২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৩ শাবান ১৪৪৬
`

উপহার

-

আজ ৫ আগস্ট সোমবার। এখন সকাল ৯টা। রাত ১২টা বাজলেই সাগরিকার জন্মদিন। এবার সাগরিকা আব্দার করেছে তার জন্মদিনে একটা ভালো কিছু গিফট দিতে। সাইফুলও কথা দিয়েছে যতটা সম্ভব তাকে একটা কিছু কিনে দেবে। কিন্তু সাইফুল এখনো ঠিক করতে পারেনি কি দেবে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে। সে তো তেমন কিছু করে না। সবে মাত্র লেখাপড়া শেষ করেছে। বাবার একমাত্র ছেলে হওয়ায় চাকরি বাকরি করার আগেই তাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। সাইফুল টিউশনি করে তার হাত খরচের এবং তার স্ত্রীর টুকটাক খরচ চালিয়ে নেয়ার জন্য। খুব সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সাইফুল স্ত্রীকে বলে বের হয়েছে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসবে।
তুমি অসুস্থ, বাড়ির জানালা দরজা ভালোভাবে আটকিয়ে বাড়ির ভেতরে থেকো। বাইরে যেভাবে গোলাগুলি চলছে তাতে গুলি ভেতরে চলে আসতে পারে। এই কথা স্ত্রীকে বলে সাইফুল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।
জুলাই মাসে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে সাইফুল। আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন সে। এ কথা তার স্ত্রী জানে না। কয়েক দিন আগে এই আন্দোলনের খবর টেলিভিশনে দেখানোর সময় মিছিলের সামনে সাইফুলকে দেখতে পেয়েছিল সাগরিকা। সাইফুল বাড়ি আসতেই জিজ্ঞাসা করেছিল- তোমাকে তো টেলিভিশনে দেখলাম।
সাইফুল জানে ওর বাবা মা এবং স্ত্রী এই আন্দোলনে তাকে যেতে দেবে না। তাই সে বিষয়টি গোপন রেখেই বেরিয়ে যেতো বাড়ি থেকে। বেরিয়ে যোগ দিতো আন্দোলনে। তাই স্ত্রীর কথায় বলেছিল- কই নাতো। কাকে না কাকে দেখে ভাবছ আমি!
তুমি যাই করো আমাদের কথা ভেবো কিন্তু। বাবা মা আমি এবং আমার পেটে তোমার আগামী প্রজন্ম। আমার যে অবস্থা তাতে কয়েক দিনের মধ্যে এই অনাগত বাচ্চা দুনিয়ার মুখ দেখবে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের এতোগুলো মানুষের কী হবে? যে হারে আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে এই সরকারের লোকজন গুলি করে মারছে, তাতে সারা দেশের মানুষ আতঙ্কিত।
সাইফুল বললো- আরে না, আমার কিছুই হবে না ইনশাআল্লাহ। তা ছাড়া আমি তো সাবধান আছি। আরও বললো- আসলেই তো যারা আন্দোলন করছে তারা ঠিকই করছে। তারা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আন্দোলন করছে। এই সরকার যেভাবে ফ্যাসিস্ট কায়দায় সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায় অত্যাচার করছে তাতে মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এই সরকারের পতন না হলে আমরা আমাদের স্বাধিকার পাবো না।
সাইফুলের এই কথায় সাগরিকার মনে সন্দেহের দানা বেঁধে উঠেছিল। আসলে সাইফুল ছাত্রদের সাথে আন্দোলন করছে এটিই সত্যি। টিভিতে দেখা গেছে সে তার স্বামীই। সে মনে মনে ভাবলো- এখন আন্দোলন যে পর্যায়ে গেছে তাতে আন্দোলনকারীদের কাউকে দমিয়ে রাখা যাবে না। আর এই মুহূর্তে আন্দোলন থেমে গেলে স্বৈরাচারী সরকার এবার আর কাউকে আস্ত রাখবে না।
যখন সাইফুল তার স্ত্রীর কথা এবং জন্মদিনের কথা মনে করছিল তখন সে আন্দোলনের রাজপথে। গতকালও তার এক বন্ধু তার চোখের সামনে গুলিতে মারা গেছে। আবাবিল নামে সেই বন্ধুটিকে খুব কাছ থেকে গুলি করেছে পুলিশ। গুলিটি আবাবিলের কপালে লেগে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সাইফুল নিজে তাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে মেডিক্যালে নিয়ে গেছে। কিন্তু তার আগেই সে ওপারে চলে গেছে।
আজ আন্দোলনের তীব্রতা আরো বেড়ে গেছে। সাইফুল ভাবছে- ঘরে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী। তার কাছে গেলে তো এই আন্দোলনে থাকা হবে না। এখন সরকার যে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে তাতে আমরা পিছু হটলে বা থেমে গেলে সারা দেশের মানুষের ওপর অত্যাচারের তীব্রতা আরো বেড়ে যাবে। তাই সে স্ত্রীর ও অনাগত সন্তানের কথা মনে চেপে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে বাড়ি ফিরলো না। আন্দোলনকারীরা যখন এক জায়গায় জমায়েত হয়ে সেøাগানে সেøাগানে মুখর করে তুলল আশপাশ। হঠাৎ তখন হেলিকপ্টার থেকে গুলি শুরু হলো। ওখানেই লুটিয়ে পড়ল বেশ ক’জন আন্দোলনকারী। তাদের মধ্যে সাইফুলও। হেলিকপ্টার চলে যাওয়ার পরে আন্দোলনকারীরা এসে নিহত ও আহতদের সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলো। নিহত সাতজনকে তারা একটি ভ্যানে, আর আহতদের আরেকটি ভ্যানে করে মেডিক্যালে নিয়ে গেলো। একটি গুলি সাইফুলের বুকে বিদ্ধ হয়েছে।
সাইফুল গুলিতে আহত হওয়ার খবর তার বাড়িতে গেলো। খবর বাড়িতে যাওয়ার সাথে সাথেই তার স্ত্রী সাগরিকা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তার বাবা-মা চিৎকার করে কান্না করতে থাকে। ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সাগরিকা পড়ে যাওয়ার পর ব্লিডিং শুরু হয়। তাকেও হাসপাতালে নেয়ার জন্য পাশের বাড়ির লোকজন এগিয়ে আসেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে কোনো গাড়ি বা রিকশা পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেকক্ষণ পর একজন রিকশাওয়ালাকে হাত-পা ধরে রাজি করিয়ে তাকে মেডিক্যালে নেয়া হয়। হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় অন্য ওয়ার্ডে জায়গা না হওয়ায় সেখানেও আহত আন্দোলনকারীদের রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আন্দোলনে আহতদের একজনকে পাশে সরিয়ে সেখানে সাগরিকাকে রাখা হয়। তাকে জরুরি অপারেশন থিয়েটারে নেয়া দরকার। কিন্তু অপারেশন থিয়েটারে আহতদের অপারেশন করায় সাগরিকার জায়গা হচ্ছে না। তার অবস্থা বেগতিক দেখে সেখানেই অপারেশন করে বাচ্চা ডেলিভারি করার সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তার। সেই মোতাবেক অপারেশন করা হয় এবং ফুটফুটে একটি কন্যাসন্তান জন্মলাভ করে সাগরিকা। বাচ্চাটিকে দেখে সাগরিকার চোখ জুড়িয়ে যায়। এ সময় সাগরিকার পাশেই একজন আহত আন্দোলনকারী চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকারে সাগরিকা ভালো করে তাকিয়ে দেখে সে আর কেউ নয় তার স্বামী সাইফুল। এতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল সাইফুল। হঠাৎ জ্ঞান ফিরে আসায় সে চিৎকার করছে।
সাগরিকার তখন ওঠার পরিস্থিতি ছিল না। তার পরেও সে তার স্বামীর নাম ধরে ডাকল। তখনও সাইফুলের বুক থেকে রক্ত ঝরছিল। ভাঙা ভাঙা গলায় সাইফুল বলল- সাগরিকা তুমি এখানে কেন?
সাগরিকা বলল- দেখ তোমার একটি ফুটফুটে বাবু হয়েছে।
সাইফুল মেয়ের দিকে তাকিয়ে এত কষ্টের মধ্যেও একটু হাসল। ভালো থেকো বলে চোখ বন্ধ করলো সাইফুল। সাগরিকা বিচলিত হয়ে কি হলো, কি হলো বলে তাকে ডাকতে থাকল।
শত শত আহত গুলিবিদ্ধ রোগীকে মাত্র কয়েকজন ডাক্তার ও নার্সের সাধ্য ছিল না সঠিক ভাবে চিকিৎসা দেয়া। সাগরিকার চিৎকারে নার্স ও ডাক্তার ছুটে এলেন। ততক্ষণে সব শেষ। তখন বেলা ১টা বেজে গেছে। চারদিক থেকে আনন্দ উল্লাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী পালিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সফল হয়েছে। টেলিভিশনের স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে- অবশেষে ভারতে পালিয়ে গেলো শেখ হাসিনা । স্বৈরচারমুক্ত হলো দেশ।
খবর শুনে সাগরিকা আরো চিৎকার করে কান্না শুরু করলো। আর বলতে থাকল- আর কয়েক ঘণ্টা থাকলে না কেন সাইফুল। আর কয়েকটা ঘণ্টা থাকলে না কেন? আর কয়েক ঘণ্টা থাকলে তো তুমি আমি আমার এই মেয়ে একসাথে দ্বিতীয় স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারতাম। আজ রাতে তো আমার জন্মদিনে আমাকে গিফট দিতে চেয়েছিলে। না দিয়েই কেন এভাবে আমাকে ফেলে চলে গেলা?
সাগরিকার মনে হলো সাইফুলের ঠোঁট একটু নড়ল আর বললো- জীবন দিয়ে আমি তোমাকে দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিয়ে গেলাম। এটাই তোমার জন্মদিনের উপহার।


আরো সংবাদ



premium cement
রেকর্ড ভাঙাগড়ার ম্যাচে ইতিহাস অসিদের সুরমা কুশিয়ারায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণে বিএসএফের বাধা এখন যারা বড় বড় কথা বলছেন তারা মাঠে ছিলেন না আন্দোলনে : তারেক রহমান বন্দিবিনিময়ের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্বের শেষ ধাপ সম্পন্ন পদত্যাগ করবেন নাহিদ নতুন তথ্য উপদেষ্টা হচ্ছেন মাহফুজ আলম অজ্ঞাত প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ২৯ মিলিয়ন ডলার জনদুর্ভোগ কমাতে আগে স্থানীয় নির্বাচন দিন নতুন দল নিয়ে কাটছে না অনিশ্চয়তা ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনার বিকল্প নিয়ে রিয়াদে আরব নেতাদের বৈঠক ঝিনাইদহে পূর্ববাংলার ৩ জনকে গুলিতে হত্যা : দায় নিয়ে ধোঁয়াশা দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও আর্থিক বৈষম্য এখনো প্রকট : বাণিজ্য উপদেষ্টা

সকল