১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রবীন্দ্রনাথ ও লালন ফকির

-

রবীন্দ্রনাথ যখন কুষ্টিয়া অঞ্চলে থেকেছেন তখন লালন ফকির ছিলেন এতদাঞ্চলে বাউল বা ভাবগানের একচ্ছত্র অধিপতি। তার পাশাপাশি পাগলা কানাইও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। পাগলা কানাইয়ের গান ছিল শব্দ এবং ধুয়া জাতীয়। রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের গান শুনে মুগ্ধ হন। তিনি লক্ষ্য করেন, লালনের গানে যে, ভাব-ঐশ্বর্য তা অন্যদের মধ্যে নেই। এ গানে উপমা এবং প্রতীকের ব্যবহার অতুলনীয়। এ গান মূলত সাধন-ভজনের গান হওয়াতে এবং সাধারণের নিকট এর অর্থ সহজবোধ্য না করার অভিপ্রায়ে নানা উপমা সৃষ্টি করা হয়েছে। দেহবাদী দর্শনকে আড়াল দিয়ে এ গানগুলোকে সাধারণের নিকট মাধুর্যমণ্ডিত করার জন্য যে প্রতীকী ব্যবহার করা হয়েছে তা যেমন অসাধারণ রসমাধুর্যে সরস হয়েছে তেমনি দেহকেন্দ্রিক প্রতীকী এবং উপমার সাহায্যে দীক্ষিত বাউলের নিকট তা অর্থবহ করে তোলা হয়েছে। এই রূপকের ব্যবহার লালনের গানকে অসাধারণ শিল্প এবং ভাবসমৃদ্ধ করেছে। যেমন-
(১)
লীলা দেখে লাগে ভয়
নৌকার উপর গঙ্গা বোঝায়
গঙ্গা ডাঙ্গা বয়ে যায়।।
(২)
চাঁদে চাঁদ ঢাকা দেওয়া
চাঁদে দেয় চাঁদের খেওয়া
জমিনে ফলছে মেওয়া
চাঁদের সুধা ঝরে।
(৩)
আঁখির কোণে পাখির বাসা
দেখতে পারি কী তামাসা
আমার এই আদম দশা
কে আর ঘুচায়।।
(৪)
চক্ষু আঁধার দেলের ধোঁকায়
কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়
কী রঙ্গ সাঁই দেখছে সদায়
বসে নিগুম ঠাঁই।।
(৫)
বাড়ীর কাছে আরশীনগর
সেথা এক পড়শী বসত করে
প্রতি গানেই এমন অসংখ্য উপমা এবং রূপকের ব্যবহার লালনের গানকে এক অপূর্ব শিল্পসুষমামণ্ডিত করেছে। এমনি আরেকটি গান :
কে কথা কয় রে দেখা দেয় না
নড়েচড়ে হাতে কাছে
খুঁজলে জনমভরে মেলে না।।
ডরষষরধস ডড়ৎফংড়িৎঃয:- ‘ঞযব ঈঁপশড়ড়’ কবিতার সঙ্গেই এর তুলনা দেয়া চলে। রবীন্দ্রনাথ খুব ছেলেবেলায় দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে কুষ্টিয়া এসেছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ১৫-১৬ বছর। সে সময় তিনি লালন এবং বাউলদের গান শুনেছিলেন। পরবর্তীকালে জমিদারির দায়িত্ব নেয়ার আগেও তিনি আরো কয়েকবার বেড়াতে এসেছিলেন। এরপর তার বয়স যখন ২২ বছর তখন তিনি তাদের পারিবারিক পত্রিকা ‘ভারতী’তে ‘বাউলের গান’ নামে একটি নিবন্ধ লেখেন। নিবন্ধটি ছিল ‘সঙ্গীত সংগ্রহ : বাউলের গাথা’ নামে একটি গ্রন্থের সমালোচনা। এখানে এই নিবন্ধের কিছু অংশের উল্লেখ করা হলো ।

সেই তরুণ বয়সে বাউলের গান যে তার মন কেড়েছিল তার বেশ প্রমাণ রয়েছে তাঁর আলোচনায়। রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন :
“ইহাকে দেখিলেই এমন আত্মীয় বলিয়া মনে হয় যে, কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া ইহাকে প্রাণের অন্তঃপুরের মধ্যে প্রকাশ করিতে দিই। তোমরা বাঙ্গালা বাঙ্গালা বলিয়া সর্বত্র খুঁজিয়া বেড়াইতেছ; সংস্কৃত, ইংরেজি সমস্ত ওলট-পালট করিতেছ, কেবল একবার হৃদয়টার মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া দেখ নাই... আমাদের ভাব আমাদের ভাষা আমরা যদি আয়ত্ত করিতে চাই, তবে বাঙালি যেখানে হৃদয়ের কথা বলিয়াছে, সেইখানেই সন্ধান করিতে হয়।”
বাউল গানের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই মমত্ববোধের সৃষ্টি তার প্রতিভার একেবারে উন্মেষলগ্নে এবং এ সময় তিনি তার চিন্তায় স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছিলেন। বাউল গানের প্রতি তার এই প্রীতিময়তার কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ বলেন :
“আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন তারা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদা দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলেচনা হ’ত। আমার অনেক গানেই বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউল সুর ও বাণী কোন একসময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়সশিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল
কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে
হারায়ে সেই মানুষ
তার উদ্দেশ্যে
দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।।
কথা নিতান্ত সহজ; কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এই কথাটি উপনিষদের ভাষায় শোনা গিয়েছে : ‘এতং বেদ্যৎ পুরুষং বেদ মা বো মৃত্যু’: ‘যাকে জানবার সেই পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণ বেদনা।’ অপণ্ডিতের মুখে এই কথাটি শুনলাম; তাঁর গেঁয়ো সুরে, সহজ ভাষায় যাকে সকলের চেয়ে জানবার তাকেই সকলের চেয়ে না জানবার বেদনা অন্ধকারে যাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু, তারই কান্নার সুর তার কণ্ঠে বেজে উঠছে। ‘অন্তরতর যদয়মাত্মা’ উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন ‘মনের মানুষ’ বলে শুনলাম, আমার মনে বড় বিস্ময় লেগেছিল। এর অনেককাল পরে ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয় থেকে এমন বাউলের গান শুনেছি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে নাতাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনি কাব্যরচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে। লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করিনে। ... আমাদের দেশে যারা নিজেদের শিক্ষিত বলেন, তারা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাদের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখিএ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা-সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়নি; এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষা ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কুরআন-পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।... বাংলাদেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা সকলের অগোচরে আপনা-আপনি কী রকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু-মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।”

রবীন্দ্রনাথ তার এই আলোচনায় বাউল গানের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথাই শুধু বলেননি- এ গানের বাণী ও সুরে যে আবহমানকাল ধরে হিন্দু-মুসলমান সকলকেই যে আনন্দ দিয়ে এসেছে এবং মিলনের সেতুবন্ধনের কাজ করে এসেছে সে কথাটিও অত্যন্ত জোরের সাথে বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ অপর এক স্থানে বলেন :
“...বাউলের গান শিলাইদহে খাঁটি বাউলের মুখে শুনেছি ও তাদের খাতা দেখেছি। নিঃসংশয়ে জানি বাউল গানে একটি অকৃত্রিম বিশিষ্টতা আছে, যা চিরকেলে আধুনিক। হাল আমলে কলেজে পাস করা ছেলে সেটি জাল করতে পারে না, সে তাদের ক্ষমতার অতীত। ইংরেজি পড়া বাউলের গান আছে, দেখেছি তা অস্পৃশ্য। আমার অনেক গান বাউল ধাঁচের, কিন্তু জাল করতে চেষ্টা করিনি, সেগুলো স্পষ্টত রবীন্দ্র বাউলের রচনা। কিন্তু ‘কাব্যপরিচয়ে’ যে বাউল গানগুলো আছে সে আমার মাথায় আসত না, লোক ঠকাতে গেলে নিশ্চিত ধরা পড়তুম।”
রবীন্দ্রনাথ বলেন :
“...সেই অজানা দুরধিগম্য হইলেও যেসব সত্যের মূল সত্য তাহা এই বিখ্যাত ইংরেজ কবি এবং এই অজ্ঞাত বাঙালি উভয়েই বুঝিয়াছেন। সেইজন্য তাহার গ্রামসঙ্গীত সেই অজানা পাখির ডানার সহিত মুখরিত। শুধু প্রভেদ এই যে, শেলীর ভাষা জনকয়েক শিক্ষিত লোকের জন্য, আর এই বাউল গান গ্রামের চাষি ও সর্বসাধারণের, যাহারা এই গানের অতিবাস্তবতায় অতিষ্ঠ হইয়া উঠে না।”
এই যে আমাদের বাউল গান এক দিন হাজার নারী-পুরুষের মনকে মুগ্ধ এবং বিমোহিত করেছিল আজ পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতির প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা ঘটা করে নাগরিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা পরিবেশন করতে গিয়ে সুরকে যেমন পাল্টিয়ে ফেলছি, তেমনি আধুনিক যন্ত্রপাতির সহযোগিতায় নগর-বাউলদের মাধ্যমে তা উপস্থাপন করতে গিয়ে মূল গানকে জগাখিচুড়ি এবং ‘কিম্ভূত’ করে ফেলছি। এতে আধুনিক মন তৃপ্ত হলেও মূল সুরের অপমৃত্যুতে আমরা এ গানের সাধকদের মনোকষ্টের কারণ হয়ে পড়েছি।


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশে মুসলিম কৃষকের ধানে আগুনকে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বলে প্রচার শিক্ষানুরাগী এস এম খলিলুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ সিরিয়ার নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেবে যুক্তরাষ্ট্র! ইতিহাসের প্রথম : ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক মাস্ক ২০৩৪ ফুটবল বিশ্বকাপ সৌদি আরবে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর সচল ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-হোয়াটসঅ্যাপ ভারতীয় মিডিয়াতে ইসকনের ওপর হামলার খবর ভুয়া : সিএ প্রেস উইং ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন মির্জা ফখরুল টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা ঢাকা সফর নিয়ে ভারতের এমপিদের ব্রিফ করলেন বিক্রম মিশ্রি রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন দুর্নীতি তদন্তে অগ্রাধিকার পাবে

সকল