৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

লোকসাহিত্যের একজন ফেরিওয়ালা

-


মানুষে মারে মানুষ
মানুষেই করে তার বিচার,
মানুষের খাঁচায় মানুষ বন্দী
মানুষই তার পাহারাদার।
--তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল
(জন্ম: ১৪ এপ্রিল ১৯৫১ - মৃত্যু : ৩ ডিসেম্বর ২০১৩)

শখের বসে গল্প, কবিতা, নাটক লেখার চেষ্টা করা যায় কিন্তু গবেষণার কাজ করা যায় না। স্কুলজীবনেই শখের কাজটা সেরে ফেলেছেন তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল। মঞ্চ নাটক লেখা এবং অভিনয়ে অনেক পারদর্শী ছিলেন তিনি। ছাত্রজীবনেই সহপাঠীদের নিয়ে গড়ে তোলেন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘নবারুণ কৃষ্টি সংসদ’। এই সংগঠন থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ‘নবারুণ’ সম্পাদনা করেছেন নিয়মিত। একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিতি ঘটে হবিগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দানকারী কবি দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা, অধ্যাপক নিখিল ভট্টাচার্য, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, সৈয়দ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, কবি পার্থ সারথি চৌধুরী প্রমুখ সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তিবর্গের সাথে।
গানের প্রতি খুব বেশি আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। ছাত্রজীবনেই সাথে রেডিও নিয়ে ঘুর বেড়াতেন, গান শোনার জন্য প্রতিনিয়ত তার মনের পিঞ্জিরা ছটফট করত। স্থানীয় সুরবিতানে উস্তাদ মো: বাবর আলী খানের কণ্ঠে প্রায়ই শুনতেন আধ্যাত্মিক গান, আর এই গানই তাকে লোকসাহিত্যের ফেরিওয়ালা বানিয়ে দেয়। ছুটে চলেন আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হবিগঞ্জ জেলার গ্রামে-গঞ্জে, সংগ্রহ করেন মরমী কবি ও সাধকদের লেখা কালজয়ী সৃষ্টি। আর সবাইকে এক মলাটে আবদ্ধ করেন তার প্রথম সম্পাদিত ‘হবিগঞ্জের মরমীসাধক’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থে হবিগঞ্জ জেলার ২০ জন সাধকের সৃষ্টি ও জীবনবৃত্তান্ত খোলাসা করে প্রকাশ করেন।


হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার ভাদিকারা গ্রামের মরমী সাধক ও পুঁথিসাহিত্যের প্রাণপুরুষ শেখ ভানুর জনপ্রিয় গান ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা, নিশীথে যাইও ফুলবনে’ কখনো রাধারমণ দত্ত ও পল্লীকবি জসীমউদ্দীন এর রচিত হিসেবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল সব মতানৈক্যের ভেদ ভেঙে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন এই গানের মূল স্রষ্টা উনিশ শতকের ক্ষণজন্মা মরমী দার্শনিক গীতিকবি শেখ ভানু শাহ। সদাহাস্যোজ্জ্বল ও পরিশ্রমী লোকগবেষক হিসেবে তার উপস্থিতি ছিল সরব।
তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল ১৯৫১ সালে হবিগঞ্জ জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃষ্টিনন্দন চুনারুঘাট উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তরফদার বংশোদ্ভূত দেউল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুহাম্মদ ইসহাক তরফদার, মাতা সৈয়দা ছালেমা খাতুন।
সংসার, পরিবার, পরিজন নিয়ে সুখী সমৃদ্ধ তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল লোকসাহিত্যকে আত্মস্থ করেছেন পরম যত্ন সহকারে। একটি অঞ্চলের লোক ইতিহাস ঐতিহ্যকে জাতীয় ভাবে উপস্থাপন করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আর এই সব কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় জাতীয় পরিমন্ডলে লোকসাহিত্যকে যারা আগলে রেখেছেন সেসব কিংবদন্তির সাথে।


লোকগবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী, দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, লোকসঙ্গীত শিল্পী মুস্তফা জামান আব্বাসী, অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকার, অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদ্দর আলী, অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা প্রমুখ শ্রদ্ধাভাজনদের সাথে। উনাদের অনেকের সাথেই লোকসাহিত্য নিয়ে মাঠে ময়দানে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। মুস্তফা জামান আব্বাসীর উপস্থাপনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের একসময়ের জনপ্রিয় লোকসাহিত্যের অনুষ্ঠান ‘ভরা নদীর বাঁকে’ একজন তথ্য সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন।
তিনি ১৯৭২ সালের প্রতিষ্ঠিত হবিগঞ্জ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের (সুরবিতান) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্মসম্পাদক পরবর্তীতে প্রায় ছয় বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে হবিগঞ্জের সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের সবাইকে এক করে বিষয়ভিত্তিক মাসিক সাহিত্য আড্ডা আয়োজন করতে বাইসাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন শহরে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। হবিগঞ্জ পৌরসভা ও জেলা প্রশাসক কর্তৃক আয়োজিত বইমেলায় বিশাল বইয়ের সম্ভার নিয়ে অংশগ্রহণ করতেন একজন তরুণের মতো। চাকরি থেকে অবসরের পরে লোকসাহিত্যকে প্রাধান্য দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তোলেন একটি লাইব্রেরি।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘হবিগঞ্জের মরমী সাধক’ ১৯৮৯, ‘হবিগঞ্জের পুঁথিসাহিত্য’ ১৯৯৮, ‘ভাষা আন্দোলনে হবিগঞ্জ’ ২০০০, ‘সুফি দার্শনিক কবি শেখ ভানু’ ২০০৪, ‘অধীন শেখ ভানু বলে’ ২০০৫। সম্পাদনা গ্রন্থ ‘হবিগঞ্জ পরিক্রমা’ যৌথ ১৯৯৪, ‘রক্তধ্বনি’ ১৯৯৪, ‘বিজয়ণ্ঠ' ১৯৯৪, ‘একুশিকা’ ১৯৯৬ ‘সুপঞ্চমী’ ১৯৯৭, উস্তাদ বাবর আলী খান স্মারকগ্রন্থ ২০০৮ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা’ ২০১৩ প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অপ্রকাশিত গ্রন্থ ‘আমার জেলা হবিগঞ্জ’ (গবেষণাগ্রন্থ), ‘খোয়াইপাড়ের কিসসা’ (গবেষণাগ্রন্থ), ‘মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ’ (গবেষণাগ্রন্থ)।
তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনমুখী কাজের অবদানের জন্য পেয়েছেন বেশ কিছু সম্মাননা পদক।
২০১৩ সালের ৩ ডিসেম্বর লোকসাহিত্যের গবেষক তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। একজন গবেষক হিসেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : উপদেষ্টা কুষ্টিয়ায় আটক বাংলাদেশী নাগরিককে বিজিবির কাছে হস্তান্তর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে আবু সাঈদসহ জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে দেশে ইসলামি পরিবেশ আসবে : খলীল আহমদ কাসেমী আলোকচিত্রে জলবায়ু সহনশীলতার সাহসী গল্প গাজীপুর জেলা পরিষদ থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের সহায়তা প্রদান বেতাগীতে নয়া দিগন্তের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা আবারো সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্ধেক ভোটার : জরিপ স্বর্ণের দামে নতুন রেকর্ড ডেঙ্গুতে আরো ৪ জনের মৃত্যু

সকল