২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জমিদার আজিম চৌধুরী জেগে থাকে স্মৃতিরা

ড. আশরাফ পিন্টু
-

মুসলিম জমিদারদের মধ্যে প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন পাবনার সুজানগর উপজেলার দুলাই গ্রামের আজিম উদ্দিন চৌধুরী। তার প্রকৃত নাম ফখরউদ্দিন আহলে আহসান আজিম চৌধুরী। তবে তিনি সবার কাছে ‘আজিম চৌধুরী’ নামেই সমধিক পরিচিত। তার বাবা রহিমুদ্দিন চৌধুরী ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি এখনো জমিদার বাড়িতে বিদ্যমান। আজিম চৌধুরীর উত্তরসূরি আহসানজান চৌধুরীর মতে, মসজিদটির নির্মাণের সময় আজিম চৌধুরীর বয়স ছিল ১০-১২ বছর। তিনি প্রায় ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সেই মোতাবেক আজিম চৌধুরী আনুমানিক ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। এ ছাড়া আজিম চৌধুরীকে নিয়ে ১২৯৮ হিজরিতে (১৮৭৭খ্রি.) রচিত হাজী বদরউদ্দিনের ‘আজিম চৌধুরী’ নামক পুস্তিকাতে লেখকের সাক্ষাতের কথা পাওয়া যায়Ñ
আমি ও পটু মিয়া চাচা বাড়ি থাকি।
মছজেদে পড়িয়া কত হইয়াছি সুখী॥
লতিফুল্লা মিয়া সঙ্গে থাকিয়া হামেসা।
চৌধুরী আজিমের কত পাইয়াছি ভালোবাসা॥
এ কবিতার উদ্ধৃতি থেকেও প্রমাণিত হয় আজিম চৌধুরী ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দেও জীবিত ছিলেন।
জমিদার আজিম চৌধুরীর পূর্বপুরুষ মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ থেকে পাবনায় আসেন। তার বাবা রহিমুদ্দিন মুন্সি আরবি-ফারসিতে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি নাটোররাজের অফিসে নকল-নবিশের কাজ করতেন। কাজের দক্ষতার জন্য তিনি সেখান থেকে ‘মুন্সি’ খেতাব লাভ করেন। তিনি পাবনার দুলাই জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তার একমাত্র ছেলে আজিম চৌধুরীর আমলেই জমিদারির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। এই খ্যাতিমান পুরুষ তার সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ও প্রজ্ঞা দিয়ে তৎকালে ওই এলকায় জমিদারিত্ব করার পাশাপাশি দুলাইতে ২-৩টি নীলকুঠি স্থাপন করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল জমিদারির আয়ের সাথে নীলকুঠির আয় যোগ হলে একসময় তিনি সীমাহীন অর্থবিত্তের মালিক হন। আর মূলত সেই সময় থেকেই তার জমিদারিত্বের উত্থান এবং সুনাম পাবনাসহ আশপাশের জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
আজিম চৌধুরী খুবই শৌখিন ছিলেন। তিনি দুলাই নিভৃত পল্লীতে চারতলা বিশিষ্ট একাধিক দৃষ্টিনন্দন বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেন। এসব ভবন বহু কক্ষ ও বহুদুয়ার বিশিষ্ট। ৪০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বাড়িটিতে ছিল ১১টি নিরাপত্তা গেট। প্রথম গেটে নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক ২টি হাতি থাকত। সামগ্রিক নিরাপত্তায় দু’টি কামানও বসানো ছিল। অন্য জমিদারদের আক্রমণের নিরাপত্তা সুরক্ষায় বাড়ির চতুর্দিকে বিশাল দীঘি কাটা হয়। বাড়িতে দেশী-বিদেশী প্রচুর গাছের বাগান করা হয়। বাড়িটির মূলভবন, মসজিদ, পুকুর, হাতিশাল, ঘোড়াশাল, কাঁচারি বাড়িসহ প্রাসাদের আয়তন ছিল প্রায় ৭০০ বিঘা। বর্তমানে জমিদার বাড়ির প্রাচীন মসজিদ ও পুকুরগুলো প্রায় অক্ষত থাকলেও বাড়ির ভবনগুলো ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে।
আজিম চৌধুরী নিজেও অনেক স¤পত্তি দান করেন। তার জমির ওপরই আজো সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। হাজী বদরউদ্দিনের ওই পুস্তিকায় আজিম চৌধুরীর প্রজাহিতৈষী ও দানশীলতার কথাও জানা যায়Ñ
চৌধুরী ফখরউদ্দিন নামটি যাহার।
ওরফে আজিম উদ্দিন চৌধুরী প্রচার॥
বিশ্বাস ও ভক্তি মূলে উপরে তোমার।
প্রবল প্রতাপে থাকি জগৎ মাঝার॥
প্রজা বন্ধু দয়াবান হইয়া আজিম।
দানধ্যানে পুণ্য লভিতে তাজিম॥
ফিটিং আদি টমটমে চড়িছে যখন।
সিকি ও আধুলি পয়সা করেছে জোটন॥
সামনে অর্থের তোড়া রাখি সাজাইয়া।
গরিবে করিত দান গাড়ি আহরিয়া॥
শুনিয়া গরিব-দুঃখী আনন্দে মাতিয়া।
সড়কের দুইধারে রহিত সাজিয়া॥
মুখেতে সুখের বোল জয় জয় রব।
আসিছেন মহাপ্রভু দুঃখীর বান্ধব॥
আসিবে কাঙাল-পালক আজিম এখন।
ভিক্ষা দিবে মনমতো করি বরিষণ॥...
আজিম চৌধুরীর ইংরেজদের সাথে তেমন সুসম্পর্ক ছিল না। এর মূল কারণ তিনি সিপাহি বিদ্রোহের সময় (১৮৫৭ খ্রি.) বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেন। অথচ তার সমসাময়িক পার্শ্ববর্তী তাঁতিবন্দের জমিদার বিজয়গোবিন্দ বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সহযোগিতা করে তাদের আশীর্বাদপুষ্ট হন। ফলে বিজয়গোবিন্দের সাথে আজিম চৌধুরীর বন্ধুত্বের ফাটল ধরে। এ সুযোগে ইংরেজরা আজিম চৌধুরীকে নানাভাবে উৎপীড়ন করেন। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানিকে খাজনা না দেয়ার কারণে ইংরেজরা তাকে বিদ্রোহী আখ্যা দিয়ে দমনের জন্য সশস্ত্রবাহিনী পাঠায়। এ সময় আজিম চৌধুরীর সাথে তাদের যুদ্ধ হলে তিনি পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে প্রাসাদের সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে পালিয়ে বজরায় চড়ে কলকাতার নিকটবর্তী ফ্রেন্স চন্দননগরে আশ্রয় নেন। সেখানে ১৫-২০ বছর অতিবাহিত করে পাবনা শহরে বাকি জীবন কাটান। তার কবর এখনো শহরের ফায়ার ব্রিগেডের পাশে নিজবাড়িতে সুরক্ষিত আছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement