০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ৭ শাবান ১৪৪৬
`
কবি হয়ে ওঠার গল্প

খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলাম

-

একটি কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল দেখতে পাচ্ছি আমি। শীতকাল। সামনের ধানক্ষেতের ওপাশের কিছু দেখা যায় না। বেলা উঠেছে। কিন্তু রোদের কোনো আঁচ পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সূর্যটা ডুবে আছে উসের সাম্রাজ্যে। ওই রহস্যের ঘোর কাটছে না। কখন বেলা উঠবে? শীতে জবুথবু হয়ে বার-বাড়ির একচিলতে জায়গায় বসে আছি। সামনে যে ঢালুতে কয়েকটি সিটকি গাছ। মেসওয়াক করার জন্য ওই সিটকি আমরা ভেঙে আনি। দাঁতে কামড়ে সিটকির এক মাথা ছোবড়া করে তা দাঁতের ময়লা সাফ করতে শুরু করি। ততক্ষণে দু-একটি ছোট সাইজের পাখি, সে কি টগা? যাকে আমরা চিনি বুলবুলি হিসেবে, নাকি শালিক? সেই উসের কুয়াশায় উড়ে যায়। কোথায় যায়? জানি না।
আমি তখন গ্রামে থাকি। চোখের সামনে অবারিত ঝলমলে শস্যক্ষেত, তার সোদা গন্ধ গাছপালা, জলাজঙ্গল আর কৃষকের কর্মচঞ্চল দিন।
নিসর্গ-প্রকৃতি কি আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল? মনে পড়ে না। কেবল মনে আছে সেই জীবনের শুরুটা ছিল প্রাণময় চঞ্চলতায় ভরপুর। আমাদের বাড়িতে কিছু বই ছিল। মাকে দেখতাম সেখান থেকে বই নিয়ে পড়ছেন। আব্বাও পড়তে বসতেন। কিন্তু গ্রামের মানুষ নানা কাজে আব্বার কাছে আসতেন সাহায্য নিতে। ফলে আমাদের বাংলাঘর প্রায়ই সরগরম থাকত। তখন তো আর বাংলাঘরে চায়ের বৈঠক বসতো না। আমরা একটু বড় হয়ে উঠলে নিজেদের চায়ের কাপেই মন মজে থাকত। জ্বাল দেয়া ছাগলের ঘন দুধ বা গাভীর দুধের চা করতেন মা মাটির পাতিলে। ভাত তরকারিও রান্না হতো মাটির হাঁড়িতে। আমরা বলতাম উন্না মাস, মানে শুকনার দিন। সেটা শীতকাল। হাঁড়ি-কলসি বিক্রি করতে আসত কুমোরেরা। বাইকের দুই প্রান্তে সেসব ঝুঁলিয়ে কাঁধে করে নিয়ে আসত। বাইনাতির দোকানও আসত বাইকে মাল নিয়ে। আসত একটু দূরের গ্রাম থেকে বাদাম-টানা, নৈ-টানা ইত্যাদি জিনিস নিয়ে। আমি সে সব খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। আর আমার খুব প্রিয় ছিল আমাদের আঁড়ায় ঘুরে বেড়ানো। মোটামুটি বড়ই ছিল সেই ছেলেবেলায় নানা গাছপালা আর পাটিবেতের ঝোপ নিয়ে। ছিল গাবগাছ, জারুল আর পাঙকি-চুঙকি, চুকুরি, জলপাই গাছ। সেখানে দুপুরবেলা ঘুরতে ভালো লাগত। একবার মাত্রই দেখেছিলাম লম্বা লেজের একটি পাখি। মা বললেন ওটা স্বর্গের পাখি। জান্নাত তখনো আমাদের লোকজীবনে তেমনভাবে গেড়ে বসেনি। আমাদের কল্পনার ডালে আমি সেই পাখিতে উড়ে এসে বসতে দেখতাম। আমার দাদি, তিনি ঘর থেকে তেমন একটা বেরুতেন না। তিনিও ছিলেন এক কল্পবাজ। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলতেন তোমার টিয়ায় দিয়া গেছে। বাড়িয়ে দিতেন কলা বা অন্য কোনো ফল। ডেফল নামের একটি ফলও, তিন কোয়ার ফল আমি খেয়েছি দাদীর কাছ থেকেই। আমাদের আড়ায় ডেফলের গাছ ছিল কি না মনে পড়ছে না।
সেই ছেলেবেলায় প্রচুর গল্প পড়তাম। একবার কী কারণে গল্প লেখার খুব সখ হলো। লুকিয়ে লুকিয়ে লিখতাম। মা মনে করতেন আমি পড়াশোনোয় মন বসিয়েছি। পড় গল্প অনুকরণ করে লেখার চেষ্টা করে দেখলাম কিছু দিন। না হবে না, ভেবে সেগুলো ছেড়ে দিলাম। আগস্টের ১৪ তারিখে ছিল আমাদের ছেলেবেলায় স্বাধীনতা দিবস। স্কুলে ওই দিনের জন্য নানা অনুষ্ঠান হতো। আমিও অংশ নেবো ভেবে কবিতা পড়তে লাগলাম। আমি আহসান হাবীবের মেঘনাপাড়ের মেয়ে পড়লাম বেশ কয়েকবার। নাহ, ভালো লাগছে না। যেন জলবৎ তরলং। হঠাৎ পেয়ে গেলাম বনলতা সেন। আমার অগ্রজ মাহবুব সাদিক বাড়িতে কিছু বই রেখে গিয়েছিলেন। সেখানেই পেলাম বইটি। আমি পড়তে পড়তে মগ্ন হয়ে গেলাম। ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি..., আরে! কি বলে হাজার বছর ধরে তিনি পথে হাঁটছেন? ওই প্রশ্নবোধক পঙ্ক্তিটি আমাকে ভাবনার জালে আটকে দিলো। আমি কবিতা লিখি কিন্তু তা হয়ে ওঠে না। এর মধ্যেই আমরা টাঙ্গাইল শহরে এলাম। সেখানে যারা সাহিত্য চর্চা করছেন, তাদের সঙ্গে আলাপ হলো। নতুন বন্ধুও জুটল। কিছু বন্ধু বিদেশিনী পত্রবান্ধবীকে ইংরেজিতে চিঠি লেখে। আমি ভাবলাম ইংরেজিতে লেখা কি চাট্টিখানি কথা। আমিও চেষ্টা করতে থাকলাম। এই সব করতে করতে শহরের কবিদের সঙ্গে হৃদ্যতা জমল। তারা সঙ্কলন করলেন কবিতার। আমার কবিতাও নিলেন। বুকে আমার পানি এলো। তাহলে আমার কবিতা হচ্ছে! কবিতা হওয়ার চেয়ে বুকে যে সাহস জন্মালো সেটাই তো বড়। শিখলাম, গরুর মতো গ্রাস করা হচ্ছে গোগ্রাসে গেলা। আমার পাঠ অভ্যাস ওই গোগ্রাসের মতো। তারপর তাকে জাবর কাটা। সেই জাবর কাটা হচ্ছে আমার ভাবনার স্রোতে তাকে নিয়ে আসা। তিনি কেন পাখির নীড়ের মতো চোখের কথা বললেন?
পাখির নীড় তো গোলগাল। কতবার গাছে উঠেছি ঘুঘুর বাচ্চা দেখার জন্য। তখন দেখেছি সেসব বাসা গোল। সেই বাসার মতো যদি কোনো নারীর চোখ হয়, তাহলে সেটা কি সুন্দর হবে? গোল চোখের রমণী কি সুন্দর? নাকি পটল-চেরা চোখ টানা টানা হয়, তার সঙ্গে মিল দেখালে বরং ভালো হতো না?
এসব চিন্তাই আমাকে কবিতা ও কবিতার ভেতরের শব্দ তার মর্মার্থ, ব্যঞ্জনার্থ, প্রতীকী অর্থ দেবার বিষয়টি আমার ভেতরে ছায়া ফেলে চলল। আমি ভেতরে ভেতরে কবি হয়ে উঠলাম।
আমি ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকা কলেজে পড়ি আর বিকেলবেলা হলেই ছুটে যাই নিউ মার্কেটে। সেখানে মণিকো নামের একটি রেস্টুরেন্টে খুঁজে পেলাম রফিকুল ইসলাম নামের এক সার্ভিসবয়কে। সে কবিতা লেখে। সেই জানাল তার রেস্টুরেন্টে শহরের কবিরা আড্ডা দিতে আসেন। কে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে দৈনিক আজাদে, মনে নেই। সে হয়তো শাহাদাত হোসেন বুলবুল, পরে নাম খাটো করে শুধু শাহাদাত বুলবুল হয়েছিল। থাকত কলাবাগানের প্রথম লেনের একটি বাড়িতে, কারো সঙ্গে। সেই আমাকে দৈনিক আজাদের সাহিত্য সম্পাদকের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তখন সম্ভবত সাহিত্যের পাতা দেখতেন ফরহাদ মজহার। আর শিশুদের পাতা দেখতেন কবি হাবিবুর রহমান। মুকুলের মহফিলে আমাকে লেখা দিতে বলেছিলেন তিনি। কিন্তু শিশুদের জন্য কেমন করে লিখতে হয় তা তো জানি না। তাই লেখা দেয়া হয়নি। কিন্তু সাহিত্যের পাতায় একটি কবিতা দিয়েছিলাম। সেটি তারপরের সপ্তাহেই ছাপা হয়েছিল। আমি খুশিতে ডগমগ করে উঠলাম। তাহলে আমি কবি, সত্যি সত্যিই কবি!


আরো সংবাদ



premium cement
শাওন ও সাবাকে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দিলো ডিবি প্রয়োজনে নতুন আইন করে আ’লীগের নেতাকর্মীদের বিচারের আহ্বান টসে জিতে চিটাগংকে ব্যাটিংয়ে পাঠালো বরিশাল অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বব্যাপী কতটুকু সমর্থন পেল পরাধীনতার কারণেই দেশের মানুষ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ‘ফেব্রুয়ারিতেই জুলাই গণহত্যা মামলার একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত হবে’ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে মালিক-শ্রমিক ঐক্য গড়তে হবে : মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হাসিনা বা আ'লীগের কারো সম্পত্তিতে হামলা না করার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার আমিরাতে ক্ষমা পাওয়া সেই প্রবাসীদের আল্টিমেটাম কালিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বিএনপি নেতার মৃত্যু

সকল