১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এক আলোকবর্তিকা মওলানা আকরম খাঁ

-

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলাদেশ এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম চিন্তক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক ও সুপণ্ডিত। তিনি দখলদার ব্রিটিশবিরোধী আজাদি আন্দোলন, অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সম্মুখ সারির নেতা ছিলেন। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি বাংলাদেশ এবং কোলকাতায় সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়। বরেণ্য গীতিকবি কে জি মোস্তফা মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে ‘মুসলিম সাংবাদিকতার জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ৭ জুন ১৮৬৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট মৃত্যুবরণের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মওলানার দীর্ঘ এক শ’ বছরের পুরো জীবনই ছিল অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ ও সাফল্যে ভরপুর। সম্ভবত এ জন্যই ড. এনামুল হক মওলানাকে ‘এক শতাব্দীর জীবন্ত প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
১৯০০ সালে পড়াশোনার ইতি ঘটিয়ে মওলানা আকরম খাঁ কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তাঁর সমগ্র কর্মজীবন ছিল জাতীয় স্বার্থে। কর্মজীবন শুরু করেই তিনি বাঙালি মুসলমানের ভঙ্গুর অবস্থানÑ প্রকাশনা শিল্পের প্রতি জোর দেন। ১৯০৩ সালে মওলানার সম্পাদনায় মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯১৩ সালে তাঁর প্রচেষ্টায় ‘আনজুমানে ওলামা’ গঠিত হয় এবং এর মুখপত্র হিসেবে ১৯১৫ সাল থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক ‘আল এসলাম’। ১৯২০ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় উর্দু দৈনিক ‘জামানা’। দৈনিক ‘সেবক’ পত্রিকার প্রকাশ শুরু করেন ১৯২১ সালে। মওলানা আকরম খাঁ রাজনৈতিক জীবনের প্রথমে কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী ও নেতা ছিলেন। কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে জোরালো সম্পাদকীয় লেখার অপরাধে এক বছরের কারাদণ্ডও ভোগ করেন। ১৯২৯ সালে নেহরু রিপোর্টের প্রতিবাদে মাওলানা স্থায়ীভাবে কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
বাংলার অবহেলিত মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে ১৯৩৬ সাল থেকে তিনি প্রকাশ করা শুরু করেন বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক ‘আজাদ’। মওলানা আকরম খাঁ পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের পক্ষে জনমত সংগ্রহ এবং ‘আজাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করার মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৭ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই পদে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেন। মওলানার এই ভূমিকাকে স্বাধীন বাংলাদেশে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতে, ‘সে দিন পাকিস্তান হয়েছিল বলেই পরে বাংলাদেশ হয়েছে’।
সানাউল্লাহ নূরীর ভাষায় ‘ভলতেয়ারের তুল্য’ মওলানা খাঁ তাঁর কর্মময় জীবনে সুচিন্তার বিস্তর উপাদান রেখে গেছেন। একজন সাহিত্যসাধক কিভাবে সমাজ সংস্কার হতে শুরু করে রাজনৈতিক মাঠে তোলপাড় সৃষ্টির মাধ্যমে একটি জনসচেতনতামূলক সামাজিক বিপ্লব সাধিত করতে পারেন, তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ মওলানা আকরম খাঁ। তিনি মুসলিম লীগের নেতা হলেও নিজস্ব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকারের ব্যাপারে আপসহীন ছিলেন। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে মওলানা মুসলিম লীগের নেতা হওয়ার পরও রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন। ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’র মাঘ (১৩২৫) সংখ্যায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মওলানা লেখেন, ‘দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কি? উর্দু না বাংলা? এই প্রশ্নটা তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলবে, না বেল? বঙ্গে মুসলিম ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাই তাদের লেখ্য, কথ্য ও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইবে।’
আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভাষ্যে ‘কিংবদন্তির রাজা’ মওলানা আকরম খাঁ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতসহ কয়েকজনকে হত্যার প্রতিবাদে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন।
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৮ আগস্ট ১৯৬৮ সালে বংশালের আহলে হাদিস মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি জাতির জন্য রেখে গেছেন তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম এবং বিশাল সাহিত্যসম্ভার। তাঁর রচিত ‘মোস্তফা চরিত’ মুহাম্মদ সা:-এর বস্তুনিষ্ঠ মূল্যবান জীবনীগ্রন্থ। মওলানা আকরম খাঁর লেখায় এই অঞ্চলের মানুষের শিকড়সন্ধানী ভাববাদিতা ফুটে উঠেছে। ‘মোসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ বঙ্গীয় মুসলমানের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের মহা দলিল। ‘সমস্যা ও সমাধান’ গ্রন্থে বাঙালি মুসলমানের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর প্রগতিশীল সমাধানের মাধ্যমে তিনি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। মওলানার অনুবাদকৃত ‘বাংলা তাফসিরুল কোরআন’ বাংলা ভাষায় কুরআনের মানসম্মত অনুবাদ হিসেবে আজো সমাদৃত হয়ে আসছে। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক মওলানার সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘তাঁর মতামত চিন্তা-উদ্রেককারী, ভিন্ন মতাদর্শীদের জন্যও উপকারী। তাঁর লেখায় আমাদের ইতিহাসের অনেক মূল্যবান তথ্যের সম্ভার পাওয়া যায়।’
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বঙ্গীয় মানুষের গভীরে প্রোথিত একজন প্রোজ্জ্বল কর্মবীর। তিনি যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠেছিলেন এবং বুক ফুলিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন তা ইতিহাসে বিরল বলেই পল্লীকবি জসিম উদ্দীন তাঁকে ‘জাতির মহান পিতা’ বলে অভিহিত করেছেন। ঠুুনকো অভিযোগে মওলানা আকরম খাঁর সমালোচনা করা যায়, কিন্তু একজন আকরম খাঁ তৈরি করা খুব সহজ নয়। যত দিন বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং সংস্কৃতি থাকবে, তত দিন মওলানা আকরম খাঁও প্রোজ্জ্বল আলোকবর্তিকাস্বরূপ এ সবের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকবেন।


আরো সংবাদ



premium cement