০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

আল মাহমুদের কবিতার গল্প

জন্ম : ১১ জুলাই ১৯৩৬, মৃত্যু : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ -

সাধারণত কবিতাযাত্রায় কবির চিন্তা আর সৃষ্টিশীলতার নতুন কিছু লক্ষ করলে পাঠক-সমালোচকগণ বলে ওঠেন কবি এখানে এসে বাঁক নিয়েছেন। সেই বাঁক কোন দিকে নিয়েছেন, সে-কথা না বলা হলেও, আমরা ধরে নিই যে বাঁকটি উত্তর দিকেই নিয়েছেন। এই উত্তর হচ্ছে অগ্রসরতার, উত্তরণের চিহ্ন। প্রাগ্রসরতারও সে ভূমিপুত্র, হতে পারে।
লোক লোকান্তর, কালের কলস আর সোনালি কাবিনে আল মাহমুদ তর্কময় অ্যালিগরির আশ্রয় নিয়েছেন, প্রতীকী ব্যঞ্জনায় তার কবিতার জমিনে চাষ দিয়েছেন, ফলিয়েছেন এমন কিছু রহস্যময় ও লোকজসত্তার মানবিক ফসল, যা আমাদের মুগ্ধ করে। যে ভাষা ও তার ব্যবহার ভঙ্গি তিনি উন্মোচন করেছিলেন ওই তিনটি কাব্যগ্রন্থে, সেই প্রবহমান অক্ষরবৃত্তই তার পরবর্তী কবিতার প্রধান বাহন হয়েছে। কবিতায় যেসব চিত্রকল্প, উপমা তিনি ওই তিন বইয়ে ব্যবহার করেছেন তার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত আমাদেরই লোকসমাজজাত, লোকজপরিবেশ থেকে আহৃত ও তার বর্ণনার কৌশলটি অনেকটাই গল্পের ছাঁদে লেখা। আল মাহমুদের স্বভাবটিই এমনধারার। ফলে আমরা যখন তাঁর বাঁক খুঁজছি, দেখতে পেলাম মায়াবী পর্দা দুলে ওঠোতে তিনি আরো গহন ও রহস্যময় গল্প বলছেন। আধুনিক বাংলা কবিতায় যে রূপ আর ঐশ্বর্য়ের আকাশ আমরা আবিষ্কার করেছি এবং তার গুণপনায় মুখর হয়েছি, তিন, চার-এর দশক পেরিয়ে এসে পাঁচের দশকের কবিতায় সেই সংহত কবিতা-রূপ যেন কিছুটা ঢিলে হয়ে এলো। কবি যখন মিথ চরিত্র ব্যবহার করেন, তখন তা মিথিক্যাল প্রতীক হয়ে ওঠে। কারণ মিথিক চরিত্রের নামটি ধারণ করে থাকে বিশাল এক কাহিনী। সেই কাহিনীর আপাদমস্তক না হলেও, যৎকিঞ্চিৎও প্রতীকী সুষমা ধারণ করে কবিতার অন্তরাত্মায় নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। সেটা আমরা লক্ষ করেছি শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দিনসহ তাদের সমকালীন কবিদের কবিতায়। আল মাহমুদের কবিতায়ও সেই রহস্যময় মিথিক্যাল পরিপ্রেক্ষিত দেখেছি, তবে সংখ্যায় কি কম? এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। তবে, কবিতায় গল্পের রেওয়াজ কিন্তু বহু পুরোনো। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় গল্প ও গল্পের অনেক উপাদান-উপকরণ আছে। আছে নজরুলের কবিতায়ও, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের, জসীমউদদীনের কবিতাও বাংলাদেশের লোকজ পরিসরের গল্পকেন্দ্রিক উপাদানে ঠাসা। এবং পশ্চিমা দৃষ্টিস্নাত বাংলার আধুনিক কবিখ্যাত পঞ্চপাণ্ডবের কবিতায়ও রয়েছে সেই গল্পের ইমেজ, উপাদান ও অ্যালিগরিক্যাল আসপেক্ট। অর্থাৎ কবিতার বহিরাবরণে ও অন্তরাবরণেও থাকে গল্প যা আমাদের কল্পনাকে উসকে দিতে, উড়িয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হয়েছে।

আল মাহমুদের কবিতার ভেতরে গল্প-উপাদান আছে প্রায় গল্পেরই ঢঙে। মেটাফরের দ্যুতিতে পূর্ণ। রূপকের পাল্লা খুলে দিয়ে তিনি চলে যান এমন এক জগতের ভেতরে যেখানে প্রশ্ন মনের কোণে জমতে থাকলে তার উত্তরের জন্য ব্যাকুল হতে হয়। কিন্তু সে ব্যাকুলতার উপশম হয় না, বরং চমক অপেক্ষা করে-
আমি দৌড় মেরে পলাতে চাইলাম। আমার পা সরল না।
আমার সামনে কবরের মতো যে জায়গাটা ছিল,
সেখান থেকে ধমকের মতো একটা শব্দ এসে আমাকে থামিয়ে দিলো।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো কবরের দিকে এগোলাম।
যখন কবরের পাশে দাঁড়ালাম,
কবর আর কবর রইল না,
পৃথিবীর পেটের ভেতর সিঁড়ির মতো একটা পথ দেখতে পেলাম।
কে যেন আমাকে বললো যাও’।
আমি আশপাশে তাকালাম,-- না, কাউকে দেখছি না।
আবার নির্দেশ হলো যাও’।
ভয়ে আমি সিঁড়িতে পা দিলাম। আমার হৃৎপিণ্ড দুলছিল।
অন্ধকারে আমার চোখ অন্ধ। তবু আমি প্রতিটি ধাপ পেয়ে যাচ্ছি।
পেরিয়ে যাচ্ছি।
আমি যখন থামলাম, তখন আর অন্ধকার ছিল না।
এক ধরনের আবছা আলোর মধ্যে এসে পড়েছি।
কেউ থামতে বলেনি, আমার মন বললো এখানে থামা উচিত।
(চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি/ আল মাহমুদ/মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো)

আল মাহমুদের কবিতার ভেতরে প্রবহমান গল্পে এই সত্যই উঠে এসেছে। আল মাহমুদের গল্পে পুরুষের কর্তৃত্বের রূপই আমরা বেশি দেখি, যখন চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি চৌদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা পাঠ করলে আরো অনেক কবির কবিতায়ই গল্পের উপকরণ উপাদান পাবো, যা মিথিক্যাল ওয়েভ হিসেবে আমাদের মনে এসে ধাক্কা দেয়। আল মাহমুদের কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলো এক বিশাল গল্পেরই উপাদান ধারণ করে আছে। কিন্তু সেই গল্প অনেকটাই পরোক্ষ এবং অনেকটাই নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু আল মাহমুদের কবিতায় গল্পের নায়ক স্বয়ং তিনি নিজেই। প্রথম পুরুষের জবানিতে লেখা এই কাব্যিক গল্পের নায়কও তিনি। তাই এখানে নৈর্ব্যক্তিকতার প্রয়োজন হয়নি। বরং পাঠককে অনেক সহজেই আকৃষ্ট করতে পেরেছেন তিনি। চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি যদিও স্বপ্নের ভেতরের কাহিনী, তারপরও তিনি কি বলতে চেয়েছেন, তা পাঠক কিন্তু বুঝতে পেরেছে। এই কম্যুনিকেশন, কবিতার জন্য খুবই ভালো, তবে সত্যিকার অর্থে তা সংহত, প্রতীকিত ও অ্যালিগরিক্যাল বা মেটাফরিক্যাল কবিতার ধারা থেকে অনেকটাই তফাতে। কিন্তু শিল্পের যে কলা, সেখানে তার রূপ অন্যরকম। তিনি এই গল্প-কবিতায় মেটাফর ব্যবহার করেছেন শেষ পর্যায়ে এসে। রানীর নির্দেশে ও ইঙ্গিতে তিনি চারজন তরুণী সুন্দরীর রূপ-লাবণ্য চেখে দেখে তাদের একজনকে পছন্দ করলেন। এবং তিনি তাকে নিয়েই বাসরে গেলেন। কিন্তু বাসরেও সেই মহাসামন্তমহারাজাধিরাজ এসে কবির শিরে চাবুক হানলেন, এবং তিনি মূর্ছিত হলেন।

এই কবিতার গল্পটিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসির পর বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, জেলগেটে দেখা, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, ফররুখের কবরে কালো শেয়াল... এই কবিতাগুলো গল্প অবলম্বনে রচিত। গদ্যছন্দে লেখা কবিতা এ-গুলো। প্রথম কবিতার পরই এই বইয়ে তিনি যুক্ত করেছেন ছোটো মাপের সাজানো চতুর্দশপদী। কোনোটা অমিল প্রবহমান, মাথা, ধাতুর ওলান থেকে, দেয়াল, সক্রেটিসের মোরগ, নামের ছোট সংহতরূপের কবিতা, যা আল মাহমুদের প্রথম যৌবনের কবিতারই ধারাবাহিকতার ফসল। অর্থাৎ গল্পস্টাইলে লেখা বর্ণাত্মক কবিতার সঙ্গে সমিল ও অমিল চতুর্দশপদী অক্ষরবৃত্তে লিখেছেন অনেক কবিতাই। এ-সব কবিতা তিনি নিয়েছেন, কেবল পাঠসুখের কারণে নয়, কাব্যসত্তার সঙ্গে মিশিয়েছেন প্রকরণের নানামাত্রিক রূপ। আর বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে তাঁর নিজের কথাগুলো বলার জন্য তিনি উপযুক্ত মনে করেছেন প্রথম যৌবনের কবিতার আকরণ (স্ট্রাকচার)।
দীর্ঘ বর্ণনার কবিতায় যে কাহিনীরূপ আছে, তাতে সিগনিফিকেন্টলি জড়িয়ে নিয়েছেন তার অভীপ্সিত পরিসর, সজ্জা আর প্রকরণের সঙ্গে চিত্রকল্প, প্রতীক ও রূপক। তাঁর এ-পর্বের কবিতায় পাই বিশেষণ, সমাসবদ্ধ বিশেষণরূপ, যা সংহত বোধেরই কাজ। কবিতাগুলোর নামের সঙ্গে যেমন, তেমনি প্রতীকী উদ্ভাসনও বলে দেয় তৃতীয়মাত্রার কোনো কথা, যা আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন চেতনার স্পর্শ দেবে বা দিচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement
এ সরকার জনপ্রত্যাশার কী করবে? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন : তাজুল ইসলাম চিফ প্রসিকিউটর আবুধাবির কারাগার থেকে দেশে ফিরেছেন ১৪ বীর কোনাবাড়ীতে কলেজছাত্রকে গুলি করে হত্যা : কনস্টেবল গ্রেফতার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্তগুলো যৌক্তিক : ফখরুল ‘একটি চক্র জামায়াত আমিরের বক্তব্য নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে’ অস্ত্র জমা দেয়নি শামীম ওসমান ও গাজী পরিবার এবি পার্টির উপদেষ্টার পদ ছাড়লেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক কর্মকর্তাদের তালিকা চাওয়া নিয়ে বিতর্কে মন্ত্রণালয়ের দুঃখ প্রকাশ আশুলিয়ায় শ্রমিক দলের সমাবেশে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ৫ রূপগঞ্জে পরকীয়া সন্দেহে স্ত্রীকে হত্যা

সকল