ক্লাসিক সাহিত্য অব ট্রুথ : ফ্রান্সিস বেকন
অ নু বা দ- সায়ীদ আবু বকর
- ২১ জুন ২০২৪, ০০:৫১
সত্য আবার কী? তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠেছিল পাইলাট (যিশুখ্রিষ্টের মৃত্যুদণ্ড প্রদানকারী জুডার রোমান শাসক); এবং এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে সে বসে থাকেনি। বাস্তবিকই, কিছু কিছু লোক আছে, যারা অস্থিরমতি, বারবার তাদের মত পরিবর্তন করে আনন্দ পায়। তারা মনে করে, কোনো নির্দিষ্ট জিনিসে বিশ্বাস লালন করা একধরনের মানসিক দাসত্ব, এটা মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং যদিও এ ধরনের সংশয়বাদী দার্শনিকদের তেমন অস্তিত্ব আর নেই, তবুও কিছু কিছু তর্কবাজ বুদ্ধিজীবী এখনো রয়ে গেছে, যাদের ধমনীতে এদের রক্তধারা প্রবাহিত, যদিও সে রক্তের ধারা প্রাচীনকালের দার্শনিকদের মতো প্রবলতর নয়।
অনেক জটিলতা ও শ্রমের মধ্য দিয়ে মানুষ সত্যকে আবিষ্কার করে এবং এটা যখন একবার আবিষ্কৃত হয় তখন তার মনের উপর শক্তভাবে চেপে বসে; এ বিষয়টিই হয়তো মিথ্যাকে মানুষের অনুকূলে নিয়ে যায়, কিন্তু যদিও স্বাভাবিক, তবু বলা যায়, মিথ্যার প্রতি মানুষের এ ধরনের ভালোবাসা বিকৃত। গ্রিসের শেষ পর্যায়ের দার্শনিকদের একজন এ বিষয়টা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান এটা আবিষ্কার করেন যে, মানুষ মিথ্যা বলে আনন্দের জন্য নয়, যেমনটি কবিরা মিথ্যা বলে আনন্দদানের জন্য; বৈষয়িক লাভের জন্যও নয়, যেমনটি ব্যবসায়ীরা মিথ্যা বলে মুনাফা অর্জন করে; বরং মানুষ মিথ্যা বলে কেবল মিথ্যার খাতিরে।
সত্য হলো নিরাবরণ স্পষ্ট দিবালোকের মতো; দিনের আলোতে একে খোলা মঞ্চে প্রদর্শন করলে তেমন আকর্ষণীয় মনে হবে না, যেমন আকর্যণীয় মনে হবে রাতের বেলা মোমবাতি ও ল্যাম্পের কৃত্রিম আলোয় প্রদর্শন করলে। সত্যকে আরো তুলনা করা যেতে পারে মুক্তার সাথে, যেটা দিনের বেলা দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু এটাকে কখনো হীরা বা পদ্মরাগমণির সাথে তুলনা করা যাবে না, যা মোমবাতি ও ল্যাম্পের বিচিত্র আলোয় আকর্ষণীয় লাগে। সত্যের সাথে সামান্য পরিমাণ মিথ্যা মিশ্রিত করলে আনন্দদায়ক হয়। কারো কি এ ব্যাপারে সংশয় আছে যে, যদি মানুষের মন থেকে মিথ্যা মতামত, মিথ্যা আশা, মিথ্যা মূল্যায়ন, মিথ্যা কল্পনা প্রভৃতি কেড়ে নেয়া হয়, তাহলে বহু মানুষের মন সঙ্কুুচিত হয়ে যাবে, বিষণœতা ও হতাশায় ভরে যাবে আর তাদের জীবন তাদের কাছে হয়ে উঠবে দুর্বিষহ? প্রথম দিককার পাদ্রিদের একজন, অত্যন্ত রুক্ষ ভাষায় কবিতাকে শয়তানের শরাব বলে অভিহিত করেছিলেন কারণ, তার মতে, এটা মানুষের কল্পনাশক্তিকে জাগিয়ে তোলে এবং এটা মিথ্যার ছায়া ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু কবিতা তো সেই মিথ্যার কথা বলে, যা মনের মধ্য দিয়ে ঢুকে আবার তা বের হয়ে যায়, মনের ভিতরে আস্তানা গাড়ে না। ক্ষতিকারক মিথ্যা তো তাই, যা মানুষের মনের ভিতরে ডুবে যায় এবং সেখানে স্থায়ী বাসা তৈরি করে । যাহোক, এসব জিনিস এভাবে মানুষের অপ্রকৃত বিচার এবং স্নেহের মধ্যে রয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও সত্য, যা নিজেই নিজের বিচার করে (অর্থাৎ যারা সত্যকে অনুধাবন করতে পারে, তারাই সত্যের মূল্য বোঝে), এই শিক্ষা দেয় যে, সত্যের অনুসন্ধান (যা বলতে বুঝায়, সত্যের প্রতি প্রণয় নিবেদন করা), সত্যের জ্ঞান (যা বলতে বুঝায়, সত্যের উপস্থিতি) এবং সত্যের বিশ্বাস (যা বলতে বুঝায়, সত্যকে উপভোগ করা) এই তিনটা জিনিস হলো মানবপ্রকৃতির সার্বভৌম গুণ। সৃষ্টির দিনগুলোতে স্রষ্টা সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করেছিলেন, তা হলো অনুভূতির আলো; তার সর্বশেষ সৃষ্টি ছিল যুক্তির আলো; এবং সৃষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার পর স্রষ্টার তার স্বর্গীয় সত্তা দিয়ে মানবসত্তাকে আলোকিত করেন। প্রথমে তিনি প্রতিটা বস্তুর মুখের উপর আলোর নিঃশ্বাস নিক্ষেপ করেন; এরপর তিনি আলোর নিঃশ্বাস ফেলেন মানুষের মুখের উপর; এবং এখনো তিনি আলোর নিঃশ্বাস নিক্ষেপ করে চলেছেন তার পছন্দের মানুষদের মুখের উপর। কবি লুক্রেটিয়াস (জ. ৯৫ খিষ্ট পূর্বাব্দ), যিনি এপিকিউরিয়ান দর্শনকে চরম সৌন্দর্য দান করেছিলেন, কত চমৎকারভাবেই না বলেছেন : ‘সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের মধ্যে আছাড়ি পিছাড়ি খাওয়া জাহাজ দেখা কতই না আনন্দের; দুর্ভেদ্য দুর্গের জানালায় দাঁড়িয়ে নিচে রণাঙ্গনে দুঃসাহসী যোদ্ধাদের মারামারি দেখা কতই না আনন্দের; কিন্তু কোনো আনন্দকে, সত্যের সুউচ্চ চূড়ায় দাঁড়িয়ে (এমন একটি পাহাড়, যেখানে সহজে কেউ আরোহণ করতে পারে না এবং যেখানকার বাতাস সুনির্মল) নিচের উপত্যকার মানুষের ভুলভ্রান্তি, এলোমেলো পায়চারি, কুজ্ঝটিকা ও ঝড় দেখার আনন্দের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না; এ ধরনের পর্যবেক্ষণ মানুষকে পূর্ণ করে অনুকম্পাপূর্ণ সত্য দিয়ে, অহঙ্কার দিয়ে নয় (অর্থাৎ সে মানুষের ভুলত্রুটি, মিথ্যাবাদিতা প্রভৃতি অবলোকন করে সহানুভূতির সাথে, এ জন্যে সে অহঙ্কার বোধ করে না)। বাস্তবিকই, মানুষের মন যখন মানবকল্যাণের দিকে ধাবিত হয়, যখন সে স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে এবং সত্যের মেরুর দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ে তখন পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হয়।
আমরা যদি ধর্মশাস্ত্রীয় ও দর্শনশাস্ত্রীয় সত্য থেকে দৈনন্দিন সামাজিক জীবনের সত্যের কাছে ফিরে আসি, তাহলে আমাদেরকে, এমনকি যারা সত্যের চর্চা করে না তাদেরকেও, স্বীকার করতে হবে যে, সৎ ও সোজাসাপ্টা ব্যবহারই মানবপ্রকৃতির মহত্ত্ব প্রদর্শন করে; এবং সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণ হলো স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার সাথে খাদ মিশানোর মতো; খাদ পদার্থকে টেকসই করে বটে কিন্তু এর মান কমিয়ে দেয়। এসব উঁচু-নিচু ও বক্র রাস্তা হলো সাপের ছুটে চলার মতো, যে পেটে ভর করে ছোটে, পায়ের উপর ভর করে নয়। নিজেকে মিথ্যা ও বিশ্বাসঘাতকতার লজ্জায় ঢেকে ফেলার চেয়ে বড় পাপ আর নেই। এ কারণে মন্টেনিয়া চমৎকারভাবে বলেছিলেন যখন তিনি, মিথ্যা বলা কেন এত লজ্জাকর ও নিন্দনীয় কাজ, তার কারণ অনুসন্ধান করতে নেমেছিলেনÑ তিনি বলেন, যদি এটাকে ভালোভাবে ওজন করা হয় তাহলে বলতে হয়, মানুষ যখন মিথ্যা বলে তখন তাকে মনে হয় স্রষ্টার বিরুদ্ধে খুব সাহসী; কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে সে কাপুরুষ; কারণ মিথ্যুক স্রষ্টার মুখোমুখি হতে ভয় করে না কিন্তু মানুষকে দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যায় (অর্থাৎ মানুষের সামনে সত্য বলতে ভয় পায়)।
নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদিতা হলো জঘন্য এবং বিশ্বাস ভঙ্গের জন্য আছে শাস্তি যখন প্রলয়দিবসে শিঙায় ফুঁক দিয়ে ঘোষণা করা হবে স্রষ্টার ন্যায়বিচারের কথা। আগেই ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে যে, যখন যিশুখ্রিষ্টের পুনঃআবির্ভাব ঘটবে তখন পৃথিবীতে তিনি বিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাবেন না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা