০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ওরিয়ানা ফালাচির উপন্যাস ‘লেটার টু এ চাইলন্ড নেভার বর্ন’

-

ইটালিয়ান বিখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির উপন্যাস ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’ একটি পাঠক সমাদৃত উপন্যাস। এটি নাটক হিসেবেও মঞ্চে এসেছে একাধিকবার। ওরিয়ানা ফালাচি (১৯২৯-২০০৬) একজন আপসহীন লেখিকা। উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে অপ্রত্যাশিত ভ্রƒণের অস্তিত্বে আলোড়িত এক মাতৃসত্তা। ধীরে ধীরে প্রাণের মাঝে আরেক প্রাণের অস্তিত্ব। অনাগত এই প্রাণের বৈধ-অবৈধতার প্রশ্নে সমাজকাঠামো অসভ্যরূপে দৃশ্যমান। মায়ের উদরে মনুষ্যাকৃত নিতে থাকা ভ্রƒণের সাথে কথোপকথন চলে মায়ের। সেই কথোপকথনে দৃশ্যমান হতে থাকে সমাজের ভিন্ন এক রূপ। একাকিত্বের লড়াইয়ে ক্লান্ত হতে হতে উদরশূন্য মায়ের আহাজারি দেখা যায় শেষ পর্যন্ত। উপন্যাস আর স্মৃতিকথা লিখলেও ইতালিয়ান এই আপসহীন লেখিকা রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী হিসেবেই অধিক পরিচিত। তিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, উইলি ব্রান্ডিড, জুলফিকার আলী ভুট্টো, আয়াতুল্লাহ খোমেনি, ওল্টর ক্রনকিট, ওমর খাদাফি, ইয়াসির আরাফাত, ইন্দিরা গান্ধী, শন কানারি, ফেডরিকো ফেলিনি প্রভৃতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের। ভিয়েতনামের ওপর লেখা ‘নাথিং অ্যান্ড সো বি ইট’ অনাগত সন্তানের সাথে কথোপকথন ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’ এবং প্রেমিক অ্যালেক্সান্ডার প্যানগোউলিসকে নিয়ে লেখা ‘এ ম্যান’ তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

বিবাহবহির্ভূত সন্তান জন্ম দেয়া আমাদের মতো রক্ষণশীল সমাজে যেমন চোখের বালি ঠিক তেমনি ইউরোপের মতো মুক্তমানদের চারণভূমি খ্যাত দেশগুলোতেও একই অবস্থা। সেখানে এই ধরনের গর্ভধারণ যেমন প্রেমিক স্বীকার করতে চায় না, সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিও এটিকে এড়িয়ে যেতে বলে। শুধু কাছে থেকে সাহস যোগায় গর্ভধারিণী মা। এ রকমই ঘটনা প্রবাহের মধ্যে এগিয়েছে ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’। লেখকের ভাষায় ‘নিজের শরীরের ভেতর আরেকটি জীবন লালন করার মধ্যে এক ধরনের গর্ব আছে, গর্ব আছে একজনের ভেতর দু’জনকে অনুভব করার মধ্যে।’ পৃথিবীতে নবাগত সন্তান মেয়ে হলে যেমন সময়ের ব্যবধানে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ঠিক তেমনি ছেলে হলেও পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। যদিও লেখক এতে মেয়েসন্তানের সমস্যা বেশি-ই বলে উল্লেখ করেন। ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’ বিবাহবহির্ভূত উপায়ে গর্ভে ধারণ করা এক মা এবং অনাগত সন্তানের দীর্ঘ আলাপন। কঠিন বাস্তবার মাঝেও দৃঢ় আবেগ এবং প্রচলিত নিয়ম ভাঙার এক সাহসী উচ্চারণ ছুটে বেড়ায় ’লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’-এর। এটি মূলত বর্ণনা প্রধান রচনা। বর্ণনার ঢঙ্গে কথা বলার সময় সন্তানের হয়ে নিজে প্রশ্ন করে নিজে উত্তর দেয়ার একটি অভিনব বিষয় লক্ষ করা যায়। শুধু কি তাই? প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে একজন পুরুষ ও একজন নারীর শারীরিক সম্পর্ক একটি মানব শিশুর জন্ম দেয়। আবার এ প্রশ্নও আসে এবং কোনো কোনো সমালোচক এ ধরনের প্রশ্ন করেছেনও। সব সমাজ যদি এ ধরনের বিষয়কে সহজে মেনে নেয় তাহলে কোথায় যাবে মানব সভ্যতা, সমাজ কি টিকে থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই বিবাহ নামক মন্ত্র কিংবা বন্ধন কিংবা সামাজিক নিয়মই তো সমাজকে এক অজানা সুতোয় আটকে রেখেছে, গড়েছে পরিবার।

একজন পুরুষ ও নারী দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে, একসাথে বসবাস করে। এক পর্যায়ে নারী উপলব্ধি করে সে সন্তানসম্ভবা। পুরুষ সঙ্গী তার এই সন্তান ত্যাগ করার জন্য চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। পেটে সন্তানের বয়স বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে নারীর লাইফস্টাইলে বিশৃঙ্খলা চলে আসে। এই নারী তার জীবন নিয়ে যেমন গৌরব বোধ করেন আবার ঘৃণাও করেন। যে সমাজে তিনি টিকে থাকতে চেয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে, একজন মানুষের অধিকার নিয়ে, সেই সমাজ তাকে বারবার কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয়। সম্পর্কের টানাপড়েন ও মানসিক চাপের মধ্যে তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। একটা সময় পৃথিবীতে জন্ম নেয়া তার কাছে পাপের মতো মনে হয়। শেষ পর্যন্ত নিজেকে শেষ করে দেয়ার খেলায় মেতে ওঠে আবার শোধরাতে চায় নিজের ভবিষ্যৎ সন্তানের কথা ভেবে, মাতৃহৃদয়ের আকুতি তার মনে উঁকি দেয় বারবার। সমস্যায় জর্জরিত আমাদের যাপিত জীবন। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপমান, বঞ্চনা, কপটতাপূর্ণ এ পৃথিবীতে একজন নতুন মানুষ নিয়ে আসা কী ঠিক?’ তাই এত সমস্যার মাঝে অনাগতের আগমনকে ভয়ের চোখেই দেখতে বাধ্য হচ্ছেন মা। সন্তানের বয়স বাড়তে থাকলে আকৃতিও পরিবর্তন হয়। এতে মায়ের পেটের আকারেও স্বাভাবিকের চেয়ে পরিবর্তন আসে। অবিবাহিত নারীর এমন পরিবর্তন সমাজ মানতে নারাজ। যার কারণে মা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করা হয় সে পুরুষও পর হয়ে যায়। ডাক্তারও ভালো চোখে দেখে না এমন রোগীকে। এখানেই একাকার হয়ে যায় প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সরলরেখা। এতে একটি বিষয়ই প্রতীয়মান তত্ত্ব আর তথ্য এক বিষয় নয়। শীতের আগমনে মায়ের মনে আশার সঞ্চার করে। কারণ ‘শীত শুরু হয়ে ভালো হয়েছে। বড় ওভারকোটের নিচে উঁঁচু পেট আর মানুষে চোখে পড়বে না। আমিও আর অস্বস্তিতে পড়ব না।’ ঘটনা এবং বর্ণনায় প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে নানা কুসংস্কার; যা আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় চোখে পড়ে হরহামেশা।

বিছানার ওপর ফুল অশুভ চিহ্ন। শুধু মৃতের বিছনাতেই ফুল রাখা যায়। অনেকে বলে বাচ্চা জন্মানোর আগে দোলনা কেনা নাকি অমঙ্গলের লক্ষণ। এমনই নানা কুসংস্কার উঠে আসে বিভিন্ন জায়গায়। অসতর্কতার কারণে যে সন্তান মায়ের গর্ভে চলে এসেছে তা নীরবে অনেকটা অভিমানেই হারিয়ে গেছে জগত থেকে। রেখে গেছে স্মৃতির পদচিহ্ন। দিয়েছে প্রশ্ন ছুড়ে সুখ, স্বাধীনতা, ভালোবাসা---খুঁজে পেয়েছ তুমি?’
মা সন্তানকে সম্বোধন করে দীর্ঘ এক চিঠি লেখেন, লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন। একপর্যায়ে তার গর্ভস্থ ভ্রƒণ বিকশিত না হয়ে নষ্ট হয়ে যায়, ফলে তার প্রতিক্রিয়া আরো ঘণীভূত, আরো বেদনাবিধূর হয়। ওরিয়ানা ফালাচি সাহসী নারী ও পেশাগত ব্যক্তিত্ব। ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কার সম্বন্ধে তার রয়েছে গভীর, বলিষ্ঠ ও বিরূপ অভিমত। তিনি তার গর্ভস্থ ভ্রƒণকে জীবনবিমুখ ধারণা দিতে থাকেন, তার সামনে মেলে ধরতে থাকেন ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কারের জটিল গ্রন্থিগুলো। এ পর্যায়ে তার কথাবার্তা অত্যন্ত আবেগাক্রান্ত ও দুশ্চিন্তা উদ্রেককারী। তিনি সন্তানকে একবার বলছেন, "Life is such an effort, Child. It's a war that is renewed each day, and its moments of joy are brief parentheses for which you pay a cruel price." এটি ভয়ঙ্কর নিয়তির অশুভ ইঙ্গিত, নয় কোনো আশার বাণী, নয় ভরসার কথা। পৃথিবীর কঠিন ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা মা তার অনাগত সন্তানকে শোনাচ্ছেন। আবার চিন্তা করছেন এই নিষ্ঠুর, এই কঠোর পৃথিবীতে তার আগমন কতটা সুখের হবে, তার চেয়ে এখানে না আসাই তো ভালো ইত্যাদি চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার অন্য একসময় তিনি শিশুটিকে বলছেন, "You belong neither to God nor the state nor me. You belong to yourself and no one else." এটি চরম হতাশার কথা কারণ যে শিশু সঠিক পার্থিব নিয়ম অনুযায়ী ভ্রƒণে আসেনি, তাকে কেই স্বাগত জানাবে না, স্রষ্টাকেও তিনি বলতে চাচ্ছেন যে তিনিও হয়তো এই সন্তানকে সেভাবে দেখবেন না। তাই শিশুকে বলছেন তুমি তোমার নিজের। সন্তানের প্রতি মায়ের গভীর ও অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অনুভূতি সেটির প্রকাশ এভাবে ঘটেছে। সম্ভবত জীবন ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই নিহিত রয়েছে উপন্যাসটির শক্তি আর তাই এটি পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয়। অনূদিত হয়েছে বহু ভাষায়। অতিক্রম করেছে মনুষ্যতৈরি বর্ডার, পৌঁছে গেছে বিশে^র সর্বত্র।


আরো সংবাদ



premium cement
এ সরকার জনপ্রত্যাশার কী করবে? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন : তাজুল ইসলাম চিফ প্রসিকিউটর আবুধাবির কারাগার থেকে দেশে ফিরেছেন ১৪ বীর কোনাবাড়ীতে কলেজছাত্রকে গুলি করে হত্যা : কনস্টেবল গ্রেফতার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্তগুলো যৌক্তিক : ফখরুল ‘একটি চক্র জামায়াত আমিরের বক্তব্য নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে’ অস্ত্র জমা দেয়নি শামীম ওসমান ও গাজী পরিবার এবি পার্টির উপদেষ্টার পদ ছাড়লেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক কর্মকর্তাদের তালিকা চাওয়া নিয়ে বিতর্কে মন্ত্রণালয়ের দুঃখ প্রকাশ আশুলিয়ায় শ্রমিক দলের সমাবেশে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ৫ রূপগঞ্জে পরকীয়া সন্দেহে স্ত্রীকে হত্যা

সকল