২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

একমুঠো শিউলি

-


সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে মনটা ভালো হয়ে গেল মেহেদির। জানালার পাশে কতগুলো শিউলি ফুল ছড়িয়ে আছে। গতকালও রাখা ছিল। তখন এতটা ভাবেনি মেহেদি। আজ আবার তাজা ফুলগুলো দেখে বুঝতে পারল- নিশ্চয়ই কেউ ইচ্ছে করে রেখে গেছে। কিন্তু কে রাখল? চাকরি সূত্রে সে এই শহরে এসেছে মাত্র কয়েক দিন হলো। তার শিউলি ফুল পছন্দ এটিই বা কে জানে এখানে?
ফুলগুলো হাতে নিয়ে বসে ভাবতে লাগল সে। ভেবে কিছুই মেলাতে পারল না। বাড়িওয়লাকে জিজ্ঞেস করতে চাইল কিন্তু লজ্জায় তাও পারল না। পুবের সূর্য কিন্তু ভাবনায় মেহেদির সাথে বসে রইল না; বরং নিজের গতিতে আলো ছড়িয়ে তার অস্তিত্ব জানিয়ে দিতে লাগল সবুজ পৃথিবীতে।
হঠাৎ অফিসের কথা মনে হতেই মেহেদি উঠে পড়ল রেডি হওয়ার জন্য। নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে গিয়েও সে কাজে মনোযোগ দিতে পারল না। তার মাথায় কেবল একটি কথাই ঘুরছে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছে শিউলি ফুল।

বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মামার বাড়িতে থাকত তারা। সেখানে বড় একটি শিউলি ফুলের গাছ ছিল। প্রতিদিন সকালে পাশের বাড়ির নীতু আসত শিউলি ফুল কুড়াতে। একসাথে হেসে খেলে বড় হলো তারা। সেই থেকে নীতুর সাথে দেখা হতো রোজ। একটু একটু করে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হলো দু’জনের মধ্যে। নীতু ছিল ফর্সা, পাটখড়ির মতো শুকনো তার শরীর। চেহারাটা ছিল ভারী মায়াবী। লম্বা লম্বা হাত দুলিয়ে হাঁটার সময় মাথা নেড়ে যেত। নীতু এখন কোথায় তা সে জানে না। শুনেছিল নীতুর বিয়ে হয়ে গেছে। তখন ছিল মেহেদির ছাত্রাবস্থা। নীতুকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পালিয়ে যাওয়ার সাহস তার হয়নি। সে জন্য কাপুরুষের খাতায় তার নামটা উঠে গেছে।
অফিস ছুটির পর বাড়ি ফিরছিল মেহেদি। বাসার কাছাকাছি আসতেই শুনল কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে। কাছে এসে নীতুকে দেখেই অবাক হলো সে।

-আমি ভাবতেই পারিনি এই শহরে তোমাকে দেখব। এখানে কোথায় এলে?
আমার ছোটকাকার শ্বশুরবাড়িতে। ওই যে দোতলা বিল্ডিংয়ে।
কিছু ঝামেলার কারণে কয়েক দিন হলো কাকীর সাথে এলাম।
-দুদিন আগে তোমাকে দেখলাম, তুমি বোধহয় অফিসে যাচ্ছিলে।
-তাহলে শিউলি ফুল তুমিই রেখেছিলে আমার জানালার পাশে?
জি, জনাব।

এই শরতে তোমায় পেলাম শিউলি ফুলের সাজে,
যতই দূরে থাকো তুমি আছো হৃদয় মাঝে।
-বাহ কবিতা তাহলে তোমাকে ছেড়ে যায়নি।
এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা দৃষ্টিকটু তাই ফোন নম্বর দেয়া নেয়া করে দু’জনেই রাস্তা থেকে বিদায় নিলো।
সন্ধ্যার পর মেহেদিকে নীতুই ফোন করল। ওর কথায় জানতে পারল সংসারে নীতু ভালো নেই। দুটো বাচ্চা রেখে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। ঝগড়া ও ঝামেলা করে শ্বশুরবাড়ি ছেড়েছে সে। মেহেদিকে পাগলের মতো খুঁজেছে কিন্তু পায়নি।
মনের দুঃখে মেহেদি দূরের শহরে চাকরি নিয়েছিল।
নীতুর মন খারাপ দেখে ছোট চাচী তার বাবার বাড়ি বেড়াতে নিয়ে এলো। নীতুর শেষ কথায় মেহেদি চিন্তায় পড়ল।
-আমি হয়তো আত্মহত্যা করতাম। তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর বাঁচতে ইচ্ছে করছে।
এটি কী বলল নীতু! বর্তমানকে পাশ কাটিয়ে অতীতকে বর্তমান করতে চাইছে। তাহলে কি দেখা হয়ে বড় কোনো ভুল হয়ে গেল? কাকে বলবে সে এই কথা?

সুখ যদিও ভাগ করা যায়, দুঃখ ভাগ করার মানুষ সমাজে অপ্রতুল।
ভাবতে ভাবতে রাতে ঠিকমত ঘুম হলো না মেহেদির। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। জানালার সামনে আজো শিউলি ফুল রাখা।
তাহলে নীতু আজও এসেছিল!
আবার একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো মেহেদি। প্রথমে নীতুর ফোন নম্বর ব্লক করে দিলো। দ্রুত এই বাসাটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হবে সে। এত কথার মধ্যে কাল মেহেদির বিয়ের কথাটি জানাতে পারেনি। নীতুও এতটা অস্থির ছিল, সে ভাবেনি মেহেদির জীবনে নতুন কেউ এসে গেছে।
নীতুর মুখোমুখি হয়ে এই কথা বলার সাহস তার নেই। জীবনের স্রোত তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। পালিয়ে গিয়ে বাঁচা কষ্টকর তবু তাই করতে হবে। ভাবুক, নীতু তাকে কাপুরুষই ভাবুক। ঝরা শিউলির মতো ঝরে গেছে তাদের সম্পর্ক। মুঠোভর্তি করে যতই ফুলগুলো আদর করুক, ওরা শুকিয়েই যাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement