১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

অংশীদার

বেন ওকরি
-


আমি ঘটনাক্রমে একটি বাড়িতে গিয়েছিলাম, অথবা হয়তো এমন না-ও হতে পারে। মূলত আমি মার্গারেট হাউজ খুঁজছিলাম, যা ছিল এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাসভবন। যাহোক, আমি সেই ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম এবং বাড়ির মালিক আমাকে তার শ্বশুরের বাসায় নিয়ে যান, যার সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি, অথবা অনেক দিন আগে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল। তিনি আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমার সাথে কথা বলা শুরু করেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি কিভাবে কোনো পরিচিতকে অপছন্দ করেছিলেন এবং কিভাবে আমাদের তা-ই করা প্রয়োজন, অথবা অন্য কিছু করা উচিত। তিনি আরো বলেছিলেন কিভাবে আমার স্ত্রী, তার যে কাজ করার কথা ছিল, তা করেছিলেন কিংবা করেননি। তিনি নিজেকে সংযত করেছিলেন এবং অনেক অন্তরঙ্গ কথা বলেছিলেন।
আমি তাকে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। যখন ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়েছিল, তখন আমি তার ভুল শুধরে দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি কে, তা জানতে তিনি অত্যন্ত উদ্গ্রীব ছিলেন। তিনি ছিলেন ভীষণ আত্মভোলা, তবে তার চিন্তা এক দিকে প্রসারিত ছিল। আমাকে অন্য কারোর সাথে গুলিয়ে ফেলার ভুল ভাঙার জন্য আমি এক মুহূর্তও সময় পাইনি।

তদুপরি আমি বিষয়টি উপভোগ করা আরম্ভ করি। আমি অন্য কেউ হতে পারার বিষয়টি উপভোগ করেছি। তা ছিল আকর্ষণীয়। হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠিত কোনো এক পরিবারের অংশ হিসেবে নিজেকে খুঁজে পাওয়া এবং নিজের অংশীদারিত্ব খুঁজে পাওয়া বেশ আনন্দের ব্যাপার ছিল। অংশীদারিত্বের রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছিল চমৎকার।
ফ্ল্যাটটি ছিল ধনাঢ্য এক পরিবারের জিনিসপত্রে ঠাসা। স্পষ্টতই সেখানে একান্নবর্তী পরিবারের বসবাস ছিল। যিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, তিনি ভোজের জন্য খাবার তৈরি করেছিলেন, কেক তৈরির জন্য বিভিন্ন উপাদান যোগ করেছিলেন এবং সসের জন্য মসলা মিশিয়েছিলেন। সবকিছু গলে গিয়ে ভালো করে মিশে গিয়েছিল। বৃদ্ধ ও রুগ্ণ লোকদের আনন্দোৎসব এবং পারিবারিক মেজাজ আমাকে বেশ নেশাগ্রস্ত করেছিল।

এক সময় আমি ভাবতে শুরু করি যে, বোধহয় আমিই সেই ব্যক্তি যার জন্য তিনি আমাকে বেছে নিয়েছেন। আর তিনি যদি আমাকে অন্য কেউ মনে করেন, তবে সম্ভবত আমি সেই অন্য কেউ। হয়তো আমি এই মাত্র কোনো এক স্বপ্ন থেকে এমন এক বাস্তবতায় জেগে উঠেছি, যেখানে আমি একজন ছিলাম। তিনি যেমন ভেবেছিলেন, ঠিক তেমনই ছিলাম এবং স্বপ্নের সাথে আমার পুরনো পরিচয়ের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু যখন আমি এই ধারণার সাথে লুকোচুরি খেলছিলাম, তখন আমার মধ্যে এক ধরনের অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, যেকোনো মুহূর্তে প্রত্যাশিত আসল লোকটি উপস্থিত হবে। অথবা, যদি তা না হয়, তবে আসল লোকটির স্ত্রী আসবেন এবং আমাকে চিনতে পারবেন না।
আমার মধ্যে ভয় বাড়তে থাকে। কেননা যেকোনো সময় আমার মুখোশ খসে যেতে পারে। তখন আমি কী করব? আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। আমি ভয় পেয়েছি। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে এই অদ্ভুত পরিস্থিতির সাথে নিজেকে জড়াইনি। ওই ঘরে থাকাকালীন অবস্থায় আমি পুরো সময় একটা শব্দও উচ্চারণ করিনি। আমি ভুল করে অন্য কেউ ছিলাম। আমি অংশীদার হতে চেয়েছিলাম। আমি সেখানে থাকতে চেয়েছিলাম।
মৃত্যুর মতো মুখোশ খুলে ফেলার দণ্ডাদেশ আমার ওপর ঝুলছে। আমি অপেক্ষা করছিলাম এবং বাড়ির লোকটির কথা শুনছিলাম। সময় চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার অবশ্যম্ভাবী লজ্জাজনক পরিস্থিতি আরো কাছে নিয়ে এসেছিল।

সেই ফ্ল্যাটে থাকার আগে আমি আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন বেঁচে থাকা আমার শেষ আত্মীয়। মনে হয়েছিল তিনি ছিলেন এ দুনিয়ায় আমার শেষ গন্তব্য। আমার অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। এখন আমার এই পরিবার আছে, যারা আমাকে খাদ্য পরিবেশন এবং উৎসবমুখর পরিবেশের ওয়াদা করেছে। তা সত্ত্বেও
আর তারপর আমি সেখানে দাঁড়ানোর পর আমার পেছনে দরজা খুলে যায়। একজন কৃষ্ণবর্ণের আরবীয়, মুখে বসন্তের দাগ, বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করেন এবং সাথে সাথেই আমি জানি যে, এই সেই লোক যাকে আমি ভুল করেছি। তিনি যেই ছিলেন না কেন, আসল শ্বশুর হিসেবে তার নীরব এবং নিখুঁত কর্তৃত্ব ছিল। আর আমার প্রথম ধাক্কা ছিল যে, আমি আদৌ তার মতো দেখতে ছিলাম না। আমি তরুণ, চটপটে এবং আরো ভালো চেহারার ছিলাম। আমার প্রাণশক্তি ও স্বাধীনতা ছিল। আমি ঐতিহ্যের ফাঁদে পড়িনি। আমি ছিলাম আধুনিক। আমি যেকোনো দিকে যেতে পারতাম। আমার সামনে অনেক ভবিষ্যৎ উন্মুক্ত ছিল। মনে হচ্ছিল লোকটির ওজন কমে গিয়েছে। যার রাস্তা বন্ধ ছিল, ভবিষ্যৎ ছিল নির্ধারিত এবং ভূমিকা ছিল স্থির, তার সম্পর্কে এক ধরনের কথা প্রচলিত ছিল। তবে সবচেয়ে খারাপ অর্থে তাকে সংজ্ঞায়িত করলে বলতে হয় তিনি ছিলেন মধ্যবয়সী; কোনো স্বাধীনতা নেই, এমনকি স্বাধীনভাবে চিন্তা-ভাবনা করারও পরিস্থিতিও নই। এ সবকিছু আমি এক ঝলকে অনুভব করেছি এবং পরবর্তীতে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আমি গভীরভাবে বিস্মিত হয়েছি যে, লোকটিকে ভুল করেছি।
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার শ্বশুর মহাশয় ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। তিনি বাড়ির মানুষ, যিনি প্রথমেই আমাকে ভুল শনাক্ত করছেন। তিনি চোখ তুলে তাকালেন এবং আসল শ্বশুরকে দেখতে পান। তিনি জানতেন যে, তিনিই একজন। আমি মনে করি তিনি তাকে চিনতে পেরেছেন। মানুষ কতটা অমনোযোগী হতে পারে! যাহোক, সেই মুহূর্তে তিনি আমার দিকে ফিরে তাকান এবং ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন :
‘আর তুমি কে?’

তখন আমার মনে হয়েছে যে, ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে হানা দিয়েছে। আমার মুখোশ খোলামেলাভাবে উন্মোচিত ছিল। হঠাৎ লোকজন হালকা পরিবেশ থেকে আবির্ভূত হয়েছিল এবং তারা উচ্চ স্বরে শ্বশুরবাড়িতে আমার ব্যক্তিত্বহীনতা সম্পর্কে বলাবলি করছিল। তাদের কথাবার্তায় ছিল জোরালো মন্তব্য আর অভিশাপ এবং তাদের ছিল বিস্মিত চোখ। লোকজন আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন আমি একজন ভয়ঙ্কর অপরাধী। মহিলারা আমাকে ঘোমটার আড়াল থেকে বিভীষিকাময় দৃষ্টিতে দেখেছে। আমি আমার জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম। যেই আমি রাস্তায় বের হয়েছি, তাকিয়ে দেখি আমার চতুর্দিকে ভিড়। তারা একান্নবর্তী পরিবারের লোকজন। আমি একটা মানচিত্র ধরে রাখি এবং বললাম :
‘তা ভুল ছিল। আমি মার্গারেট হাউজ অথবা মার্গারেট কোর্ট খুঁজছিলাম।’
গণ্ডগোলের পুরোটা সময় আমি পাশের দালানের যে জায়গাটি খুঁজছিলাম, তার নাম দেখলাম। আমি নীরবে তাদের ক্ষোভ এবং উচ্চস্বরে মন্তব্য সহ্য করেছি। কিছুক্ষণ পর আমি আমার আসল গন্তব্য পাশের দালানের দিকে হাঁটতে থাকি। কিন্তু বাড়ির লোকটি, যিনি আমাকে শ্বশুরবাড়ির লোক বলে ভুল করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন :
‘সেখানে যেও না। তুমি সেখানে যেতে চাও না।’

আমি মার্গারেট হাউজের দিকে তাকিয়েছি। তারপর আমি মাঠের দিকে দৃষ্টি মেলে ধরেছি। আমি লোকজনকে লক্ষ্যহীন বৃত্তের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। তারা সঙ্কুচিত হচ্ছিল, উদ্দেশ্যহীনভাবে কিংবা অনিয়মিতভাবে নড়াচড়া করছিল। তাদের অবয়ব ছিল কৃষ্ণবর্ণের, পরনে ছিল কালো ওভারকোট এবং তাদের দেহ ছিল সবই ছায়া, যেন তারা হেডিজ১ ছিল। তারা এমনভাবে নড়াচড়া করছিল যেন তাদের পায়ের সাথে অদৃশ্য ভারী সিসাযুক্ত ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল তাদের কোনো কিছুই জানা নেই। কংক্রিটের উঠান ছিল, তবে তাদের সম্মিলিত উপস্থিতি জায়গাটি অন্ধকার এবং ভয়ানক দেখাচ্ছিল, এমনকি অপ্রত্যাশিত বিপদ ছিল। তারা যে পাগল ছিল, তার সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত ছিল...
আমি সেদিকে যেতে শুরু করি; কিন্তু বাড়ির লোক বলার পর আমি থেমে যাই। তখন আমি মার্গারেট হাউজের উঠানে অশুভ ছায়ায় ঘুরে বেড়ানো লোকজনের অস্বস্তিকর হাওয়া অনুভব করতে পেরেছিলাম। তারপর আমি দিক পরিবর্তন করি এবং লোকজনের ভিড়ের দিকে ফিরে যাই। তারপর আমি রাস্তায় নামি, আমার নিজের জীবনের দিকে।

লেখক পরিচিতি : বুকার প্রাইজ বিজয়ী নাইজেরিয়ার বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক বেন ওকরির জন্ম নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে মিন্না এলাকায়, ১৫ মার্চ ১৯৫৯ সালে। মাত্র দু’বছর বয়সে তিনি বাবা-মার সাথে লন্ডনে পাড়ি দেন। তবে নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৬৮ সালে পরিবারের সবাই ফিরে আসেন লাগোসে। সেখানে থাকাকালীন সময়ে গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, মাতৃভূমির প্রতি গভীর মমতা এবং স্বদেশী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তার লেখার মূল বিষয়। যদিও কবিতা দিয়ে তিনি সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন; কিন্তু তেমন সাড়া ফেলতে না পেরে ছোটগল্প লেখায় মনোনিবেশ করেন। মাত্র একুশ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস ‘ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড শ্যাডোস’ প্রকাশিত হয়। তবে সবচেয়ে প্রশংসিত এবং আলোড়িত উপন্যাস ‘দ্য ফ্যামিসড রোড’ এবং এই উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৯১ সালে ‘বুকার প্রাইজ’ অর্জন করেন। তার প্রথম ছোটগল্প সঙ্কলন ‘ইন্সিডেন্টস অ্যাট দ্য শ্রাইন’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি ‘স্টার্স অব দ্য নিউ ক্যার্ফু’ (১৯৮৮), ‘টেইলস অব ফ্রিডম’ (২০০৭) এবং ‘প্রেয়ার ফর দ্য লিভিং’ (২০১৯) গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ‘অ্যান আফ্রিকান এলেজি’ (১৯৯৭), ‘মেন্টাল ফাইট’ (১৯৯৯) এবং ‘ওয়াইল্ড’ (২০১২) তার কবিতার বই। তার সাহিত্যকর্মকে সমালোচকরা বিভিন্ন বিশেষণে আখ্যায়িত করতে চেয়েছেন, যেমন উত্তর-আধুনিক, উত্তর-ঔপনিবেশিক, জাদু-বাস্তবতা, আধ্যাত্মিক বাস্তবতা এবং আফ্রিকার ইউরোবো উপজাতির লোক-সংস্কৃতি ও আচার-আচরণ। তবে লেখক নিজেই এসব শ্রেণিবিন্যাস খণ্ডন করেছেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি লন্ডনে বসবাস করেন।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement