১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
ব ই আ লো চ না

ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেমের গবেষণাগ্রন্থ, উপন্যাস-সাহিত্যের এক আকর-দর্পণ

-

ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেম। একজন সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্প-সাহিত্য গবেষকের নাম। উচ্চশিক্ষা অর্জনের উজ্জ্বলতম দিনগুলো এই চট্টগ্রামেই কাটিয়েছেন। এখন কর্মসূত্রে আমেরিকা প্রবাসী। ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেমের একাডেমিক অধ্যয়ন সাহিত্য নিয়ে নয়। তার লেখাপড়া সমাজতত্ত্ব নিয়ে। কিন্তু শিল্প সাহিত্য নিয়ে তার কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণামূলক কাজ সাহিত্যের পণ্ডিতদের নজর কেড়েছে। বিশেষভাবে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশ^ায়ন’ (২০১০), এবং ‘আধুনিক বাংলা নাটকের ইতিবৃত্ত ও সমাজচিত্র’ (২০১৬) এই গ্রন্থ দু’টি বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য শিক্ষকদের প্রশংসাধন্য হয়েছে।
আমার আলোচ্য গ্রন্থ হলো গত বছর প্রকাশিত হওয়া বাংলা উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি : শিল্প অম্বেষা (১৮০০-২০২০); ৪১৫ পৃষ্ঠার বিশাল কলেবরের এই গ্রন্থটি আদ্যোপান্ত পড়ে আমার বোধের জগৎ এই উপলব্ধি নিশ্চিত করেছে, এটি একটি শ্রমনিষ্ঠ গবেষণা। বাংলা ভাষায় উপন্যাস হলো সাহিত্যের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় শাখা। উপন্যাস-পাঠকের পরিসংখ্যান নিয়ে তার প্রমাণ সুস্পষ্ট হবে। বাংলা উপন্যাস নিয়ে গবেষকরাও প্রচুর কাজ করেছেন। বিশেষভাবে উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কাজ হলেও উপন্যাসের নন্দন, শিল্পগুণ মনস্তত্ত্ব নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। তবে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং উপন্যাস-সাহিত্যের খ্যাতিমান গবেষক গিয়াস শামীমের ‘উপন্যাসের শিল্পস্বর’ গ্রন্থটির কথা অত্যন্ত স্বস্তির সাথে উল্লেখ করতে হয়। বাংলাদেশের উপন্যাসের প্রকরণশৈলী ও শৈল্পিকতা অনুসন্ধানে এটি একটি দারুণ কাজ। যাই হোক, আলোচ্য গ্রন্থ ড. কাসেমের গবেষণা প্রসঙ্গে আসি। ২২০ বছরের বাংলা উপন্যাসের গতি প্রকৃতির বয়ান করাটা যতটা না কঠিন তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন শিল্প অন্বেষার কাজটি। এই কঠিন কাজটিও ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেম নিষ্ঠার সাথে করেছেন।
এই গ্রন্থটিতে গবেষক ড. কাসেমের বিশ^সাহিত্যকে সামনে রেখে বিশ^বরেণ্য ঔপন্যাসিকদের পরিচিতিসহ উপন্যাসের উন্মেষকাল ও বিকাশ নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোকপাত করেছেন। বাংলা উপন্যাসের ২২০ বছরের যে চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন তাতে এই গ্রন্থটিকে নিঃসন্দেহে বাংলা উপন্যাসের সমৃদ্ধ দলিল বলা যায়। গবেষণা গ্রন্থটিকে লেখক চারটি অধ্যায়ে সাজিয়েছেন। প্রথম অধ্যায় হলো- ‘উপন্যাসের শিল্প কথা’ দ্বিতীয় অধ্যায়- ‘আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত’ তৃতীয় অধ্যায় হলো- ‘উপন্যাসের মূল্যায়ন’ (প্রাথমিক ও আধুনিক পর্ব) । চতুর্থ অধ্যায় হলো- বাংলা ভাষার অনূদিত উপন্যাস। প্রথম অধ্যায়ে ‘উপন্যাসের শিল্পকথা পর্বটি আরো বর্ধিত কলেবরের হওয়াটা প্রত্যাশিত ছিল। বাংলা উপন্যাসের বিভূতি, সরদার জয়েন উদ্দীন, মাহমুদুল হক, শহীদুল জহীর ও শাহাদুজ্জামানের উপন্যাসের শিল্পকথা আরো বেশি বর্ণিত হলে এই অধ্যায়টির কলেবর বাড়ত। গ্রন্থের ‘শিল্প অন্বেষা’ শব্দবন্ধের প্রতিও সুবিচার হতো।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপন্যাসের একটি অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে গিয়ে ঘটনাপুঞ্জের ঐতিহাসিক ধারাক্রম নিখুঁতভাবে রক্ষা করেছেন লেখক। এই অধ্যায়ে গবেষক বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অর্জনের পরম্পরা বর্ণনায় স্বপ্নভঙ্গের কথকতাও উল্লেখ করেছেন। যা একজন গবেষকের নির্মোহ ও নিরপেক্ষ থাকার পরিচয় বহন করে। তৃতীয় অধ্যায়ে গবেষক ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেম প্রাথমিক ও আধুনিক শিরোনামের দু’টি পর্বে উপন্যাসের বিশদ মূল্যায়ন করেছেন। এই অধ্যায়টিই এই গবেষণা গ্রন্থের সবচেয়ে বর্ধিত কলেবরের বৃহৎ অধ্যায়। ৪১৫ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থের তিন শতাধিক পৃষ্ঠা লেগেছে এই অধ্যায়ের জন্য। গবেষক অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এই অধ্যায়ে বাংলা উপন্যাসের ২২০ বছরের গতি প্রকৃতির বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। যা একটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। এই অধ্যায়টির জন্য এই গ্রন্থটি বাংলা উপন্যাসের একটি আকর-দর্পণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই অধ্যায়টি অনুপুঙ্খ পড়ে একজন সিরিয়াস পাঠক কিংবা গবেষক এটি নিশ্চিত হবেন, এই তৃতীয় অধ্যায় ড. কাসেমের নিবিড়ভাবে গবেষণালব্ধ এবং বাংলা উপন্যাসের গতিপ্রকৃতির প্রাজ্ঞ আলোচনায় সমৃদ্ধ। এই গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়টি হলো- বাংলা ভাষায় অনূদিত উপন্যাস নিয়ে। এটি এই গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই অধ্যায়টিও বর্ধিত কলেবরের হলে ভালো হতো। সংক্ষিপ্ত কলেবরের হলেও এই অধ্যায়ে ফখরুজ্জামান চৌধুরী ও আবেদীন কাদেরের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়াটা প্রত্যাশিত ছিল। কারণ এই দু’জন মেধাবী লেখক বিশ^সাহিত্যের বেশ ক’টি কালজয়ী উপন্যাস বাংলা ভাষার অনুবাদ করেছেন।

পাঁচজন গবেষক ও শিক্ষক গ্রন্থটি সম্পাদনার কাজ করেছেন। তাঁরা হলেন- ড. তসিকুল ইসলাম রাজা, প্রফেসর ড. মতিউর রহমান, প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ, ড. মোমেনুর রসুল ও ড. ইয়াহইয়া মান্নান। এই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন তার প্রাঞ্জল ভাষায় সুলিখিত এই মুখবন্ধে তার দারুণ ঔদার্য দিয়ে গবেষক ড. কাসেমকে তার কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন। গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায় রচনায় ড. কাসেমের অনুসন্ধিৎসু গবেষণার প্রশংসা করতে ড. নূরুল আমিন একটুও কার্পণ্য করেননি।
‘বাংলা উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি :শিল্প অন্বেষা’ গ্রন্থটি গবেষক ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেমের মেধা ও কায়িক শ্রমের এক অনবদ্য সৃজনকর্ম। তার এই গবেষণা গ্রন্থের প্রতিটি পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় তার ব্যাপক অধ্যয়নের প্রমাণ মেলে। বিশেষ করে শব্দচয়নে ও বাক্যবুননে ড. কাসেম আধুনিক মনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘হাসান আজিজুল হক : রাঢ় বঙ্গের উত্তরাধিকার’ গ্রন্থখ্যাত লেখক, বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. মহীবুল আজিজ লিখেছেন, ‘উপন্যাস শিল্পের চমৎকার তথ্য এবং বাংলা উপন্যাসের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র ড. কাসেমের গ্রন্থে উপস্থিত।’ দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান ২০১২ সালে প্রকাশিত ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেমের ‘আধুনিক বাংলা নাটকের ইতিবৃত্ত ও সমাজচিত্র’ গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আশা করি সাহিত্যের গবেষণায় তার অখণ্ড মনোযোগ অব্যাহত থাকবে।’ বাংলা সাহিত্যের এই পণ্ডিত ব্যক্তিত্বের দূরদর্শী মন্তব্য ও আশাবাদ বিফলে যায়নি। ড. কাসেম তার দারুণ সব সৃজনকর্মের ধারাবাহিকতায় বাংলা উপন্যাসের এমন একটি মূল্যবান কাজ উপহার দিলেন, যা উপন্যাস সাহিত্যের এক আকর-দর্পণ হিসেবে মূল্যায়িত হবে।
বাংলা উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি : শিল্প অন্বেষা (১৮০০-২০২০)
বইটি প্রকাশ করেছে- গ্রন্থরাজ্য, ঢাকা, প্রকাশকাল : ৩০ জুন ২০২৩, প্রচ্ছদ : ইকবাল করিম রিপন, ৪১৫ পৃষ্ঠা, মূল্য : ৭৫০ টাকা


আরো সংবাদ



premium cement