শাস্তি
- শাওন আসগর
- ০৩ মে ২০২৪, ০০:০৫
এখানে এসেই প্রথম যে সমস্যাটিতে পড়লো মির্জা আলি আকন্দ তা হলো বাসার রান্নার জন্য লোক পাওয়া। এই তিন বছরে অন্তত ৯ জন মহিলাকে বদল করতে হয়েছে। কেউ কেউ রান্নায় তরকারিতে লবণ বেশি দিয়ে ফেলে, কেউ আছেন ঝাল এতোটা বাড়িয়ে দেন যে মুখে নেয়া যায় না। আবার কেউ আছেন রান্নাঘরটিকে বেশ নোংরা রেখেই তড়িঘড়ি করে চলে যান। মনমতো হয় না সব কিছু, তাই মির্জা আলি আকন্দের স্ত্রী এসব নিয়ে খুব মেজাজ গরম করে রাখেন।
মির্জা অবশ্য সব মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। বেশি রাগ এলে চুপচাপ বাইরে গিয়ে খেয়ে আসেন। কিন্তু ঘরে তো সে একা নন, অন্যদের জন্যও ব্যবস্থা করতে হয়। তখন টাকা খরচের বিষয়টি সামনে চলে আসে-এসব নিয়েও স্ত্রীর সাথে কুরুক্ষেত্র বেধে যায়- টাকা বেশি হইছে তোমার। দেশের অবস্থা দেখো না চারদিকে জিনিসপত্রের কী দাম টের পাও না? মির্জা যে এসব বুঝে না তা নয়। বাড়তি টাকা খসে গেলে কার ভালো লাগে? কিন্তু ঘরের কাজের মহিলা নিয়ে ঝগড়ার চেয়ে নীরবে বাইরের ব্যবস্থাই ভালো লাগে তার। এসব বিষয়ে স্ত্রীকে অনেকবার বলেছে। কোনো কিছুই তবু স্বাভাবিক হয় না। তার জবাব-কাজের মহিলা নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নাই। এটা পুরুষ মানুষের কাজ না। আমার কাজ, আমি সামাল দিমু।
আর কথা না বাড়িয়ে বই নিয়ে পড়ে থাকে মির্জা আলি আকন্দ। গেলো দু’বছর হলো চাকরি হতে অবসর নিয়েছে। পূর্বে মুখে দাড়ি ছিল না, সম্প্রতি মুখে দাড়ি ঝুলেছে বেশ বড় পরিসরেই। এটি তাকে ধার্মিক পরিচয়ের একটি মাপকাঠি ঝুলিয়ে দিলেও সে মূলত অতোটা ধার্মিক নয় কেবল শুক্রবার হলে নিজের যতœ করে রাখা ইস্ত্রি করা পাজামা পাঞ্জাবি পরে মসজিদের দিকে অলসভাবে অগ্রসর হয়। এ ছাড়া বলতে গেলে সারা দিনের বেশি সময় বই নিয়েই কাটিয়ে দেয় যেন মৃত্যু পর্যন্ত তার এই কর্ম ব্যতীত আর কোনো কর্ম বা উপায় নেই। কিন্তু ঝামেলা বাধিয়ে দেয় ফরিদা। ফরিদাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে গেল ছয় মাস হলো। ফরিদার গায়ের রঙ বেশ কালো। উপরের দাঁতের পাটি একটু বড় তাই কথা বলার সময় ভয়ঙ্কর লাগে দেখতে। যদিও সে সবসময় হাসিমুখে কথা বলে। কোনো দিন তার মন খারাপ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই ঘরের কনিষ্ঠ সন্তান ভয়ে ফরিদার পাশে ভিড়ে না কখনো।
ফরিদার অনেক গুণাবলি লক্ষ করা যায়। এই ক’বছরে যতগুলো মহিলা ছিল তাদের কাজ নিয়ে মির্জা আলি আকন্দও কম বলেনি। কারণ কিছু কিছু কাজ তো মির্জার সাথে রিলেটেড থাকে। যেমন শার্টের কলার ভালোভাবে পরিষ্কার করা, প্যান্টের দুই পাশের পকেটে, যেখানে সবসময় হাতের ছোঁয়া লেগে ময়লা লেগে থাকে সেসব এলাকায় নজর রেখে পরিষ্কার করা, কম্পিউটারের টেবিলের নিচে না মুছে চলে যাওয়া বা টেবিলের ওপর পড়ে থাকা প্রয়োজনীয় কোনো কাগজ সরিয়ে না রাখা-এসব নিয়ে মির্জাকে সতর্ক থাকতে হয়।
কিন্তু ফরিদা আসার পর থেকে এসব ঝামেলা থেকে সে অন্তত মুক্তি পেয়েছে। তাকে বলতে হয়নি। নিজেই আগ বাড়িয়ে তার কাজের বাইরে এসেও অনেক কিছু নিজের মনের তাগিদে করে দিত। যেমন সুযোগ পেলে বাইরে বারান্দায় ঝুলে থাকা ভেজা কাপড় ঘরে নিয়ে আসা, মেয়ের কক্ষের বিছানা বালিশ ঠিক করে দেয়া, ডাইনিং টেবিলের বাটি গ্লাস সঠিক স্থানে রেখে দেয়া। সে করত। মির্জা সবই নজরে রাখে আর তার প্রশংসা ফরিদার কাছে করে। স্ত্রীকে বলে তার প্রতি যেন কোনোভাবে বিরাগভাজন না হয়। প্রয়োজনে তাকে বখশিশ হিসেবে দশ বিশ টাকা দেয়া বা যাবার সময় তার হাতে কিছু উদ্বৃত্ত খাবার দেয়ার কথা বলে রাখে।
এমনো কিছু দিন গেছে, স্ত্রী হয়তো জরুরি কাজে বাইরে। ফরিদা এসে মির্জার সামনে দাঁড়াতো মুখ নিচু করে সভ্য ভদ্র মানুষের মতো। মির্জা তখন চাকরিকালীন সময়ের বস্ মুডে কথা বলে তার সাথে। ফরিদাদের বেশি আশকারা দিতে নেই। অফিসে যেভাবে পিওন গার্ডদের সোজা রাখতে গিয়ে একটু মুডি হতে হয়, ঘরের কাজের মহিলাদের জন্য মির্জা আলি আকন্দ সেই মুড অন করে রাখে। মুখ গম্ভীর করে গলা মোটা করে প্রশ্ন করে-হা ফরিদা বলো কী সমস্যা?
- ম্যাডাম তো নাই। আমিও ভুল করছি গতকাল কইতে। ঘরে তো কাঁচামরিচ পেঁয়াজ নেই। এখন লাগবো।
মির্জার মেজাজ খারাপের পূর্বেই ফরিদা আগ বাড়িয়ে বলে- যদি টাকা দেন আমি নিচে গিয়া নিয়া আসি।
ভালোই হলো। মির্জার এক সমস্যা, একবার ঘরে ঢুকে গেলে কোনোভাবেই আর বাইরে পাঠানো যায় না তাকে। প্রয়োজনে নিজের জরুরি ওষুধ শেষ হলেও পরের দিন সকালের অপেক্ষায় থাকে। ফরিদার দিকে না তাকিয়েই বলে -পেঁয়াজের দাম জানো? -জি জানি, দুই শ’ টাকা।
আর কোনো প্রশ্ন নয়। তাকে দু’শ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বিদায় করে আর বলে -দ্রুত আসতে হবে-এসেই আমাকে মসলা চা করে দিতে হবে।
ফরিদা চলে যায় এবং সত্যি মনে মনে যে সময় মির্জা নির্ধারণ করেছে তারও আগেই ফিরে আসে এবং ত্রিশ টাকা ফেরত দিয়ে বলে--এক কেজি পেঁয়াজ আর বিশ টাকার কাঁচামরিচ আনছি। মির্জা খেয়াল করে টাকা মারবার প্রবণতাও ফরিদার নেই। আসলে ফরিদা অনেক ভালো, তাই খুব পছন্দ তাকে। সে বুঝে ফেলে ঘরের মানুষ বেশি ঝাল খেতে পারে না। সে জানে কতটুক লবণ ও মসলা দিলে সবজি বা তরকারি সুস্বাদু হয়। তার সবজি নিয়ে সকালে নাশতা খেতে বসলে সত্যি প্রতিটা সকালেই মন উৎফুল্ল লাগে। শুধু কি তাই? তার রান্না করা তরকারিও বেশ ভালো লাগে ঘরের সবার। এই কয়েক মাসে তার রান্না নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই কারো।
কিছু কিছু সমস্যা তো থেকেই যায়। তা হলো ফরিদা সপ্তাহে ছুটি পায় একদিন। এটি তার ওপর ছেড়ে দেয়া আছে। প্রথম বলা হয়েছিল সে শুক্রবার ছুটিতে থাকবে। কিন্তু এই নিয়ম সে ধরে রাখতে পারেনি। মাঝে মাঝে সপ্তাহের ছুটি শুক্রবারের বদলে শনি বা বুধবারে কাটিয়ে দিয়েছে আর ঘরের ম্যাডামকে শান্ত রাখার জন্যই পরের দিন হাতে করে নতুন আলু বা জলপাই বা কলমি শাক নিয়ে ঘরে ঢুকতো। মির্জার স্ত্রীকে বলতো- ম্যাডাম এখানে অনেক দাম নেয়। আমি কামরাঙ্গীরচরে থাকি। ওখানে একটু সস্তা আর টাটকা পাওয়া যায় তাই নিয়া আইলাম।
মির্জা আলি আকন্দের স্ত্রী খুশি হতো খুব। তাকে দামটুকু মিটিয়ে দেয়ার আগেই ফরিদা বলে দিতো কত খরচ হয়েছে। তখন কোনো বাড়তি টাকা দিলেও নিতো না। মির্জা তো হাটবাজার করে সংসার চালায় তাই সহজেই বুঝতো এখানেও ফরিদার সততা রয়েছে। এসব অনেক কারণেই ফরিদার ওপর সংসারের সবার বিশ^াস আস্থা অটুট রয়েছে কয়েক মাস।
কিন্তু সব গুবলেট করে দিলো ফরিদা। গত পাঁচ দিন যাবৎ ফরিদা আসছে না। ওর মোবাইল বন্ধ। যোগাযোগের কোনো দ্বিতীয় পথ নেই। স্ত্রীর মেজাজ হানড্রেড এভাব। মির্জার হয়েছে সমস্যা, প্রথম দিন চলেছে ডিপে থাকা পূর্বের রান্না করা তরকারি দিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় দিনে শুরু হয়েছে বাইরের খাবার কিনে আনা। স্ত্রী খুব সকালে চলে যায় অফিসে ফিরে আসতে আসতে রাত হয়। পাঁচটায় তার ছুটি হলেও এই শহরের যানজটে পড়ে তার অফিসের গাড়ি। ঘরে ঢুকে রাত আটটা-নয়টায়। তখন মির্জা আলি আকন্দও বলে না স্ত্রীকে রান্নাঘরের আগুনের কাছে যেতে।
ফরিদা আসে না, তার কোনো খবর নেই। একবার মনে হয় হয়তো সে গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে গেছে আবার মনে হয় না তা কি করে হয়। ওখানে গেলে অবশ্যই বলে যেত। আরেকবার মনে হয় তার কোনো অসুখ হলো। মনে মনে উত্তর করে মির্জা--তাতেও পাঁচ দিন লাগতো না। তাহলে কি কোনো রোড অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। মির্জা ভাবে ফরিদার আসা যাওয়ার পথে তো বাস ট্রাক চলে না। শুধু রিকশা আর হোন্ডা। অবশ্য হোন্ডা গুণ্ডাদের চাকায় লেগে পড়ে যেতে পারে।
এই ক’দিনের অনুপস্থিতি ফরিদার রেখে যাওয়া সব ভালো ও সততার পরিচয় ভুলে যেতে বসেছে সবাই। এখন সবাই খুঁটে খুঁটে তার মন্দ কাজ বের করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এমনই অবস্থা হয়েছে যে তার কোনো মন্দ কাজ বা অনিয়ম খুঁজে পাচ্ছে না। একটা কথা মাথায় ভিড় করত মির্জার, ফরিদা প্রায়ই বলতো-আমি কাজে ফাঁকি দেই না। আমি ফাঁকি দিলে আল্লাহ আমারে ফাঁকি দিবো। শাস্তি দিবো।
সেই ফরিদা নেই পাঁচ দিন হয়ে গেলো।
অবশেষে ফরিদাকে পাওয়া গেলো মোবাইলে। কল রিসিভ করেই তার কান্না। সে জানালো তার ষোলো বছরের ছেলেটি গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। যেদিন ছেলে ফিরে আসবে সেদিনই পথিমধ্যে পুলিশ ছেলেটিকে অপজিশন কর্মী সন্দেহ করে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় গ্রেফতার করেছে। একমাত্র ছেলের খবর পেয়ে ফরিদা পাগলের মতো চলে গেছে গ্রামে কিন্তু যাওয়ার পথে তার মোবাইলটিও হারিয়ে যায়। সে জানায়, কোনো উপায় ছিল না তার। ছেলের জামিন হয়নি। হাইকোর্ট করতে হবে। সে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চায়। জানায় আগামীকাল আসবে।
মির্জা আলি আকন্দ অপেক্ষায় থাকে ফরিদার জন্য। ফরিদার সততা, তার নিষ্ঠাবান কর্মের কথা জানে ঘরের সবাই। তার প্রতি বিশ^াসও অটুট। কিন্তু ফরিদা এবং তার নিজের সংসারের সবার শাস্তির অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান করতে করতে নিজের বিছানার বালিশে মাথা কাত করে। রাতের চাঁদও হেলান দিয়েছে পশ্চিমের দিকে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা