পুরস্কার : বাতিল-স্থগিত, ফেরত ও প্রত্যাখ্যান
নোবেল থেকে বাংলা একাডেমি- সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ
- ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
পুরস্কার প্রত্যাখ্যান বা ফেরত দেয়া অথবা কেড়ে নেয়ার প্রথা আজকের নয়। তবে আলোচনাটা শুরু করা যেতে পারে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারকে দিয়ে। কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার ২০১৪ সালে পাওয়া বাংলা একাডেমি পুরস্কারটি ২০২৪ সালে ফেরত দেয়ার পর বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়; যাকে বলে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। যদিও এক বছর পর সেটি ফিকে হয়ে আসছে। আজকে পুরস্কার গ্রহণ করা নিয়ে আলোচনা করব না। সে আলোচনা অনেক দীর্ঘ। অন্য কোনো লেখায় সে আলোচনা করা যাবে। আজকে আলোচনা করবো পুরস্কার প্রত্যাখ্যান বা ফেরত দেয়া অথবা কেড়ে নেয়া বিষয় নিয়ে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও জাকির তালুকদারের পুরস্কার ফেরত দেয়া নিয়ে আলোচনায় আসছি পরে। আলোচনা শুরু করা যাক বিশ্বের সবচেয়ে দামি ও মর্যাদার নোবেল পুরস্কার নিয়ে।
বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও মর্যাদাপূর্ণ ‘নোবেল পুরস্কার’ সম্পর্কে সবারই কম-বেশি ধারণা আছে। ১৮৯৫ সালে সুইডিস বিজ্ঞানী আলফ্রেড বেনহার্ড নোবেলের করে যাওয়া একটি উইলের মর্মানুসারে এই পুরস্কার প্রচলন করা হয়। আলফ্রেড নোবেল মৃত্যুর আগে এমন কিছু করে যেতে চেয়েছিলেন যার মাধ্যমে তিনি হাজার বছর মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে পারেন। অনেক ভাবনা-চিন্তা, শলাপরামর্শের পর তিনি তার প্রায় সব সম্পত্তি নোবেল পুরস্কারের জন্য উইল করে যান। যদিও আলফ্রেড নোবেল জীবদ্দশায় নোবেল পুরস্কার প্রদান করা দেখে যেতে পারেননি। তিনি উইলটি করার পরের বছর ১৮৯৬ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন। তার উইলের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। প্রথম দিকে ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যু দিনে এই পুরস্কার দেয়া হলেও বর্তমানে অক্টোরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম ও নরওয়ের অসলোতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। শুরুতে পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য ও শান্তি- এ পাঁচটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। আলফ্রেড নোবেল তার উইলে অর্থনীতির কথা উল্লেখ করে যাননি বলে শুরু থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়নি। ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পুরস্কার দেয়া শুরু হয়েছে। পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও অর্থনীতিতে পুরস্কার দেয়া হয় সুইডেনের স্টকহোমে। শুধু শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় নরওয়ের অসলোতে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নোবেল পুরস্কার পুরোপুরি বন্ধ না থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল। পুরস্কারপ্রাপ্তরা প্রত্যেকে একটি স্বর্ণপদক, একটি সার্টিফিকেট এবং নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ পেয়ে থাকেন। বর্তমানে এই অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশী টাকায় ১০ কোটিরও বেশি। যদিও বর্তমানে এই পুরস্কার মৃত কাউকে দেয়া হয় না। পুরস্কার প্রদানের সময় নোবেল লরিয়েটকে অবশ্যই জীবিত থাকতে হয়।
আগেই বলেছি, নোবেল হলো বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার। এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য প্রায় সবাই আগ্রহী। তার পরও কেউ কেউ এই পুরস্কারও স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। আবার অনেকে প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছেন। এ তালিকায় রয়েছেন কার্লো ভন, ওসিয়েৎস্কি, রিচার্ড কুন, অ্যাডলফ বুটেনান্ড, গেরহার্ড ডোমাক ও অং সান সু চি।
অ্যাডলফ হিটলার ১৯৩৭ সালে জার্মান নাগরিকদের জন্য একটি ডিক্রি জারি করেন। সেই ডিক্রিতে জার্মান নাগরিকদের নোবেল পুরস্কার গ্রহণ না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। এর আগের বছর ১৯৩৬ সালে জার্মানের শান্তিকামী কার্ল ভন ওসিয়েৎস্কিকে শান্তিতে নোবেল দেয়া হয়েছিল। এটিকে লজ্জাজনক হিসেবে আখ্যা দেয় জার্মান সরকার। এ ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য নোবেল গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ডিক্রি জারি করা হয়েছিল। কার্ল ভন ওসিয়েৎস্কি প্রকাশ্যে নাৎসিবাদ ও হিটলারের বিরোধিতা করেছিলেন। এ কারণে ১৯৩১ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বন্দিশিবিরে আটকে নির্যাতন করা হয়। হিটলার ওই ডিক্রি জারির পর তিনজন জার্মান বিজীয় নোবেল পুরস্কার গ্রহণে বিরত থাকতে বাধ্য হন। তারা হলেন জার্মান জৈব রসায়নবিদ রিচার্ড কুন, যিনি ক্যারোটিনয়েড ও ভিটামিন নিয়ে কাজ করার জন্য ১৯৩৮ সালে রসায়নে নোবেল পেয়েছিলেন। জৈব রসায়নবিদ অ্যাডলফ বুটেনান্ড, যিনি যৌন হরমোন নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৩৯ সালে বিজ্ঞানী লিওপোল্ড রুজিকার সাথে যৌথভাবে নোবেল জিতেছিলেন। আর তৃতীয়জন হচ্ছেন, জার্মান প্যাথলজিস্ট ও ব্যাকটিরিওলজিস্ট গেরহার্ড ডোমাক। ১৯৩৯ সালে তিনি মেডিসিনে নোবেল জিতেছিলেন। হিটলারের ডিক্রি জারির কারণে এই তিনজন নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেননি। যদিও হিটলারের ডিক্রি প্রত্যাহারের পরে তারা সেই পুরস্কার গ্রহণ করেন।
নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে না পারা আরো একজন বরিস পাস্তেরনাক। মস্কোর কবি ও ঔপন্যাসিক বরিস পাস্তেরনাককে ১৯৫৮ সালে সাহিত্যে নোবেলের জন্য মনোনীত করা হয়। তিনি এই সম্মাননা গ্রহণ করলেও সোভিয়েত সরকারের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বরিস পাস্তেরনাক, জ্যঁ পল সার্ত্রে, লে দুক তাও, হেনরি কিসিঞ্জার, বব ডিলান এরা নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার ইচ্ছে থাকলেও গ্রহণ করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে ফরাসি লেখক জ্যঁ পল সার্ত্রে ছিলেন তার ব্যতিক্রম। অস্তিত্ববাদের জনক জ্যঁ পল সার্ত্রেকে নোবেল কমিটি ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে। কিন্তু তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ হিসেবে তিনি এই পুরস্কারকে ‘বুর্জোয়া পুরস্কার’ অর্থাৎ পুঁজিবাদীদের পুরস্কার বলে উল্লেখ করেন। শুধু নোবেল পুরস্কার নয়, সে সময় তিনি সব পদক ও পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
১৯৭৩ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয় হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং ভিয়েতনামের জেনারেল ও কূটনীতিক লে দুক তাও-কে। কিন্তু লে দুক তাও পুরস্কারটি গ্রহণ করেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন তাকে যে কারণে পুরস্কার দেয়া হয়েছিল সেই ভিয়েতনামে তখনো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং তিনি এ পুরস্কার নিতে পারেন না।
২০১৭ সালে মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী ও গীতিকার বব ডিলন নোবেল পুরস্কার পেলে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে নোবেল ও অস্কার পুরস্কার জেতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক ধারা সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে ডিলনকে নোবেল দেয়া হয়েছিল। পুরস্কার প্রদানের জন্য নোবেল কমিটি তার সাথে বারবার যোগাযোগ করলেও তিনি নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে সুইজারল্যান্ড যাননি। এমনকি নোবেল পুরস্কার নেয়ার পর যে বক্তব্য দিতে হয়, তিনি সেটিও দেননি। তবে তিনি পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যানও করেননি। যদিও পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের তিন মাস পর তিনি পুরস্কারটি গ্রহণ করেন।
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ব্যাপারে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় অং সান সু চির ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানায় বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন। যদিও তিনি তার নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দেননি। উল্লেখ্য, সু চি ১৯৯১ সালে ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ পান। এরকম আরো অনেক চমকপ্রদ ঘটনা রয়েছে নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে।
এবার আসছি বাংলাদেশের পুরস্কার প্রসঙ্গে। প্রথমেই আলোচনা করব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদক’ নিয়ে। স্বাধীনতা পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ এই পদক প্রদান করা হয়ে আসছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, পল্লী-উন্নয়ন, সমাজসেবা/জনসেবা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, জনপ্রশাসন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ে এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অন্য যেকোন ক্ষেত্রে এই পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশের নাগরিক এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জাতীয় জীবনে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। পদকপ্রাপ্তদের প্রত্যেককে ১৮ ক্যারেট স্বর্ণ নির্মিত ৫০ গ্রাম ওজনের একটি পদক, একটি সম্মাননাসূচক প্রত্যয়নপত্র এবং সম্মাননাস্বরূপ ৫,০০,০০০ টাকা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশেও পুরস্কার প্রদান ও পরে তা কেড়ে নেয়া অথবা ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনাও কম নয়। যদিও ‘স্বাধীনতা পদক’ ফিরিয়ে দেয়ার এখনও কোনো নজির নেই। তবে, ‘স্বাধীনতা পদক’ ফিরিয়ে নেয়ার দু’টি নজির রয়েছে। দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যিনি ১৯৭৭ সালে এই পদকের প্রবর্তন করেন; তার স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহারের সুপারিশ এবং চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয় পুরস্কার-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহারের পাশাপাশি জাতীয় জাদুঘর থেকে ওই পুরস্কারের মেডেল ও সম্মাননাপত্র সরিয়ে ফেলারও সুপারিশ করা হয়। শুধু স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার নয়, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের খেতাব ‘বীর উত্তম’ও বাতিল করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার। যদিও সেটার বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়।
২০২০ সালে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের নাম ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার পর কবি এস এম রইজ উদ্দিনের নাম প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগ সরকার। কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক ইতিহাসের বই লেখেন নড়াইলে জন্ম নেয়া কবি এস এম রইজ উদ্দিন।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০২২ সালে। আবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তোপের মুখে পড়ে সরকার কবি মো: আমির হামজার স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল করে। তখন ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন মাগুরার শ্রীপুরে জন্ম নেয়া কবি মো: আমির হামজা। এ বছর সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। তিনি মাত্র দু’টি বই লিখেছেন। যা ২০০১৮ ও ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়। তার মাত্র দুটি বই ‘বাঘের থাবা’ (২০১৮) ও ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ (২০২১) প্রকাশিত হয়েছে। আমির হামজা ২০১৯ সালে প্রয়াত হন।
এবার আসা যাক একুশে পদক নিয়ে। একুশে পদক বাংলাদেশের একটি জাতীয় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। ভাষা আন্দোলনের কথা স্মরণ করে ভাষাসৈনিক, ভাষাবিদ, সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, দারিদ্র্য বিমোচনে অবদানকারী, সামাজিক ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পর্যায়ে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ১৯৭৬ সালে এই পদকেরও প্রচলন করেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
পদকপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ১৮ ক্যারেট সোনার ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি পদক, একটি সম্মাননা সনদ, একটি রেপ্লিকা এবং পুরস্কারের অর্থমূল্য প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে এই পুরস্কারের অর্থমূল্য ২৫ হাজার টাকা হলেও বর্তমানে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ টাকায়। ভাষা ও সাহিত্য, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষা, গবেষণা, শিল্পকলা, সাংবাদিকতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজসেবা, অর্থনীতি এবং সরকার নির্ধারিত অন্য যে কোনো ক্ষেত্র (যেমন: চিকিৎসা, দারিদ্র্য বিমোচন) এই পুরস্কার দেয়া হয়।
এখানে একটা ভালো খবর হচ্ছে, স্বাধীনতা পদকের মতো কারো একুশে পুরস্কার কেড়ে নেয়া হয়নি অথবা কেউ এই পদক ফেরতও দেননি। তবে, কারো কারো পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।
এবার আসছি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রসঙ্গে। ১৯৪৮ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে প্রথম বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা ও চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বর্তমান বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলা একাডেমি’। ১৯৫৬ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম পরিচালক (বর্তমানে পদটি মহাপরিচালক) মনোনীত হন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। প্রথম সচিব ছিলেন মুহম্মদ বরকতউল্লাহ।
প্রতিষ্ঠার ৪ বছর পর ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে সেবার ৬টি শাখায় পুরস্কার দেয়া হয়। পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল প্রত্যেক শাখায় দুই হাজার টাকা। এ জন্য বাংলা একাডেমিকে ১২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এ বছর কবিতায় ফররুখ আহমদ, উপন্যাসে আবুল হাসেম খান, ছোটগল্পে আবুল মনসুর আহমদ, নাটকে আশকার ইবনে শাইখ, প্রবন্ধে মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ শিশুসাহিত্যে খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন এবং গবেষণায় আবদুল্লাহেল কাফী প্রথমবার বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। উপন্যাসে আবুল হাসেম খান পুরস্কার পাওয়ায় অনেকে সমালোচনা করেন। লেখক ও গবেষক আবুল মকসুদ তার একটি লেখায় লিখেছেন ‘পুরস্কারের ক্ষেত্রে ষাটের দশক ছিল বাঙালি কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য স্বর্ণকাল। শুধু বাংলা একাডেমি পুরস্কার নয়, সরকারি আনুকূল্যে আরো অনেক পুরস্কার প্রবর্তিত হয়েছিল। বাংলা একাডেমি পুরস্কারের পাশাপাশি তখন আদমজী পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার, ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তান পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান পুরস্কার, ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা পুরস্কারসহ অনেকগুলো মর্যাদাবান পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। তখনও বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়ার পেছনে সরকারি নীতির প্রভাব ছিল। ফলে, ষাটের দশকে মাত্র একটি বা দু’টি বই প্রকাশিত হয়েছে এমন অনেকে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন, যা এখনও বর্তমান।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রবর্তিত হবার পর প্রথম এক যুগ পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের ঘটনা ঘটেনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের পর থেকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণে অপারগতা বা প্রত্যাখ্যানের ঘটনা ঘটতে শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে সবার আগে যে নামটি আসে তিনি প্রতিথযশা সাহিত্যিক বদরুদ্দীন উমর। বাম ঘরানার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী (এম এল) তাত্ত্বিক লেখক, ইতিহাসবিদ, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তক বদরুদ্দীন উমর ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেলেও তিনি সে পুরস্কার ফিরিয়ে দেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ইতিহাস পরিষদ পুরস্কারও প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি অন্য কোনো পুরস্কারও নিতে অনীহা দেখান। এ বিষয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন ‘আমার ৯২ বছর বয়স হয়ে গেছে। এসব নিয়ে কথা বলবার মতো কোনো উৎসাহ আমার নাই। আমাকে মাফ করবেন।’ তবে, তিনি মনে করেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কার একটি সরকারি পুরস্কার। তিনি সরকারি পুরস্কার গ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, সরকারি পুরস্কার গ্রহণ করলে সাহিত্যিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সৃজনশীলতা ক্ষুণœ হয়। তিনি আরো মনে করতেন যে, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা রক্ষিত হয় না এবং পুরস্কার প্রদানে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়।
পল্লীকবি জসীম উদদীন ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের কারণ উল্লেখ করে বলেন- ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবায় আমি নিয়োজিত ছিলাম, আছি এবং থাকব। কিন্তু আমি কোনো পুরস্কার বা পদক গ্রহণের জন্য প্রস্তুত নই। আমার ধারণা, পুরস্কার বা পদক গ্রহণ করা একজন সাহিত্যিকের জন্য অমর্যাদাজনক।”
একদিকে সরকারি পুরস্কার গ্রহণ এবং অন্যদিকে সরকারের সমালোচনা করা বা সরকারি নীতির বিপক্ষে অবস্থান বেমানান। জসীম উদ্দীন তার এই সিদ্ধান্তের জন্য অনেক আলোচিত-সমালোচিত হন। অনেকে তার প্রশংসা করলেও কেউ কেউ নিন্দায় মুখর হন। তবে, তিনি ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা ব্যক্তি। ফলে, তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পল্লিকবি জসীম উদ্দীন নিজে বাংলা একাডেমি পুরস্কার না নিলেও বাংলা একাডেমি তার নামে একটি সাহিত্য পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক বছর পর পর ষাটোর্ধ্ব একজন বাংলাদেশী লেখককে এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে।
হুসেইন মোহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮২ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ফিরিয়ে দেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেও ২০১২ সালে একুশে পদক নিয়েছেন। এ বিষয়ে মামুনুর রশীদ বলেন- ‘দুটো কারণে বাংলা একাডেমি পুরস্কার বর্জন করেছিলাম। তার একটি হলো- স্বৈরাচার এরশাদের সময়ে শিশু একাডেমিতে গুলি চলেছিল। সেখানে একটা হত্যাকাণ্ড হয়। দ্বিতীয় যে কারণ, সেবার এমন এক ব্যক্তিকেও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়, যিনি সেন্সর বোর্ডে ছিলেন। তখন নাটকের ওপরও সেন্সর আরোপ করা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, যে শিল্পে সেন্সর থাকে সেই শিল্পের একজন নাট্যকর্মী হিসেবে আমি কী করে পুরস্কার নেই? পরবর্তীতে আমাকে আর কখনো বাংলা একাডেমি থেকে সাহিত্য পুরস্কার অফার করা হয়নি।’
১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘সাদত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’ ফিরিয়ে দেন লেখক ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা এবং ২০১৯ সালে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখান করেন আমেরিকা প্রবাসী কবি ওমর শামস। মূলত প্রবাসী পরিচয়ে পুরস্কার নিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এ ছাড়া ২০২৪ সালে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ফেরত দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ তথ্য জানিয়ে বাংলা একাডেমি বরাবর এক লাখ টাকা অর্থমূল্য ফেরতের ব্যাংক চেকের ছবি পোস্ট করেন। উল্লেখ্য জাকির তালুকদার তার ‘মুসলমানমঙ্গল’ গ্রন্থের জন্য ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১০ বছর পর তার পুরস্কার ফেরত দেয়ার বিষয়টি ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’তে পরিণত হয়। এ সময়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। বাংলা একাডেমির পরিচালক ও মহাপরিচালক হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের মধ্যে তিনি কবি-লেখকদের সবচেয়ে কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ফলে, তার কাছে কবি-লেখকদের প্রত্যাশাও ছিল বেশি। তবে দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, তিনি তাদের সে প্রত্যাশা পূরণ করতে অনেকটাই ব্যর্থ হন। যার কারণে সাধারণ কবি-লেখকদেরকে হতাশ হতে হয়েছে।
জাকির তালুকদার, তিনি তার এই পুরস্কার ফেরত দেবার কারণ হিসেবে বলেন বাংলা একাডেমি তার পুরস্কারের মান ধরে রাখতে না পারা, প্রতিষ্ঠানটির গণতন্ত্রহীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতিষ্ঠানটিতে আড়াই দশকব্যাপী নির্বাচন হয় না-সহ আরো অনেক কারণ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন প্রতিষ্ঠান যখন সুনাম হারায়, তখন তার মূল্য থাকে না। এ কারণেই আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফেরত দিয়েছি। বাংলা একাডেমির গণতন্ত্রহীনতা, আমলাতান্ত্রিকতা, ২৫ বছর ধরে কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন না করে ইচ্ছেমতো একাডেমি চালানোর জন্য বাংলা একাডেমি সচেতন মানুষের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।’
২০২৪ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার ঘোষণা নিয়ে যা ঘটলো সেটা তো আরও চমকপ্রদ। জুলাই বিপ্লবের পর দেশের পটপরিবর্তনের পর ৫ সেপ্টেম্বর বাংলা একাডেমির ১৯তম মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। সবাই ভেবেছিল একটা ভালো কিছু হবে। দায়িত্ব গ্রহণের সাড়ে চার মাস পর ২০২৫ সালের ২৩ জানুয়ারি তিনি ২০২৪ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার ঘোষণা করেন। এই পুরস্কারের তালিকায় থাকা অধিকাংশের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কবি-লেখকদের প্রতিবাদের মুখে পুরস্কার ঘোষণার একদিন পর ২৫ জানুয়ারি সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বাংলা একাডেমির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সে তালিকা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন। পুরস্কারের গোটা বিষয়টি ছেলেমানুষী হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। যে কারণে, এর সাথে যারা জড়িত তাদের সকলের বিচারের দাবি উঠেছে। হয়তো আবার তালিকা প্রকাশ হবে। তবে, যেটা ঘটে গেল তার দায় কে নেবে? অবশ্যই সে দায়ভার সংস্কৃতি উপদেষ্টা ও মহাপরিচালক থেকে শুরু করে নির্বাচকমণ্ডলীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে। দায় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আমার মতে, এতো বড় একটা আন্দোলনের পর এমন লোকদের পুরস্কারের জন্য বাছাই করা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রয়োজনে এক বছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার না দিলে এমন কোনো ক্ষতি হতো না। একটু গুছিয়ে নিয়ে পুরস্কার দিলে ভালো হতো। একই সাথে যারা জুলাই বিপ্লবের সাথে সম্পৃক্ত এমন লেখকদের পুরস্কৃত করা উচিত। কিন্তু যেটা ঘটে গেল তাতে করে এই পুরস্কারটি সম্মান আরও হারালো। এমনিতেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই পুরস্কারের মান এতোটাই নেমে এসেছিল যে, অনেক লেখক এই পুরস্কার নেয়ার বিষয়ে অনেকটাই অনাগ্রহী হয়ে গিয়েছিলেন। এমন অনেকেই এই পুরস্কার পেয়েছিলেন, যারা মোটেই পাওয়ার যোগ্যই ছিলেন না। এমন লেখকরা পুরস্কার পেয়েছেন পাঠক তাদের নামও জানেন না বলে অনেকে মনে করেন।
পুরস্কার ফেরত দেয়ার ঘটনা যে শুধু বাংলাদেশেই ঘটেছে তা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটেছে। তবে পুরস্কার ঘোষণা দিয়ে সেটি সম্পূর্ণ তালিকা বাতিল করার ইতিহাস বোধ হয় নেই। তবে বাতিল করে একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নইলে পরিস্থিতি জটিল হতো এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পরবর্তী পদক্ষেপ যথাযথ হয় কি না এবং যোগ্য লেখকরা পুরস্কারের তালিকায় উঠে আসে কি না এটিই এখন দেখার পালা। একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় মর্যাদায় রাখা কর্তৃপক্ষের অবশ্যই কর্তব্য। এ বিষয়ে গাফিলতি কিংবা লুকোচুরি এখন আর কেউ মানবে বলে মনে হয় না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা