মধুসূদনের বাংলা ভাষায় প্রত্যাবর্তন
- সায়ীদ আবুবকর
- ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
মধুসূদন কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন তার কৈশোরে। এসব কবিতা লিখতেন তিনি ইংরেজি ভাষায়। সব লেখকেরই লেখক-জীবনের একটা প্রস্তুতিকাল থাকে, যে-সময়টিতে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সফলতা-বিফলতার মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে তারা অভিজ্ঞ ও পরিপক্ব করে তোলেন। এটা বড়ই বিস্ময়কর যে, বাংলা ভাষার যিনি পরবর্তীতে মুখ্য কবিরূপেই প্রতিষ্ঠিত, তাঁর কাব্যজীবনের প্রস্তুতিকাল কেটেছে মাতৃভাষাতে নয়, ইংরেজি ভাষায়; বাংলাভাষীদেরকে তিনি যে অসম্ভব সুন্দর সাহিত্যসম্ভার উপহার দিয়ে গেলেন, তার জন্য তার কোনো বিশেষ প্রস্তুতিকাল ছিল না। বাংলা ভাষায় মধুসূদনের প্রবেশ ছিল জুলিয়াস সিজারের মতো- ভিনি ভিডি ভিসি- এলাম, দেখলাম আর জয় করে নিলাম। ধূমকেতুর মতো এলেন, স্থায়ী হলেন ক্ষণকাল, কিন্তু নিভে গেলেন না শেষ পর্যন্ত, মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে নক্ষত্ররূপেই জেগে রইলেন বাংলার সাহিত্য-আকাশে, জ্বলজ্বল করে আজও জ্বলছেন আর বিস্ময়ের উদ্রেক করছেন।
মধুসূদন জন্মগ্রহণ করেন ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। তার প্রথম যে-ইংরেজি কবিতা 'My Fond Sweet Blue Eyed Maid' আমরা পাই, তার রচনাকাল ২৮ মার্চ ১৮৪১। অর্থাৎ তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর। কিন্তু সে-বয়সেই তার কাব্যভাষা পরিপক্বতার চূড়া স্পর্শ করেছিল। ইংরেজি কবিতা লেখার সূক্ষ্ম সব কলাকৌশল রপ্ত করে ফেলেছিলেন মধুসূদন সেই কিশোর বয়সেই। দ্য ক্যাপটিভ লেডি রচিত হয় ১৮৪৮ সালের দিকে। কিন্তু এটি প্রত্যাশিত উচ্চ প্রশংসা-লাভে ব্যর্থ হলে তিনি ইংরেজি কবিতা লেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বেথুন সাহেব দ্য ক্যাপটিভ লেডি পাঠ করে তার মৌলিক কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে মাতৃভাষায় কাব্যচর্চা করার পরামর্শ দেন, যা মধুসূদনের মনকে ঘুরিয়ে দেয় এবং খুলে দেয় তার দৃষ্টির দরোজা। তিনি অনুধাবন করতে পারেন যে, একজন পরাধীন ভারতীয়ের পক্ষে ইংরেজিতে কাব্য রচনা করে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে তাকে ‘নিজাগারে’ প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল, যা যথার্থই সুফল বয়ে এনেছিল, নিজের জন্য তো বটেই, বাংলা ভাষা তথা বাঙালি জাতির জন্যও।
১৮৬০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মধুসূদন রাজনারায়ণ বসুকে এক ইংরেজি চিঠিতে লেখেন, ‘আমি আমাদের ভাষায় সনেট প্রবর্তন করতে চাই এবং কয়েকদিন আগে এক সকালে এই সনেটটি তৈরি করেছি।’ সনেটটির নাম ‘কবি-মাতৃভাষা’। পরবর্তীকালে কবি এটিকে ঘষামাজা করে ‘বঙ্গভাষা’ নাম দেন।
নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন
অগণ্য; তা সবে আমি অবহেলা করি,
অর্থলোভে দেশে দেশে করিনু ভ্রমণ,
বন্দরে বন্দরে যথা বাণিজ্যের তরী।
মনে করা হতো, এটাই মধুসূদনের লেখা প্রথম সনেট। প্রথম সনেট বাংলা ভাষায়, সন্দেহ নেই; কিন্তু মধুসূদনের প্রথম সনেট এটি নয়, তিনি প্রথম সনেট লেখেন ইংরেজি ভাষায়, এর প্রায় ২০ বছর আগে।
পরাধীন ভারতকে কখনো নিজের দেশ মনে হয়নি মধুসূদনের। তার হৃদয়জুড়ে ছিল উন্নত সভ্যতার দেশ ইংল্যান্ড এবং সেখানে যাওয়ার জন্য কী আকুতি ছিল মনে, তা দেখতে পাই আমরা তার একটি ইংরেজি সনেটে। সনেটটি খিদিরপুরে লেখা, ১৮৪২ সালে।
খাঁচার বিহঙ্গ সম ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস
ত্যাগিতে স্বদেশ মম; যদিও সুন্দর
সবুজ ইহার ক্রোড়, নির্মল আকাশ,
ফুল ফল, তবু তাতে ভরে না অন্তর।
দেখিয়াছি স্বপ্নে এক কী-স্বাধীন দেশ-
সুধর্ম যেথায় নিত্য করিছে বিরাজ,
স্বর্গীয় সুখের সেথা নাহি কোনো শেষ!
সেই দেশে চিত্ত মম ছুটি’ চলে আজ।
মনুষ্য মনুষ্যপদে নোয়ায় না শির,
নিসর্গ যথার্থ সেথা ছড়াইছে বিভা;
এ হেন বিজ্ঞানরাজ্য নাহি পৃথিবীর
অন্য কোথা, নাহি এত বিপুল প্রতিভা।
সে স্বর্গদেশের লাগি কাঁদে এই মন-
সেথা মরিলেও হতো ধন্য এ জীবন।
মধুসূদনের সাহিত্যিক-কাল ছিল নাতিদীর্ঘ, কিন্তু অর্জন বিশাল, বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি দীর্ঘকালীন। ঝটিকার মতো আবির্ভাব- এলেন আর দুমড়ে মুচড়ে চুরমার করে দিলেন সব জরাজীর্ণ ও পুরাতনকে; কিন্তু ভেঙেচুরেই শুধু ক্ষান্ত হলেন না, তদস্থলে নির্মাণ করলেন বিস্ময়কর সব নতুন, মুহূর্তের মধ্যে; এবং মুহূর্তের মধ্যেই করলেন প্রস্থান। ফলে বিচ্ছেদের ব্যথাটা বড়ই গভীরে গিয়ে লাগল বাঙালির। বাঙালি সবার কথাই অল্প-বিস্তর ভুলল, কিন্তু ক্ষণিকের জন্যও মধুসূদনকে নামাল না তাদের হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে।
কথিত আছে, ছোটকালে মধুসূদন ‘পৃথিবী’ লিখতে গিয়ে ‘প্রথিবী’ লিখে ফেলে পণ্ডিত মশাইয়ের কাছে বকা খেয়েছিলেন; ফলে বাংলা ভাষাকে বড়ই জটিল ভাষা মনে হয়েছিল তার কাছে এবং জন্মেছিল বিরাগ; সেই বিরাগই শেষে অনুরাগ হয়ে তাকে দিয়ে বাজিয়েছিল অর্ফিয়ুসের বাঁশি; বাদক চলে গেছে, কিন্তু তার সুর আজও ভেসে বেড়াচ্ছে বাংলার আকাশে বাতাসে। বাস্তবিকই- ‘ঘৃণা হতে প্রেম, প্রেম হতে ঘৃণা; একটি হয় না অন্যটি বিনা।’ সাগরদাঁড়ির ছেলে মধুসূদন পুরোদস্তুর সাহেব হতে গিয়ে, মহাকবি মিল্টন হতে গিয়ে ফিরে এলেন বাঙালি-কবি মধুসূদন হয়ে; বাঙালি জাতির জন্য এটা ছিল দৈববরের মতো। বিলেত, ভার্সাই ঘুরে এসেও মধুসূদন যে কখনো সাহেব হতে পারেননি, তার স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় তার ঢাকা-সংবর্ধনার বক্তৃতাতে- ‘আমার সম্বন্ধে আপনাদের আর যে কোনো ভ্রম হউক, আমি সাহেব হইয়াছি, এ ভ্রমটি হওয়া ভারি অন্যায়। আমার সাহেব হওয়ার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ও শয়ন করিবার ঘরে একখানি আর্শি রাখিয়া দিয়াছি এবং আমার মনে সাহেব হইবার ইচ্ছা যেই বলবৎ হয়, অমনি আর্শিতে মুখ দেখি। আরো, আমি সুদ্ধ বাঙ্গালি নহি, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটি যশোহর।’ তিনি নিজেই লিখে গিয়েছেন তার সমাধি-লিপি, যেখানে ফুটে উঠেছে তার আত্মপরিচয় ও জন্মভূমিপ্রেম :
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা