১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বৈশাখ ও বাঙালি সংস্কৃতি

-

বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস বহু পুরনো। প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো এ সংস্কৃতির রয়েছে বহুমাত্রিক ধারা। বাঙালি দর্শন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রথা, উৎসব খুবই সমৃদ্ধ। বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে দর্শন, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য, খাবার, পোশাক, শিল্প, নন্দনতত্ত্ব, কাব্য, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, উৎসব, খেলাধুলা, গণমাধ্যম, পারিবারিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। বাংলা অঞ্চলে বর্তমানে সাতটি অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। এসবের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী বাউল সঙ্গীত, মঙ্গল শোভাযাত্রা, নববর্ষ, দুর্গাপূজা ও ইসলামী মূল্যবোধ অন্যতম। বাঙালির সংস্কৃতির প্রাণ হলো লোকসংস্কৃতি। এ লোকসংস্কৃতির ভিত্তিমূলে রয়েছে আদিবাসী সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো মরমি গান ও নবান্ন উৎসব। পরবর্তীতে নগর সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে। তবে নগর সংস্কৃতি যতই অগ্রগামী হোক না কেন বাঙালি সংস্কৃতির পরিমাপক সব সময় গ্রামীণ সমাজ। কৃষি জীবন ও নদ-নদী বাংলার সংস্কৃতিকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। গ্রাম বাংলা সংস্কৃতির উৎস। লোক দর্শন, লোকশিল্প, লোকবিশ্বাস, সম্প্রীতি, গ্রামীণ পালা পার্বণ, সহ-অবস্থান, সৌহার্দ, বঙ্গ লোকাচার, প্রবল জীবন প্রবাহ, প্রতিবাদী চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবিকতা বাঙালি সংস্কৃতির মৌলিক উপাদান বা বৈশিষ্ট্য। তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে, বাঙালি সংস্কৃতি অনেকটাই ধর্মনিয়ন্ত্রিত। সনাতন ধর্ম ও ইসলামী মূল্যবোধে আচ্ছাদিত বাঙালি সংস্কৃতির ধাঁচ। বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, পির-দরবেশদের দরগায় মানত, বন্দনা, ভক্তি, সমর্পণ ইত্যাদি ধর্মীয় অনুশাসনে সিদ্ধ। বাঙালি সংস্কৃতিতে পোশাক অনন্য ভূমিকা পালন করে। এখানে ধর্মীয় প্রভাব দেখা যায়। ধুতি, লুঙ্গি, চাদর, গামছা, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, শাড়ি বাঙালি পোশাকী ঐতিহ্য। বিভিন্ন খেলাধুলায় বাঙালি সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, কুস্তি, হাডুডুু ইত্যাদি বাঙালি সংস্কৃতির নির্দশন। বাঙালি সংস্কৃতি গ্রামীণ প্রধান হওয়ায় এবং কৃষিভিত্তিক হওয়ায় এখানে প্রচলিত হয়েছে বিভিন্ন রসালো ধাঁধা, প্রবাদ, প্রবচন, মরমি সঙ্গীত, কবি গান, মানব বন্দনা। লোকসংস্কৃতির ভেতর দিয়েই বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধান মিলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার ঋত্মিক। লোক সংস্কৃতির নানা উপাদান নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার ব্রতচারী আন্দোলন। দীনেশচন্দ্র সেন, চন্দ্রকুমার দে, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ, জসীমউদ্দীন, আশুতোষ ভট্টাচার্য বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতির সত্তার স্বরূপ উদঘাটনে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। বাউল সম্প্রদায়ের অনবদ্য কীর্তি বাঙালি সংস্কৃতির উন্নয়নে মহীরুহ হিসেবে কাজ করেছে। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি - এ গানটির জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শিলাইদহের গগন হরকরার বাউল গানের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। চারণ কবি মুকুন্দ দাশের স্বদেশী যাত্রা ও গান বাঙালিকে মুক্তি পাগল করেছিল। আমাদের দেশের নানা সংগ্রাম ও আন্দোলনের পশ্চাতে বাঙালি সংস্কৃতির অনন্য প্রভাব দৃশ্যমান। লৌকিক সমাজের কবি ও গায়কদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে এসব আন্দোলন আর সংগ্রামে। ভাষা আন্দোলনের গান বেঁধে এক বাউল কবি মহিন শাহ পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধেও এদের অসামান্য অবদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু এসব চারণ কবি, গায়ক ও লেখকদের খুব সম্মান করতেন।

সরলতা, প্রেম, দয়া, দানশীলতা, সহনশীলতা, আতিথেয়তা, মরমি চেতনা, প্রাকৃতিকতা বাঙালি সংস্কৃতির এক ধ্রƒপদী ধারা। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাউল দর্শন, বৌদ্ধদর্শন, হিন্দুদর্শন বাঙালি সংস্কৃতির পিলার বা স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেছে। মধ্যযুগে ইসলামের আগমনের ফলে সুফি দর্শন বিকশিত হতে থাকে যেটা মরমি চেতনায় সমৃদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে সুফিবাদ বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। রামকৃষ্ণ, শ্রী চৈতন্য, মহা প্রভু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তদেব, মহাবীর, শ্রীধর ভট্ট, সুফি সাধক শাহজালাল, বড়পীর, সৈয়দ আহমেদ শেরওয়ানি বাঙালি সংস্কৃতির মহীরুহ হিসেবে অবদান রেখেছেন। ইসলাম প্রসারের সাথে সাথে মুসলিম কবি, সাহিত্যিক, নেতা ও শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার শুরু করে। বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পয়লা বৈশাখ। এটি বাঙালিদের জাতীয় উৎসব, সর্বজনীন লোক উৎসব। পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়েছিল পুরান ঢাকার মুসলিম মাহফরাস সম্প্রদায়ের দ্বারা। মুসলিম সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষ বা বাংলা সন চালু করেছিলেন। বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল এবং ভারতে ১৫ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। বাঙালি দিনপঞ্জির সাথে বৈশাখের নিবিড় বন্ধন রয়েছে। অনেকের মতে, এটি শশাঙ্কের হাত ধরে এসেছে। তবে মুসলিম মোঘল সম্রাট আকবর এক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তার নেতৃত্বে ১৫৫৬ খ্রি: ১০ মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সাল গণনা শুরু হয়। আকবরের সময় থেকেই মূলত পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। তবে পয়লা বৈশাখ উৎসবটি ঐতিহ্যগত। আধুনিক নববর্ষ পালনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। আদিবাসীরা বর্ষবরণ (পানি উৎসব) করে থাকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে, যা বৈসাবী উৎসব নামে পরিচিত।
হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, এবং মুসলিমরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় উৎসবসমূহ অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে উদযাপন করে থাকে। কিন্তু এসব ধর্মের মানুষ একত্রে একটি উৎসবে যোগদান করে আর সেটা হলো পয়লা বৈশাখ। যেহেতু সব ধর্ম বর্ণের মানুষ এ উৎসবে যোগদান করে তাই এটিকে সর্বজনীন বা সাম্যবাদী উৎসব বলা যায়। এক মহা ভাতৃত্বের বন্ধন রচিত হয় বৈশাখী মঞ্চ থেকে। আমাদের সংস্কৃতির এক বিরাট সংযোজন হলো পয়লা বৈশাখ। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমতাসাধক, ধারক এবং বাহক হলো এ বৈশাখ। তাইতো কবি বলেছেন-
বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলিম, হিন্দু
নাহি ভেদ, নাহি ছেদ যেন একবিন্দু।
কিন্তু এ বৈশাখী উৎসব নিয়ে কিছু গোড়া, অন্ধ এবং উগ্রবাদী গোষ্ঠী অপপ্রচার দৃশ্যমান যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। রমনার বটমূলে হামলা শুধু বৈশাখী উৎসবের উপরেই ছিল না, এটি ছিল সাংস্কৃতিক সমতার উপরে এক বিরাট আক্রমণ। যে সাম্যবাদকে বৈশাখ ধারণ করে সেটাকে ভিন্ন খাতে পরিচালিত করা চেষ্টা বারবার দেখা গেছে। কিন্তু কেন? বৈশাখতো একটি শান্তিপূর্ণ উৎসব। এ উৎসবটি রাষ্ট্রের সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এ উৎসবটি হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রমাণ করে দিয়েছে মানুষের সাথে মানুষের বৈষম্য নেই। বৈষম্যহীন দর্শনই যে বৈশাখের প্রাণ। বৈশাখকে আপাতত দৃষ্টিতে একটি উৎসব বা বিনোদন মনে হলেও এর রয়েছে আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। বৈশাখকে ঘিরে গ্রাম বাংলার কুটিরশিল্পে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। বৈশাখী মেলায় বিভিন্ন পণ্যের বিক্রি হয়ে থাকে, যা আমাদের অর্থনীতির চাকার গতিকে আরো মসৃণ করে। বৈশাখী উৎসবের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারি চাকরিজীবীদের বৈশাখী ভাতা চালু করা হয়েছে। এর ফলে চাকরিজীবীরা আর্থিকভাবে কিছুটা হলেও সুবিধাপ্রাপ্ত হোন। উৎসব ভাতার এ টাকা চলে যায় মার্কেটে। বৈশাখী নানান সাজের পোশাক শিশু, কিশোর ও মহিলারা কিনে থাকে। বৈশাখী মেলায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কিছু অর্থ উপার্জনের সুযোগ পান। এছাড়াও হালখাতা করে গ্রামের ব্যবসায়ীরা তাদের বকেয়া তুলে নেন। দেনাদারকে মিষ্টিমুখ করিয়ে বকেয়া আদায়ের এ উদার সংস্কৃতি তো বৈশাখেরই উপহার। খাবার ব্যবসায়ীরাও দারুণ ব্যবসা করার সুযোগ পান এ দিনে। এটা তো গেলো বৈশাখের আর্থিক দিক। বৈশাখের সামাজিক মূল্য অপরিসীম। একটি সমাজে বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিভিন্ন আদর্শের মানুষ বাস করে। কিন্তু বৈশাখ এমন একটি উৎসব যেখানে শিশু-কিশোর, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, বনিতা, ধনী, গরিব সবাই একসাথে একই উদ্দেশ্য নিয়ে যোগদান করে। ধনী, গরিব, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ শিশুরা একই নাগরদোলায় চড়ে দোল দেয় এবং একই সুরে আনন্দ চিৎকার করে। এর ফলে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়। বৈশাখের সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে অনেক ভিন্নমত পোষণ করেন কিন্তু এর মাঝে যে সাম্যের সুর লুকিয়ে আছে সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মঙ্গল শোভাযাত্রা একত্বের প্রতীক, সমতার প্রতীক, ঐক্যবদ্ধ সংস্কৃতির প্রতীক। বৈশাখ বছরে একবার আসে, কিন্তু এটি সারা বছরের গণ-আনন্দকে ত্বরান্বিত করে। বৈশাখের সাহিত্য মূল্য বহুমাত্রিক। বৈশাখ নিয়ে রচিত কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, গান বাংলা সাহিত্যের একটি ক্রনিক সংযোজন। এ দিবস এবং উৎসবকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনন্য কাব্য ও গান রচনা করেছেন। বৈশাখ এমন একটি উৎসব যেটাকে রাজনীতিকীকরণের সুযোগ নেই। এটি গণমানুষের উৎসব। পান্তা ইলিশ দিয়ে সকাল শুরু করার রেওয়াজ বহু পুরনো। বাঙালি যে আনন্দ করতে জানে শত কষ্টের মধ্যেও বৈশাখ তার বড় প্রমাণ। সব কষ্টকে পিছে ঠেলে আনন্দ স্রোতে ভাসতে চায় বাঙালি। বৈশাখ মনের কষ্টকে একদিনের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয়। বৈশাখের বহুমাত্রিক অবদান বাঙালি জীবনকে করে তোলে অর্থবহ এবং প্রাণরসে ভরপুর। সম্রাট আকবর এ দিবসটি চালু করেন বাঙালি সংস্কৃতিকে অধিকতর সমৃদ্ধ করতে। বৈশাখের সাথে বাংলা ভাষার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলা ভাষাভাষী মানুষরা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে নতুন কিছু হওয়ার আশা নিয়ে। ভারত ও বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষের কাছে এ দিন বড়ই আনন্দের। ভাষা একটি সংস্কৃতিকে ডোমিনেট করে। বাংলা ভাষা তাই বৈশাখের প্রাণ। মাতৃভাষায় রচিত লোকসঙ্গীত বৈশাখকে দিয়ে থাকে এক ভিন্নরূপ। বৈশাখে বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মিষ্টি আর পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। বৈশাখে অতিথি আপ্যায়ন করা বাঙালিদের একটি বড় রেওয়াজ। বৈশাখের প্রায়োগিক দিক যেমন আছে তেমনি আছে এর প্রতীকী দিক। বৈশাখের সাথে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। যদিও কেউ কেউ বিরোধ খোঁজার চেষ্টা করে থাকেন। এ ধরনের লোক সব কালেই থাকে। দুধ ভাতেও কাঁটা খোঁজার কিছু লোক থাকে। তাতে কিছু যায় আসে না। বৈশাখ শান্তির প্রতীক, সাম্যের প্রতীক, শুদ্ধতার প্রতীক। বৈশাখ এমনই এক আয়োজন যেটার মূল সুর হলো সবার উপরে মানুষ সত্য। বাংলাদেশের অন্য কোনো উৎসব সব মানুষকে একত্র করতে পারে না, কিন্তু বৈশাখ সেটা খুব সহজেই পারে। বৈশাখ একটি অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন লোক উৎসব। বৈশাখ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলেছে।২০১৬ সালে ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। ইউনেস্কো এটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বৈশাখ সেই সাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে আঘাত হানে। পাকিস্তান রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচারকে নিষিদ্ধ করে সাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিয়েছিল। কিন্তু বাঙালি সেটা মানেনি। বৈশাখ উদযাপন করে সেটার প্রতিবাদ করেছে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজিয়ে এর প্রতিবাদ করা হয়। ১৯৬৫ সালে ছায়ানট ১৫ এি প্রল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো বাজিয়ে এবং গেয়ে বৈশাখকে বরণ করে নেয়া হয়। আর এর মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রকাশ পায়। হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির এক দারুণ মেলবন্ধন তৈরি হয়। বৈশাখ নিয়ে অপপ্রচার কম হয়নি কিন্তু বৈশাখের গায়ে এটি একটুও আঁচড় কাটতে পারেনি। বৈশাখ কখনোই গোষ্ঠী চেতনায় বন্দী হয়নি।

মুক্ত চেতনার ধারক ও বাহক হিসেবেই থেকে গেছে। যাহোক বাংলা বর্ষবরণ বাঙালি ঐতিহ্যের একটি বড় অংশ। মহাসমারোহে, সাড়ম্বরে, উৎসাহ এবং উদ্দীপনার মাধ্যমে এ দিনটিকে বাঙালি স্মৃতির পাতায় রেখে দিতে চায়। নতুন বছরের উদযাপনের সাথে গ্রামীণ জীবন, কৃষ্টি, সংস্কৃতির নব নব বন্ধন তৈরি হয়। উৎসবের এ দিনে ঘর সাজানো, নতুন পোশাক পরা, বিভিন্ন ধরনের পিঠা, পায়েস, মিষ্টি আর খাবার তৈরি করা, আপ্যায়ন করা, দল বেঁধে মেলায় যাওয়া, অনুষ্ঠান উপভোগ করা, খেলার আয়োজন করাসহ নানা রীতি আর রেওয়াজে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে বাংলা মাসের এ প্রথম দিনটি। নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তিসহ নানান খেলায় মেতে উঠে গ্রামের মানুষ। আদিবাসীরা বর্ষবরণ একটু ভিন্ন আঙ্গিকে করে থাকে। তারা বৈসাবি উৎসব করে থাকে। মারমা সম্প্রদায় বৈশাখে পানি উৎসবে মেতে উঠে। যাহোক সমগ্র বাংলায় বৈশাখী মেলা ভাতৃত্বের এক নব ব্যঞ্জনা তৈরি করে। অনেকে আবার টক ও তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা বর্জন করে প্রতীকীভাবে। ছোটরা বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে এ দিনে যার ফলে তৈরি হয় শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালোবাসা আর সম্প্রীতির বন্ধন। শুধু বাংলাদেশ আর ভারতেই নয়, প্রবাসী বাঙালিরা বৈশাখ উদযাপন করে বিশ্বের নানা প্রান্তে বসে। বিদেশীরা প্রবাসীদের এ উৎসবে যোগ দেয় এবং বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত হয়। বৈশাখ আমাদের সবার। কোনো ধরনের হীনস্বার্থে আমরা যেন এর গায়ে কলঙ্ক না লাগাই।


আরো সংবাদ



premium cement