কবিতায় শিল্পপ্রয়োগ-শৈলী
- দালান জাহান
- ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা হচ্ছে কবিতা। বর্তমানে সাহিত্যে শিল্প-সংস্কৃতিতে আধুনিক কবিতা নতুনরূপে সজ্জিত হচ্ছে। কবিতা মূলত একটা শক্তি একটা প্রবল আকর্ষণের জোয়ার। যদিও এখনো কবিতার পক্ষে ও বিপক্ষে লোক রয়েছে তবুও কবিতা তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
অনেকেই প্লেটোর লেখার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলে থাকেন প্লেটো কবি বিরোধী ছিলেন। কিন্তু এটা আসলে একপ্রকার ভুল ব্যাখ্যা।
শিবনারায়ণ রায় চিমত্মা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র হতে কবিকুলকে নির্বাসিত করেছিলেন।
আসলে কথাটা ঠিক এরকম নয়। তিনি আসলে কবির নামে ভণ্ডামিকে অস্বীকার করেছিলেন। পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা চরিত্রহীন লাগামহীন জীবনের প্রতি তিনি ধিক্কার জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার এ কথা কবিবিরোধী ভুল ব্যাখ্যা হয়ে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমান আধুনিক সময়েও কিছু কিছু কবির প্রতি এই বিরূপ বিদ্রƒপ মারাত্মকভাবে লক্ষণীয়। যেমন কবিদের সম্পর্কে অনেকের ধারণা কবিরা জ্ঞানহীন উন্মাদ। আবার কিছু কিছু রক্ষণশীল মানুষ মনে করেন কবি মানেই নারী মদ গাঁজার সেবক। কিন্তু এগুলো নিতান্তই ভুল ধারণা তদ্রƒপ প্লেটো সম্পর্কে কবি ও কবিতা বিরোধী মতবাদ ও একটি ভুল ফসল।
বর্তমানে প্লেটো বেঁচে থাকলে হয় তো কিছু কিছু কবির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন। সময়ের কল্যাণে কবি কবিতা উর্বর এখন সমগ্র বিশ্ব। এর যেমন এক দিকে ভালো দিক রয়েছে আরেক দিকে রয়েছে এর বিপরীত দিক। বিশ্বায়ন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে এখন ভণ্ড নকল চরিত্রহীন ছায়া কবি ও কবিতার জন্ম হচ্ছে।
যাদের মূলত কবিতা সম্পর্কে কোনো রকম জ্ঞান বা ধারণা নেই। তাই এই সময়ে এসে দেখা যায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও নিজের নামে চালিয়ে দিতে চায়।
এ সময়ে আধুনিক কবিতার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।
মূলত বর্তমান সময়ের কবিতা আরো দুরূহ চিত্রকল্প চায়। প্রকৃত অর্থে কবিতা সহজে বোঝার বিষয় নয়। কিন্তু একেবারে অর্থহীন চিত্রপট কোনো কিছুর দাবি রাখে না। যেমন টুকরো টুকরো কিছু মখমল কাপড় স্তূপ হয়ে পড়ে থাকলেও এবং তা দূর থেকে চকমক করলেও তা দিয়ে জামা তৈরি করা যায় না।
তাই দেখা যায় যে, একটি সাধারণ ধারণা বা বর্ণনায় কবিদের চিত্র বিন্যাস প্রতীকী শব্দ বৈশিষ্ট্য ইঙ্গিত পরিবাহী শব্দমালায় এবং অদ্ভুত ঘটনা চিন্তার অভিনব উৎকর্ষে পাঠকের ইম্প্রেশন বা রিয়েলিস্টিক চিন্তাকে পাহাড়ের সমান উঁচু প্রশ্নের সম্মুখীন করে রহস্যময় বা জাদুবাস্তব হয়ে উঠছে।
বর্তমান সময়ে অনেক তরুণ কবিই নিজ নিজ চিন্তা প্রবাহকে সর্বোত্তম ব্যবহার করে সার্থক ও ঋদ্ধ কবিতার সৃষ্টি করে যাচ্ছে। তা ছাড়া কিছুসংখ্যক অগ্রজ কবিদেরকেও দেখা যাচ্ছে নতুন ধারার কবিতা লেখতে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, চিত্রপট ভাষার নাটকীয় ব্যবহার কবিতার রহস্যময়তা জাদুবাস্তবতা কবিতাকে দিয়েছে নতুন এক জীবন নতুন এক ভাষা।
সাহিত্যের প্রধান ব্যবহারিক বিষয় হলো ভাষা। শব্দ ব্যবহারে কবিকে সচেতন থাকতে হয়। বোবা শব্দ দিয়ে কবিতা হয় না। কবিতার কথা মুখর হওয়ার জন্য শক্তিশালী ও তাৎপর্যবহুল শব্দের প্রয়োজন হয়। কবিতায় শিল্প বলতে মানুষের চিন্তার শিল্পকে বোঝায়। যার চিন্তা যত গভীর সুস্পষ্ট ও প্রয়োগিক, কবিতায় তার শিল্প চেতনা তত গভীর হয়ে ওঠে।
সাহিত্যে শিল্প একটি দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ শিল্পের রূপ। মেধা ও দক্ষতার পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি হলো শিল্প। ভাবনার নবরূপে উদ্ভাসিত কোনো কিছুই শিল্প। সৃজনশীল কোনো কাজই শিল্পের বাইরে নয়। মননশীল ও নান্দনিকতার সাথে রচিত প্রতিটি স্বতন্ত্র সৃষ্টিই শিল্পের দাবি রাখে। কিন্তু সব কবিতাই শৈল্পিক নয় বা শৈলী স্থাপন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে কবিকে গভীরভাবে ব্যবহৃত শব্দের ওপর নজর দিতে হয়।
অন্য দিকে শৈলীকে আমরা বলতে পারি ব্যক্তি স্বতন্ত্র বা ‘কণ্ঠস্বর’ যে কণ্ঠস্বর একজন লেখককে আরেকজন লেখক থেকে আলাদা করে থাকে। যে লেখা দেখলেই বা পড়লেই আলাদা করা যেতে পারে তাই কণ্ঠস্বর বা শৈলী। যেমন রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের লেখাকে আমরা সহজেই আলাদা করতে পারি। নজরুলের লেখা সম্পূর্ণ আলাদা।
আলাদা করতে পারি বিষ্ণু দে ও শামসুর রাহমানের লেখাও। আবার আল মাহমুদের লেখা পড়লেই বোঝা যায় এটি আল মাহমুদেরই লেখা। এই যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আলাদা সৌন্দর্য ও ব্যবহারিক গঠন প্রবচন, এটাই হলো যার যার লেখার কণ্ঠস্বর বা শৈলী। শৈলীর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে যেগুলো শৈলী তৈরি করে সেগুলো হলো স্বর, শব্দ নির্বাচন, ভাষার ব্যবহার, অলঙ্করণ চিত্রকল্প, সময়ের গতিময়তা ও আদর্শ গঠন। এ ক্ষেত্রে আমার বলতে পারি
চ্যাটমানের কথা তিনি বলেন- ‘শৈলী হচ্ছে ব্যক্তি বা লেখকভেদে বাক্যগঠন এবং শব্দ প্রয়োগের ভিন্নতা।’
অনেকেই মনে করেন কবিতা বিপ্লবের ধারক ও বাহক কিন্তু বাস্তবে কি কবিতা বিপ্লবকে ধারণ করে? আসলে কবিতা ও বিপ্লব ভিন্ন বিষয়। কবিতা হলো কবি কর্তৃক সৃষ্ট বোধের বিশেষ শিল্প স্থাপত্যের প্রকাশ।
‘একটা সমাজব্যবস্থা যখন তার গতি হারিয়ে ফেলে, রুগ্ণ হয়ে যায় তখন এক শক্তি এসে একটি নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলে তাই বিপ্লব।’ বিপ্লবের আরো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছেন বিজ্ঞজনেরা।
কার্ল মার্কসের ভাষায় বিপ্লব হলো, ইতিহাসের চালিকাশক্তি "Revolutions are the locomotives of history"
সমাজবিজ্ঞানী এঙ্গেলস এর মতে, ‘বিপ্লব হল এমন একটা হাতিয়ার যার সাহায্যে সামাজিক আন্দোলন পুরনো রাজনৈতিক ধ্যান ধারণাগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়।’ অর্থাৎ বিপ্লব হলো একশ্রেণীর হাত থেকে নতুন আরেক শ্রেণীর হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর। অনেকেই মনে করেন কবিতা বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে। তাই কেউ কেউ বিপ্লবী কবি নামও পেয়ে যান। বস্তুত কবিতা কখনো সরাসরি বিপ্লব তৈরি করে না। কবিতা যা পারে তা হলো বিপ্লবের পরিবেশ তৈরি করতে। মানুষ যুৎসই শব্দ বলার গাম্ভীর্যের মাধ্যমে কবিতা মানুষকে শোষণ নিপীড়ন ও নির্যাতনের চিত্রের কথা বলতে পারে। কিন্তু সেই বলাটাও শৈল্পিক হওয়া চাই।
কবিতায় সৌন্দর্যহীন শব্দ দিয়ে গালিগালাজ করা বর্তমানে কিছু কবির ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কবিতায় না আছে কোনো শিল্প না আছে কোনোরকম শৈলী। বস্তুত কবিতায় গালাগালি করার ও একটা শিল্পশৈলী আছে।
সেটার ব্যবহার জানা কবির জন্য অত্যন্ত জরুরি। শিল্পশৈলী হারা এসব গালাগালি কবিতায় না প্রকাশ হয় কোনো প্রতিবাদী চিত্র না প্রকাশ হয় কোনো জটিল ও গুরুগম্ভীর ধারণা। তাই কবিকে শব্দ ব্যবহারে শ্রদ্ধা থাকতে হবে।
শব্দ পুনর্নির্মাণের একটা ব্যপার থাকে। অনেক শব্দ এখন অচল যা আর ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু এটা দেখা যায় যে একজন একটি শব্দ তৈরি করলে সে শব্দটা নিয়ে সবাই টানাটানি শুরু করেছেন। কিন্তু শব্দ তৈরি করার ও ক্ষমতা থাকতে হয় কবির।
এর আগেই বলেছি কবিতায় বোবা শব্দ কোনো কাজে আসে না। কবিতার শক্তি হলো শব্দের শক্তি যে শব্দে সুরহীন ঝঙ্কারহীন আনন্দহীন প্রেমহীন বেদনাহীন প্রতিবাদহীন এসব শব্দ কবিতায় কোনো কাজে আসে না।
সাহিত্যের মূল হলো ভাষা নির্ভর সৌন্দর্যের সৃষ্টি। বর্তমান আধুনিক সাহিত্যে তরুণ কবি ও সাহিত্যিকরা যোগ করেছেন চিত্র নির্ভর ও ভাষার ম্যাজিকেল ব্যবহারের অন্যতম সৌন্দর্য। অনেক তরুণই সে সৌন্দর্যের প্রয়োগ করছেন যথার্থভাবে। সেসব অনন্য Foregrounding বা প্রমুখ কবিতাকে নিয়ে যাচ্ছে অন্য এক খোলা প্রান্তরে। যেখানে বাতাস কখনো দল বেঁধে আসে কখনো মেঘ হরিণ ছানা হয়ে আদরে সোহাগে জড়িয়ে দেয় অপার শীতলতা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা