব্যবহার করেছেন অন্যদের তুলনায় ঢের বেশি। তবে কেবল আরবি-ফারসিই নয়, তিনি উর্দু ও হিন্দি শব্দের ব্যবহারও করেছেন সমানতালে। যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- তার ব্যবহৃত এসব শব্দের অধিকাংশই এখন বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। আবার কিছু শব্দ আছে কোনোভাবেই বাংলার সাথে তাল মেলাতে না পেরে অব্যবহৃতই থেকে গেছে।
এ বিষয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, “নজরুল মোল্লা-মৌলবীদের মতো ভালো আরবি-ফারসি না জানলেও কাব্যের রস আস্বাদন করতে পেরেছিলেন। তার ব্যবহৃত অনেক শব্দই বাংলা ভাষায় জুৎসইভাবে ঠাঁই নিয়েছে। আবার কিছু আরবি-ফারসি শব্দ সুকৌশলে ব্যবহার করলেও তা বাংলা হয়ে উঠেনি; বরং আরবি-ফারসিই রয়ে গেছে। ‘হিম্মত, জাহান্নাম, ঈমান, জানাজা, আসমান, ইনসান, আহাদ, মুর্দা- ইত্যাদি নজরুল ব্যবহৃত শব্দ এখন পুরোদস্তুর বাংলা। অবশ্য বাংলার বাগ্বিধিকে নজরুল উপেক্ষা করেননি; বরং সুসামঞ্জস্যভাবে আরবি-ফারসি শব্দের বিন্যাস ঘটিয়েছেন। তাই লিখেছেন, ‘নীলিম প্রিয়ার নীলা গুলরুখ লাজুক নেকাবে ঢাকা’, ‘ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ।”
তবে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে অধিক সংখ্যক আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও কম হয়নি। বাংলা সাহিত্যে চলিত রীতির প্রথম সার্থক রূপকার প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষার জাতপাত সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্য থেকে আরবি-ফারসি শব্দ বহিষ্কৃত করতে সেই জাতীয় সাহিত্যিকই উৎসুক যারা বাংলা ভাষা জানেন না।’ অবশ্য প্রখ্যাত সাহিত্যিক দীনেশচন্দ্র সেন এ বিষয়টি গভীরভাবে অনুধ্যান করে বলেছিলেন, ‘গত পাঁচ, ছয়শত বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষাটা হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের হইয়া গিয়াছে। মুসলমানের ধর্মশাস্ত্র ও সামাজিক আদর্শ অনেকটা আরবি ও ফারসি সাহিত্যে লিপিবদ্ধ। সেই সাহিত্যের জ্ঞান তাহাদের নিত্যকর্মের জন্য অপরিহার্য। আমাদের যেমন সংস্কৃতের সহিত সম্বন্ধ আছে, আরবি ও ফারসির সঙ্গে তাহাদের কতকটা তাই।’ দীনেশ চন্দ্রের এই উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আমি মনে করি, তিনি যথার্থ বলেছেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজেও নজরুল সাহিত্যে বিদেশী শব্দের ব্যবহার নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আরবি ও ফারসি শব্দসমূহে মুসলমানদের ধর্মীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিশ্বাসের সাথে গভীর ঐতিহাসিক ও সমন্বয়ের সূত্রটি কাজী নজরুলের ভেতরে ভেতরে কাজ করেছে। অবশ্য এখানেই নজরুলের বিশেষত্ব। কেননা তিনি একাধারে নিজ ধর্মবিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক চেতনা যেভাবে অন্তরে লালন করেছেন, তেমনিভাবেই তিনি নিজধর্মের বাইরে অন্যান্য সব ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। নিজের ধর্মের গণ্ডির বাইরে এসে অন্য ধর্মের প্রতি নজরুলের এই যে অসাধারণ উদার মানসিকতা এতটা প্রবলভাবে অন্য কোনো কবি-সাহিত্যিকের মধ্যে পাওয়া যায় না। এমনকি রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও না। নজরুল একাধারে বহুভাষাবিদ, গবেষক ও পণ্ডিতের মতো একদিকে যেমন সংস্কৃত ছন্দ অধ্যয়ন করেছিলেন, তেমনি আরবি-ফারসি ভাষা থেকেও প্রচুর শব্দ ছন্দ ও সুর আনয়ন করে বাংলা কাব্য ও সাহিত্যকে মুসলিম ঢঙে সাজাবার প্রয়াসী হয়েছিলেন। এসব বিদেশী শব্দের ব্যবহার কোনোক্রমেই অপপ্রয়োগ নয়; বরং যথার্থ ও মানানসই প্রয়োগ। কারণ ভাষা কোনো স্থিতিশীল বিষয় নয়। কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভাষার পরিবর্তন, বিবর্তন, সংযোজন এবং বিয়োজন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বই অন্য কিছু নয়।
‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক ওয়ার্ডসওয়ার্থ সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেন, ‘কোনো একটি ভাষায় অন্যভাষার শব্দ প্রবেশ করবে কিনা; তা লেখকের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। যে সাহিত্যিকরা অন্যভাষার শব্দ চয়ন করে নিজের ভাষার মধ্যে মিলিয়ে দিতে পারবেন তিনি তত বড় শক্তিশালী সাহিত্যিক।’ সত্যিকার অর্থেও তাই। কিছু সমালোচক সমালোচনা করলেও আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, নজরুল সাহিত্যে বিদেশী শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement
এ সরকার জনপ্রত্যাশার কী করবে? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন : তাজুল ইসলাম চিফ প্রসিকিউটর আবুধাবির কারাগার থেকে দেশে ফিরেছেন ১৪ বীর কোনাবাড়ীতে কলেজছাত্রকে গুলি করে হত্যা : কনস্টেবল গ্রেফতার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্তগুলো যৌক্তিক : ফখরুল ‘একটি চক্র জামায়াত আমিরের বক্তব্য নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে’ অস্ত্র জমা দেয়নি শামীম ওসমান ও গাজী পরিবার এবি পার্টির উপদেষ্টার পদ ছাড়লেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক কর্মকর্তাদের তালিকা চাওয়া নিয়ে বিতর্কে মন্ত্রণালয়ের দুঃখ প্রকাশ আশুলিয়ায় শ্রমিক দলের সমাবেশে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ৫ রূপগঞ্জে পরকীয়া সন্দেহে স্ত্রীকে হত্যা

সকল