১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ফররুখ আহমদ তার প্রথম ছড়া প্রথম কবিতা এবং অতঃপর

ফররুখ আহমদ। জন্ম : ১০ জুন ১৯১৮, মৃত্যু : ১৯ অক্টোবর ১৯৭৪ -

ফররুখ সনেটের বন্যা বইয়ে দেন বাংলা কাব্যে। অপূর্ব শব্দ প্রয়োগ, রূপকল্পের নিখুঁত ব্যবহার ও বিষয় নির্বাচনে সিদ্ধহস্ত ফররুখ আহমদ হন বাংলা কাব্য-সাহিত্যে সর্বাধিক সনেট নির্মাতা কবি। ‘কপোতাক্ষ নদের’ কবি মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে প্রথম সনেট রচনা করেন আর ফররুখ সে সনেট ভাণ্ডারকে পূর্ণতা দান করেন

কবি ফররুখ সাহিত্যজীবনের দু’টো ভাগ : প্রথমাংশ কলকাতায়, দ্বিতীয়াংশ ঢাকায়। তার সাহিত্যের বীজ অবশ্য শৈশবেই তার মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল। শৈশবে দাদীর কাছে ফররুখ শুনতেন পুঁথির কাহিনী, ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ এবং ‘কাসাসুল আম্বিয়া’। ছোটবেলায় ফররুখ ছিলেন দুরন্ত প্রকৃতির; কিন্তু ভাবুকতা ও উদাসীনতা তাঁর মধ্যে সবসময় কাজ করত। মাঠে কিংবা মধুমতী নদীর তীরে একা একা ঘুরে বেড়াতেন। জ্যোৎস্নারাতে বাঁশঝাড়ের পাশে গিয়ে ‘ডাহুকের ডাক’ শুনতেন। মনে হয় এসবই তাঁর মধ্যে কবিতার প্রেরণা সঞ্চার করেছিল। কিন্তু গ্রামে যা পাননি, তা পেলেন কলকাতায়। সাহিত্য জগতের দুয়ার খুলে গেল। স্কুলে পড়তেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। বালিগঞ্জ স্কুলে যখন পড়েছেন। দিলকুশা স্ট্রিটে থেকেছেন। রোজ সন্ধ্যায় দিলকুশা পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়তে যেতেন। সমবয়সী, পরিবর্তীকালের বিখ্যাত কথাশিল্পী আবু রুশদও ওই লাইব্রেরিতে নিত্য যেতেন। কখনো লাইব্রেরিতে বসে, কখনো পার্ক সার্কাস ময়দানের কোনো নিরিবিলি কোনায়, কখনো বা হাঁটতে-হাঁটতে বালিগঞ্জ লেক পর্যন্ত গিয়ে দু’জনে সাহিত্যালোচনা করতেন। নিরালায় দরাজ গলায় আবৃত্তি করতেন শেলি, কিটস, নজরুলের কবিতা।
বালিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলে পাঠকালীন তার মেধা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে আশানুরূপভাবে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ফতেহ লোহানী প্রমুখকে। যারা পরবর্তী সময়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। প্রতিটি ক্লাসে ফররুখ সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ফার্স্ট হতেন। অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় ‘যখন ছোট ছিলাম’ নামক স্মৃতিকথায় ক্লাসে ফররুখের বুদ্ধিদীপ্ত পারফরম্যান্সের কথা অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, হঠাৎ মারাত্মক জলবসন্তে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তিনি মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিতে না পেরে গ্রামের বাড়ি যশোরে ফিরে আসেন।
প্রথম ছড়া : খুলনা জেলা স্কুলের সুনাম সেকালে দক্ষিণ বাংলার ঘরে ঘরে। বরাবরই জেলা স্কুলের ছেলেরা মাধ্যমিক বৃত্তি পেত। প্রবেশিকা (এসএসসি) পরীক্ষায় দু-একজন মেধাতালিকায় স্থান পেত।
সুস্থ হলে বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ফররুখকে ভর্তি করে দিলেন এ স্কুলে।
ফররুখের সৌভাগ্য- স্কুলে বাংলার শিক্ষক হিসেবে পেলেন কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল এবং ‘বিদায় হজ’ কবিতার অমর লেখক কবি আবুল হাশেমকে।
ফররুখ নব উদ্যোমে দশম শ্রেণীর পড়া পুনরায় শুরু করল। নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে তেমন কষ্ট হলো না তার। ক্লাসের পড়া তৈরি খুবই সহজ হলো। সব তো পড়াই ছিল। এখন একটু চোখ বুলিয়ে নিলেই চলে। সিলেবাসেরও তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
প্রায় বিকেলেই নিরিবিলি জায়গা খুঁজে নিয়ে রূপসা নদীর ধারে গিয়ে বসত ফররুখ। দেখত রূপালি মাছের খেলা। ছলাৎ ছলাৎ চলমান ঢেউয়ের তালে তালে আনমনে নিজেকে নিয়ে যেত মধুমতির ধারে। যেখানে জ্যোৎস্নাধোয়া তার সবুজ গ্রাম।
লেখাপড়ার ফাঁকে ইতোমধ্যে দু-একটি ছড়া, কবিতা লেখা হয়ে গেছে। একটি গল্পের প্লটও এসেছে মাথায়। ক’দিন পর তারও খসড়া হয়েছে। লেখাগুলো নিয়ে সে কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা! মনের মাধুরি মিশিয়ে মুক্তার মতো স্পষ্ট হস্তাক্ষরে সেগুলো তুলে নেয় সুন্দর রুল করা খাতায়। কিন্তু লজ্জা পায় কাউকে দেখাতে।

অবশ্য মাঝে মধ্যে ভাবে, “অন্যদের মতো যদি মাসিক ‘সওগাত’ বা ‘মোহাম্মদি’তে আমার একটি লেখা ছাপা হতো তবে দাদী, আব্বা, ভাইয়া কতই না খুশি হতেন।” আবার নিজেই নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে বলে, ‘না, এখন থাক। মেট্রিক পাস করে তো মাত্র এক বছর পরই কলকাতা যাবো। তখন পত্রিকাতে পাঠানো যাবে।’
প্রবেশিকার জন্য ‘টেস্ট পরীক্ষার’ বাকি আর মাত্র ক’দিন। এমন সময় একদিন ক্লাসে ছোট্ট একটি নোটিশ এলো। লেখা আহ্বানের নোটিস : স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলা শিক্ষক আবুল হাশেমের কাছে লেখা জমা দিতে হবে।
এ নোটিশ ফররুখের মনে দারুণ তোলপাড় সৃষ্টি করে। স্কুল ছুটির পর বাসায় গিয়ে প্রথমে লুকিয়ে রাখা খাতাটি বের করে নেয়। ভুলে যায় নাওয়া-খাওয়া। ভাবতে থাকে কোন কবিতাটি জমা দিলে ম্যাগাজিনের জন্য নির্বাচিত হবে?
সিদ্ধান্তহীনতায় কেটে গেল বিকেল, সন্ধ্যা, রাত। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে গেল সে। এবার নিজেকে খুবই শক্ত করে নেয়। ফুলস্কেপ কাগজের একটি পৃষ্ঠায় সামনে রাখা কবিতার খাতা থেকে প্রথম ছড়াটি তুলে নিলো ফররুখ-
বিষ্টি নামে রিমঝিমিয়ে/রিমঝিমিয়ে রিমঝিমিয়ে,
টিনের চালে গাছের ডালে/বিষ্টি ঝরে হাওয়ার তালে।
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/বিষ্টি নামে মিষ্টি মধুর।
জুঁই-চামেলি ফুলের বোঁটায়/বিষ্টি নামে ফোঁটায় ফোঁটায়,
বাদলা দিনের একটানা সুর/বিষ্টি নামে ঝুমুরঝুমুর।’
ম্যাগাজিন সম্পাদক কবি আবুল হাশেম ফররুখের প্রথম লেখা সম্বন্ধে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ম্যাগাজিনের ভারটা নিয়ে দেখি কাজটা তত সহজ নয়। একে তো পাঠ্য ছাড়া আর কিছু খোকাদের কলমের মাথায় আসতেই চায় না, তার উপর টোকাই (যারা অন্যের কবিতা নিজের নামে চালিয়ে দেয়) বাছার বিপদ। ভারী ঝামেলায় পড়েছিলাম। এর মধ্যে একটি ছেলে এসে একটি লেখা হাতে দিলো।
ছেলেটিকে দেখতাম ক্লাসের অন্য ছেলেরা যখন মাস্টার সাহেবদের জব্দ করার জন্য ফন্দি আঁটতে থাকত, তখন সে বসে থাকত নির্বাক মুখে, বই মেলে, তার ডাগর চোখ দু’টি ঢেকে। তার লেখাটা পড়ে দেখলাম। চমৎকার লাগল। একটু ঘষা-মাজা করে সেটি পাঠিয়ে দিলাম প্রেসে।
এ ছেলেটিই হলো ফররুখ আহমদ। সে সে বছরই ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করে খুলনা ছেড়ে চলে গেল। তার বন্ধুরা বলত কলকাতার বড় পরিবেশে গিয়ে সে নাকি কবিতার তীর ছুড়বার স্থান পেয়েছিল।
প্রথম কবিতা : হ্যাঁ। কলেজ অঙ্গনে পা রেখেই কলকাতায় কবিতার তীর ছুড়েছিলেন ফররুখ।
প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ফররুখ কলকাতা এসে রিপন কলেজে ভর্তি হন। ইতোমধ্যে বড় ভাই বাসা বদল করে চলে এসেছেন ৩৮, দিলকুশা থেকে ৬, পার্ক সার্কাস স্ট্রিটে।

কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ফররুখ প্রথম লগ্নেই পেয়ে যান বন্ধুবর আবু রুশদকে। আবু রুশদ দু’বছর পর ফররুখকে আবার সাথী হিসেবে পেয়ে খুব আনন্দিত। এদিকে স্কুল সহপাঠী আবুল হাসেম ভর্তি হয়েছেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। মাঝে মধ্যে তিনি এসে দেখা করতেন প্রিয় বন্ধু ফররুখের সাথে। আবু রুশদের সাথে ফররুখ সময় কাটাতে খুব ভালোবাসতেন। দু’বন্ধুই একনিষ্ঠ সাধনা করেছেন নতুন লেখার। তাই দু’জন একত্রিত হলে নিজস্ব লেখাপড়ার চাইতে সাহিত্য প্রসঙ্গেই বেশি মেতে উঠতেন। যদিও রুশদের নতুন বাড়ি ফররুখদের বাসা থেকে বেশ কিছু দূরে কর্নেল বিশ্বাস রোডে ছিল। কিন্তু কবিতা তাদের সে দূরত্বকে খাটো করে দিয়ে প্রতি বিকেলে দু’জনের সাক্ষাৎ ঘটাত।
রুশদ-ফররুখ আলাপচারিতার মধ্যে কখনো চলে যেতেন প্রশস্ত গড়ের মাঠে। আবার কখনো নয়নাভিরাম বালিগঞ্জ লেকের ধারে। দু’জনে আলাপ করতেন সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে। কবিতা-গল্পের চাল-চরিত্র নিয়ে। তারা প্রবল উৎসাহে রবীন্দ্র-নজরুল-কিটসের কবিতা আলোচনা করতেন।
ফররুখ ‘বইপোকা’, গভীর রাতের পাঠক। তাই রবীন্দ্র-নজরুল, কিটস-এলিয়টের প্রসঙ্গ এলে রুশদ হা করে তাকিয়ে থাকত ফররুখের মুখের দিকে। সমবয়সী ফররুখ যখন দেশী-বিদেশী কবিদের কবিতা অনায়াসে আবৃত্তি করে যেতেন তখন রুশদের শুধু শুনে শুনেই তৃপ্তি পেতে হতো। ফররুখের স্মৃতিশক্তির প্রখরতা দেখে সবাই তাকে ঈর্ষা করত।
আবুল হাসেম তরুণ সাহিত্যকর্মী। নিজ সম্পাদনায় ইসলামিয়া কলেজ থেকে বের করেন হাতে লেখা সাহিত্য পত্রিকা ‘অভিযান’। পরাধীন ভারতে বাঙালি মুসলিম ছাত্রদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চার মিলনকেন্দ্র এই ইসলামিয়া কলেজ। ‘অভিযান’ এ কলেজ থেকে প্রকাশিত হতো বলে এর গুরুত্ব ছিল বেশ।
‘অভিযানে’ বাইরে থেকে কবিতা পাঠাতেন ফররুখ, শওকত ওসমান, আবু রুশদ প্রমুখ বন্ধু-স্বজন।
উৎসাহী ফররুখ কবিতা পাঠিয়ে ক্ষান্ত হতেন না। বন্ধু হাসেমকে সহযোগিতা করতেন সার্বিকভাবে; একটি ভালো লেখা সংগ্রহ করে, একটি কপি বিক্রি করে, অন্যদের কাছে এক কপি ‘অভিযান’ পৌঁছে দিয়ে।
তারুণ্যে উচ্ছল ফররুখের বন্ধুরা তাকে বলে, ‘আর ক’দিন এভাবে ম্যাগাজিন আর হাতে লেখা সাময়িক পত্রিকার পাতায় বন্দী থাকবে? এবার একটু আগে বাড়াও- সওগাত, মোহাম্মদি, বুলবুলে লিখো। তারা তো পত্রিকা বের করছে আমাদের এগিয়ে নেয়ার জন্যই।’
ফররুখ ভাবে, সত্যিই তো। খুলনায় থাকতে মনে মনে কত আশা করেছিলাম কলকাতায় এসে ওসব পত্রিকায় লিখব। আর দেরি কেন? আল্লাহর নামে একটি কবিতা পাঠিয়ে দেখি, পত্রিকা সম্পাদকরা ছাপে কি না?
ক’দিন পরই হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী সম্পাদিত ‘বুলবুল’ পত্রিকায় কয়েকটি কবিতা পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন ফররুখ। ১৯৩৭ সালের জুলাই সংখ্যায় ‘বুলবুল’-এ ‘রাত্রি’ নামক কবিতাটি প্রকাশের মাধ্যমে ফররুখ আহমদ কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করেন-
‘ওরে পাখি জেগে ওঠ জেগে ওঠ রাত্রি এলো বুঝি
ঘুমাবার কাল এল জাগিবার সময় যে যায়-
ওরে জাগ জাগ তবু অকারণে। রাত্রির ভেলায়-
কোন অন্ধ তিমিরের স্রোতে আসা নিরুদ্দেশে বুঝি’ ...

এ শুভ সূচনা বেগবান স্রোতধারা সৃষ্টি করে বাংলা কাব্যসাহিত্যে।
‘বুলবুল’-এ আরো চারটি কবিতা- অপ্রয়োজন, মৃত্যুরূপা, নগর-পথ, অন্যায়- এ বছরই পরপর প্রকাশিত হয়। অন্য দিকে মাসিক ‘মোহাম্মদি’ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭ সংখ্যায় প্রকাশ পায় ফররুখের প্রথম গল্প ‘মৃত বসুধা।’ অবশ্য আর মাত্র দু’টি গল্প- ‘যে পুতুল ডলির মা’ এবং ‘প্রচ্ছন্ন নায়িকা’ প্রকাশ করেই তিনি গল্প লেখা বাদ দেন।
এরপর ফররুখ কোনো অনুরোধ-উপরোধ ছাড়াই পরম আত্মবিশ্বাসে চার-পাঁচটি কবিতা পাঠিয়ে দেন মাসিক সওগাতে। দেশবরেণ্য সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন সম্পাদিত সওগাত তখন শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য পত্রিকা। বিশ্বাসের সোনালি ফসলরূপে ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর সংখ্যা সওগাতে ফররুখের আঁধারের স্বপ্ন নামে একটি কবিতা ছাপা হয়। তারপর আরো তিনটি কবিতা প্রকাশ পায়।
বিদগ্ধ পাঠক মহলে, খ্যাতিমান হিন্দু-মুসলিম কবিদের আসরে দৃঢ় প্রত্যয়ী তরুণ কবি ফররুখের কবিতা নতুন পদধ্বনি তোলে। সবাই সাহিত্য পত্রিকার পাতায় পাতায় খুঁজে বেড়ায় ফররুখের নতুন কবিতা। বড়রা দেন পরামর্শ। বন্ধুরা দেন উৎসাহ। ছোটরা করে শ্রদ্ধা। ফররুখ সবার স্নেহাশীষ, দোয়া ও ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যান নবসৃষ্টি সাধনায়।

ফররুখের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকায় বন্ধু আবু রুশদ ও আবুল হাসেমের দু-একটি কবিতা গল্প প্রকাশ পেতে থাকে। তারাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে সাফল্য বয়ে আনেন।
কলেজের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর পর্ব পেরিয়ে ১৯৩৯ সালে ফররুখ আইএ পাস করেন।
তরুণ শেক্সপিয়র স্বীকৃতি : আইএ পাস করার পর ফররুখ ভর্তি সমস্যায় পড়লেন। পাস কোর্সে বিএ পাস করে তাড়াতাড়ি ছাত্রজীবন শেষ করবেন, না বিএ অনার্স পড়বেন?
সচ্ছল-শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ফররুখ লেখাপড়ায় বরাবরই প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন দর্শন শাস্ত্রে অনার্স পড়বেন।
ভর্তি হলেন কলকাতা-সেন্ট পল কলেজে। কিছুদিন বেশ উৎসাহের সাথে ক্লাসও করেছেন। কিন্তু অনার্স সাবজেক্ট (সম্মান বিষয়) নিয়ে হঠাৎ ফররুখের মাঝে দেখা দেয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব।
ফররুখ একান্তভাবে মনোযোগ দিয়েছেন কাব্য সাধনায়। অথচ পড়ছেন দর্শনে। বন্ধুদের মধ্যে নানা গুঞ্জরন। বড়রা পরামর্শ দিলেন, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সফল কবি হতে হলে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়াই উত্তম।
সত্যিই তো। ফররুখকে জানতে হবে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য। কাব্যের ধারা বৈশিষ্ট্য। বাংলা সাহিত্যের সাথে আধুনিক বিশ্ব সাহিত্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ।

অনেক চিন্তাভাবনা শেষে ফররুখ ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। আবার বিপত্তি।
প্রশ্ন দেখা দেয় ভর্তি হবেন কোন কলেজে?
সেন্টপল কলেজে ইংরেজিতে অনার্স পড়া যায়। কিন্তু ওই কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রায় সব ক’জন শিক্ষক ইংরেজ। দু-একজন বাঙালি শিক্ষক থাকলেও তারা তেমন নামকরা নন। ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য অভিজ্ঞ বাঙালি শিক্ষকের একান্ত প্রয়োজন।
খোঁজ নিয়ে জানলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যাপনা করছেন প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু, কবি বিষ্ণুুদে। যারা বাংলা ভাষায় আধুনিক কাব্যধারার প্রবক্তা। তিরিশের কবি নামে খ্যাত। এ ছাড়া ওই কলেজে অধ্যাপনা করছেন কবি প্রমথ নাথ বিশী।
ফররুখ সেন্টপল ছেড়ে ভর্তি হলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। নতুনভাবে মনোনিবেশ করেন স্বদেশী ও বিদেশী সাহিত্য অধ্যয়নে।

তরুণ শেক্সপিয়র :
ফররুখ যাদবপুর থেকে কলেজ করতেন। আসা-যাওয়ার মাধ্যম ছিল ট্রাম। কলেজে আসা-যাওয়ার পথে ফররুখ তৈরি করতেন এক একটি কবিতার প্লট। তার অনেক বিখ্যাত সনেটের খসড়া হয়েছে ট্রাম-টিকিটের উল্টো পিঠে।
সেদিন ভোরে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। ফররুখ সকাল সকাল কলেজের পথে রওনা হলেন। বাইরে তখনো হাল্কা বৃষ্টি। ট্রাম থেকে নেমে অনেকটা দৌড়ে ফররুখ কলেজে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পেরে উঠলেন না। বৃষ্টি আর সেন্ডেলের ছিটকানো কাদায় মলিন ধুতি-পাঞ্জাবি। কি আর করা যায়। শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থাতেই ক্লাসে ঢুকলেন। ভেজা-কর্দমাক্ত পোশাক অন্যের দৃষ্টিকটু ঠেকবে ভেবে ফররুখ একেবারে পেছনের টেবিলে গিয়ে বসলেন।
ক্লাসে এলেন অধ্যাপক প্রমথ নাথ বিশী। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে তিনি নির্দিষ্ট বিষয়ে লেকচার দিচ্ছেন। ছাত্ররা তা মনোযোগের সাথে শুনছে। কেউ কেউ নোট করছে নিজ নিজ খাতায় কিন্তু ফররুখ! তিনি জানতেই পারেননি ক্লাসে কখন স্যার এসেছেন। তিনি লেকচার দিচ্ছেন। সহপাঠীরা নোট করছে। সে দিকে কোনো খেয়াল নেই ফররুখের। তিনি ভ্রমণ করছেন কবিতার আলোকিত জগতে। ট্রাম-টিকিটের উল্টো পিঠে খসড়াকৃত সনেটটি একবার লিখলেন ক্লাসের নোট খাতায়। না, তাতেও মন ভরছে না। আবার সুন্দর করে তুলে নিচ্ছেন তার অতি আদরের রুল করা খাতায়।
হঠাৎ প্রমথ নাথ বিশী লক্ষ করলেন- ফররুখ তার লেকচার না শুনে অন্য কী লিখছে। তিনি বক্তৃতা মঞ্চ থেকে নেমে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন ফররুখের কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। আচমকা স্যারকে দেখে ফররুখ ঘাবড়ে যান। কবিতার খাতাটি লুকাতে চাইলেও পারলেন না। প্রমথ নাথ বিশীর সন্ধানী দৃষ্টিতে ধরা পড়ে তার এক ছাত্রের কাব্য প্রয়াস।

বিশী অন্যদের কাছে আগেই শুনেছেন- ফররুখের বেশ কিছু লেখা ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। সে লিখে ভালো। তার লেখা অন্যের দৃষ্টি কাড়ে। অন্তরে দোলা দেয়। তাই তিনি ফররুখকে কোনো রূপ বকুনি না দিয়ে খাতাটি তাঁর কাছে থেকে চেয়ে নেন।
নিজ চেয়ারে বসে বিশী খাতায় লেখা কয়েকটি কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়েন। তিনি ক্ষণিকের মাঝে ফররুখের কবিতার মুগ্ধ হয়ে পড়েন। ঘণ্টা শেষে শিক্ষক মিলনায়তনে গিয়ে সতীর্থ অধ্যাপকদের ফররুখের কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান।
অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু কবিতাগুলো শুনে অভিভূত হন। তিনি বিশীর কাছ থেকে ফররুখের কবিতার খাতাটি চেয়ে নিতে পেলে বিশী আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বললেন, ‘আজ আমি একজন তরুণ শেক্সপিয়রকে আবিষ্কার করেছি।’ সত্যিই তাই।
বুদ্ধদেব বসু নিজেই তাঁর সম্পাদিত তৎকালীন সুবিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় ছাত্র ফররুখের বেশ ক’টি সনেট প্রকাশ করেন। যা সুধী মহল কর্তৃক উচ্চ প্রশংসা লাভ করেছিল। সে সময় সাহিত্যিক মহলে একটি কথা প্রচলিত ছিল যে, ‘কবিতা পত্রিকায় যার কবিতা ছাপা হবে সে-ই বাংলা সাহিত্যে কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে।’ এই কবি স্বীকৃতি ফররুখকে কারো পেছনে লাইন দিয়ে লাভ করতে হয়নি; বরং নিজস্ব স্বকীয়তা আর একাগ্র সাধনা বলে তিনি তা অর্জন করলেন।
এরপর ফররুখ সনেটের বন্যা বইয়ে দেন বাংলা কাব্যে। অপূর্ব শব্দ প্রয়োগ, রূপকল্পের নিখুঁত ব্যবহার ও বিষয় নির্বাচনে সিদ্ধহস্ত ফররুখ আহমদ হন বাংলা কাব্য-সাহিত্যে সর্বাধিক সনেট নির্মাতা কবি।
‘কপোতাক্ষ নদের’ কবি মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে প্রথম সনেট রচনা করেন আর ফররুখ সে সনেট ভাণ্ডারকে পূর্ণতা দান করেন।
‘কবিতা’ পত্রিকার পর (মুসলিম পত্র-পত্রিকার বলয় অতিক্রম করে) ফররুখের কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’, প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত ‘অরণি’, হুমায়ুন কবির সম্পাদিত ‘চতুরঙ্গ’ এবং আফসার উদ্দীন আহমদ সম্পাদিত ‘মৃত্তিকা’ পত্রিকায়।


আরো সংবাদ



premium cement