২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৬ শাবান ১৪৪৬
`
লেখক হয়ে ওঠার গল্প

গল্পে গল্পে বেলা পেরোয়

-

অ-আ ক-খ সাঙ্গ করে বাক্য ও বাক-বিকাশে যখন মনোযোগ দিচ্ছি, তখনই ছন্দের দোলা চিৎকার করে পড়তে পড়তে, বমনে মনে আওড়াতে আওড়াতে প্রথম ঝোঁকটা তৈরি হয় কবিতা লেখায়। এর ওপর আবার বড় বোনদের কাছ থেকে মুখে মুখে শোনা রবীন্দ্রনাথ আর কাজী নজরুলের দুর্দান্ত গল্পগুলো। তাই জীবনের লক্ষ্য দারোগা-এসডিও না হয়ে কবি হওয়ার দিকেই যেন ঝুঁকে গেল।
আর শিক্ষিত বাঙালিমাত্রই একেকজন কবি।- কথাটা আমার নয়, একজন রাশভারি পল্গিতজনের। তিনি আমাদের গুরুজন, অধ্যাপক যতীন সরকার। এক সেমিনারে মন্তব্যটা করেই বলেছিলেন : অগোচরে বান্ধবীর খোঁপা দেখে এক পঙ্ক্তি হলেও কবিতা লেখেনি এমন শিক্ষিত বাঙালি নেই [জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল : তিনিও লিখেছিলেন কিন া; কিন্তু সাহসে কুলোয়নি]।
ঘষতে ঘষতে একখান কবিতা লিখেই ফেলি। তখন ক্লাস টুতে পড়ি। ১৯৫২ সালে যদি আমার জন্ম হয়, তাহলে সন-তারিখের ধারণাটা পাওয়াই যায়। কয়েক লাইনের কবিতাটা ছিল গোলাপ ফুল, ফুলের বাগান, মাকে নিয়ে ভালোবাসার প্রকাশ। বাহবা দেয়ার লোকের অভাব ছিল না। চলল ওই কবিতাটিরই ঘষামাজা। পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে লেখা পাঠানো যায়, সে খবর জানা নেই। মফস্বল শহরে মধ্যবিত্ত পরিবার তখন পত্রিকার চেহারাই দেখে না। ক্লাস ফোরে ছেপে নিলাম কবিতার লিফলেট। নিজের স্কুলে শহরে ভদ্রজনদের মধ্যে সেই লিফলেট বিনে পয়সায় বিলিয়ে বেড়ালাম বন্ধুরা মিলে। কেউ কেউ আবার সেই লিফলেট নিতেও সঙ্কুচিত, যদি টাকা দিতে হয়! জানানো হলো, কবিতাটা একদম ফ্রি। শহরে আমার নাম ছড়াল : কবি সাহেব।
কোন কোন ক্লাসফ্রেন্ড এখনো আমাকে এই নামেই সম্বোধন করে। উপভোগ করি আমরা।
বিশ্বকবি শুধুই কবিতা লিখতেন না, তিনি কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান লিখতেন- আবার গান গাইতেনও। তাহলে আমিও সব লিখব না কেন? রবীন্দ্র-নজরুলেরই তো উত্তরসূরি আমরা। গানটা আমার গলায় ঠিক আসে না, সুর তো নয়ই। শুরু হলো সাধনা, গান বাদে সাহিত্যের আর সব শাখায়।
আমি তখন এতটুকুন। আমাদের বাসা জামালপুর শহরের এক কোণায়- আমলাপাড়ার শেষ মাথায়, এরপরই মাঝিপাড়ার শুরু। আমাদের ভাড়া বাসা, পাশের বাসাতেই থাকেন আশেক মাহমুদ কলেজের বাংলা বিভাগের এক স্যার- আব্দুর রহমান আব্বাসী। নাটোরে তার বাড়ি। সীমাহীন প্রশ্রয় পেয়েছি তার কাছ থেকে- লেখালেখির সুবাদে।
খাঁচাবন্দী এক মুরগি আর তার বাচ্চাদের নিয়ে একটা গল্প লিখলাম, রূপকার্থে মুক্ত স্বাধীন জীবনের মাহাত্ম্য নিয়ে। পড়ে তিনি চমকপ্রদ হলেন। হৈহৈ করে প্রশংসা করলেন। গল্পটা রেখে দিলেন তার কাছেই।
জামালপুরে তিনি ছিলেন অল্প কিছু দিন। চলে যান তার নিজের এলাকায়- নাটোরে। সেখানকার নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলেজে যোগ দেন। ওখান থেকেই চিঠি লিখে তিনি এই বালককে উৎসাহিত করতেন। তার উদ্যোগেই সেই গল্পটা ছাপা হয় নাটোরের এক ম্যাগাজিনে। সেটিই আমার প্রকাশিত প্রথম লেখা- প্রথম গল্প।
এর মধ্যেই চিনে নিই শহরের খণ্ডকালীন পাবলিক লাইব্রেরিটা- ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে পৌরসভা ও পাবলিক হলের পাশে। বিকেলে বিকেলে খোলা হয় লাইব্রেরি। বই পড়ার ঝোঁক, পত্রিকার পাতা উল্টানোর অভ্যাসও হয়ে যায়। পত্রিকার অন্যতম আকর্ষণ ছোটদের পাতা- মুকুলের মাহফিল, কচি কাঁচার আসর, খেলাঘর, সাত ভাই চম্পা। এসবে টুকটাক ছড়াছড়ি লেখার কাজ চলতে থাকে।
দৈনিক পাকিস্তানের সাত ভাই চম্পায় পরপর দু’টি সপ্তাহে দু’টি গল্প ছাপা হয়ে যায়। একটুখানি কি বুক ফুলে গিয়েছিল?- তখন তো মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ি। ক্লাস এইটে উঠে আমরা ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু মিলে একটা ম্যাগাজিন প্রকাশের উদ্যোগ নিই। আমি সম্পাদক। বন্ধু খসরু মানে আব্দুল বারী খান প্রকাশক। ম্যাগাজিনের নাম প্রভা। ওখানে আমার একটা গল্প ছিল। সাদামাটা নির্দোষ একটি সাহিত্যের ম্যাগাজিন। কিন্তু ওর মাঝেও বিষাক্ত কেউকেটার বাচ্চার বিষ খুঁজে পেল ময়মনসিংহ জেলার এসবি।
এখন বুঝি দোষ যতটুকু ম্যাগাজিন ও আমাদের, তার চেয়েও বেশি আমাদের দুই পরিবারের ঐতিহ্যের।
আব্দুল বারী খানের ঘনিষ্ঠ এক স্বজন জর্জিস খান তৎকালীন আন্ডারগ্রাউন্ড কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। তার সাথে আমাদের খানিক মাখামাখি ছিল।
আমাদের পরিবার আরো বিপজ্জনক। আমাদের সব বড় ভাই তখন জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজের জিএস। ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল পদবি নিয়ে আয়ুব খানের উত্থান ও পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা দখল, সেই সময়টায় জামালপুরের এক বিপ্লবী আলী আসাদ কালো খোকার নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন মুভমেন্টের তৎপরতা শুরু হয়। এর সাথে আমার বড়ো ভাইও যুক্ত হন এবং পরে গ্রেপ্তার হন।
সুতরাং এমন দুটি বিপজ্জনক পরিবারের বালক দুই ছেলের ম্যাগাজিন প্রকাশের উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। নেমে আসে সরকারি খড়্গ। প্রেস এন্ড পাবলিকেশনস এ্যাক্টের দোহাই দিয়ে সম্পাদক ও প্রকাশকের উপর জারি করা হয় সমন এবং ম্যাগাজিন বাজায়েপ্ত করে সবগুলো কপি নিয়ে যাওয়া হয়।
লেখালেখি ও সম্পাদনা নিয়ে বিড়ম্বনার প্রথম পাঠ আমার বাল্যকালেই।
পরবর্তিতেও লেখালেখি, বিশেষ করে গল্প লিখে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে বেশ কয়েকবার।
গল্প লেখার জন্য দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা থেকে প্রথম সম্মানী পাই ১৯৭০ সালে। নগদ বিশ টাকা। তখন আমি ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। পনেরো টাকা দিয়ে ঢাউস একটা বই কিনি : কমপ্লিট ওয়ার্কস অব শেক্সপিয়ার।
আর বাকি পাঁচ টাকায় বন্ধুদের নিয়ে এক ছাপড়া হোটেলে চা সিঙ্গারা পুরি খাওয়া চলে। সেদিনের সেই প্রাণভরা খুশির দোলা ভুলবার নয়।
এই সময়কালেই আমার তিনটি বই প্রকাশের উদ্যোগ হয়- আমার সেই কৈশোরেই। একটি গল্পের বই, একটি প্রবন্ধের বই আর একটি কবিতার বই। আংশিক রয়্যালটি হিসেবে অগ্রিম সাড়ে সাত শ' টাকা পেয়েও যাই।
এর পরই মুক্তিযুদ্ধ। সময়ের তরঙ্গে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি উঠে যায়, ডামাডোলে পাণ্ডুলিপিগুলোও হারিয়ে যায়।
ইতোমধ্যেই বুঝে গিয়েছি, কবিতা লেখা আমার কম্মো নয়। গল্পেই মন অভিনিবেশ করি।
গল্প লেখারও তো ঝক্কি কম নয়। বিড়ম্বনা কম সামলাতে হয়নি।
১৯৭৬ সালে ঢাকায় পড়াশোনা সব ছেড়েছুড়ে উড়োনচণ্ডি জীবন কাটাচ্ছি। আর গল্প লেখা নিয়ে নানান এক্সপারিমেন্ট। মনোজ্বালায় আবার কখনো কখনো মুডও যায় বিগড়ে।
গোলাম কাদের গোলাপ। কবিতা লেখেন। এখন তিনি পরিচিত সাংবাদিক। তার বন্ধু আশরাফ আলম কাজল। সম্প্রতি বিগত হয়েছেন। ব্যাংকার ছিলেন। তরুণকালে তুখোড় ছাত্রনেতা ও সংগঠক। মুন্সীগঞ্জে তাদের বাড়ি। গত শতকের সত্তরের দশকেই মুন্সীগঞ্জেই বিশাল সাহিত্য সম্মেলন করে সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিলেন।
এই দুই বন্ধু মিলে একটা লিটল ম্যাগ করতেন : অনিকেত।
বাউণ্ডেলে আমার কাছে গোলাপ গল্প চাইলেন তাদের ম্যাগাজিনের জন্য। বললাম, আমার এখন লেখার কোনো মুড নাই। একটা গল্প অবশ্য আছে, এখনকার সময়ে ছাপা বিপজ্জুনক। এ কথাটা বলেছিলাম তাকে নিবৃত্ত করার জন্য, ফল হলো উল্টো- উৎসাহ তার আরো বেড়ে গেল। তার সাফ জবাব, এমনিতেই ম্যাগাজিনটা বেরোতে বিলম্ব হয়। গল্প ছাপার জন্য না ুহয় বন্ধই হয়ে ুযাবে। গল্পটা ছাপা হয়েছিল কি না জানি না, লোকদের মুখে খবর পেলাম: কাজল-গোলাপের অবস্থা ঝামেলাপূর্ণ। অনিকেত মুন্সীগঞ্জে ভালোই বিক্রি হচ্ছিল, কিন্তু রক্ষণশীল কিছু লোক তাদের উপর হামলা চালিয়েছিল। জেলহাজতে ছিলেন পুরো একদিন। ম্যাগাজিনের সব কপি বাজেয়াপ্ত করেছে। ম্যাগাজিনটির মুদ্রক ছিলেন কামরুল ইসলাম ( পরবর্তিতে খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন); প্রেসে তালা লাগিয়ে তিনি পলাতক।
আর লেখক? সে তো বোহেমিয়ান। চালচুলোর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। তাকে খুঁজে পাবে কোথায়?
গল্প লেখার জ্বালা এখনো ফুরোয়নি আমার।
পোড়ার এই দেশে যখন জন্মেছি, লেখকের জ্বালা-যন্ত্রণা তো থাকবেই। আর জ্বলুনিটা জন্ম থেকেই। ভাষা নিয়ে যখন তুমুল লড়াই সেই ১৯৫২ সালে আমার জন্ম। সে সময়কার বঞ্চনা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আর সামরিকতন্ত্রের দাপট রাজনীতির ভিতটাকে নাড়িয়ে দিয়ে পুরো দেশটাকেই তছনছ করে দেয়। এরই বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলার জনগণ। মুক্তিযুদ্ধ জন্ম দেয় এক নতুনতর স্বপ্নের বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তানি রাজনীতির প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের তাণ্ডব এখানেও তাথৈমাথৈ চালাতে শুরু করে।
বিষয়গুলো আমার কলমকে খুব স্পর্শ করে। সামরিক শাসনের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় কলম।
আশির দশকে তরুণদের প্রিয় লিটল ম্যাগাজিন ‘বিপক্ষে’। সম্পাদক সুপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আবু সাঈদ জুবেরী, শক্তিমান গল্পকার আহমদ বশির ও লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কবি জাহিদ হায়দার। বিপক্ষের এক সংখ্যায় ছাপা হলো আমার এমন ধারার এক গল্প। এ জন্য ঝামেলায় পড়ে যান সম্পাদকবৃন্দ। বিশেষ করে আবু সাঈদ জুবেরীকে মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়।
বিপক্ষে কিন্তু আমার গল্প ছাপা বন্ধ করেনি।
ঝামেলা পোয়াতে হয় কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালকেও। তার সম্পাদিত এক লিটল ম্যাগে আমার গল্প প্রকাশ করে। পুলিশি তলবের মুখে পড়তে হয়।
দেশের এই পরিস্থিতি কি পাল্টেছে?
পাল্টেছে তো বটেই। আগে ব্যাপারগুলো মিটে যেত তলব, হাজিরা, নোটিশের মধ্যে, বড় জোর জেলহাজতে। এখন তো তা নেই- তৈরি হয়েছে নতুন ধারা: গুম, খুন।
লেখকেরও বয়স বাড়ে। বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ে ভয়। তাই লেখক আমি চলে যাই রূপকথায়। না, থামিনি। লিখছি।


আরো সংবাদ



premium cement
মহিষ কিনতে ভারতে ৫ কর্মকর্তা বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের জন্মবার্ষিকী আজ দুই ঘণ্টা পর জামান টাওয়ারের আগুন নিয়ন্ত্রণে পল্টনে জামান টাওয়ারে আগুন খুব দ্রুতই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে : আসিফ মাহমুদ লোহাগাড়ায় বৈদ্যুতিক তারের স্পার্ক থেকে লাগা আগুনে খড়বোঝাই পিকআপ পুড়ে ছাই ফতুল্লায় নিখোঁজ শিশুর লাশ ইটভাটার ঝোঁপ থেকে উদ্ধার যাত্রাবাড়ীতে যুবককে কুপিয়ে হত্যা, ছিনতাইকারীর গুলিতে আহত ১ ছিনতাইকারী সন্দেহে টঙ্গীতে যুবককে হত্যা, উত্তরায় ২ জনকে ঝুলিয়ে গণপিটুনি একটি পরিবারকে আমানতের ৮৭ শতাংশ দেয়া হয়েছে : গভর্নর টাঙ্গাইলে বনভোজনের বাসে ডাকাতি, অস্ত্রের মুখে মালামাল লুট

সকল