‘চমক দেখি তার’ ও ছন্দ নিরীক্ষায়
- আবু তাহের সরফরাজ
- ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
কাজী জহিরুল ইসলাম বিরলপ্রজ কবি। কেন বিরলপ্রজ? এই কারণে যে, তার প্রতিটি কবিতার বইতেই থাকে বিচিত্র রকমের নিরীক্ষা। কখনো ছন্দের ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়ে কোনো বইয়ের কবিতায় স্থিত হয় বিশেষ কোনো ছন্দের কারুকাজ। কখনো আবার বিষয়বৈচিত্র্যে কবিতার ভাব ও ভাষা কবিতার অপ্রচল কোনো আঙ্গিককে প্রতিষ্ঠিত করে। কোনো বইতে দেখা যায়, ভাষাশৈলীর আশ্চর্য সূক্ষ্ম বুনন। আসলে জহিরুল ভাবের কবি নন, প্রজ্ঞার কবি। কিছু একটা ভাব মনে উদয় হলো এরপর লিখে ফেললেন কবিতা, তেমনটি নয়। ভাব হচ্ছে কবিতার প্রাণ। ফলে তার কবিতায় ভাব তো আছেই, এর ওপর জহিরুলের কবিতায় থাকে নানা আঙ্গিকের বিচিত্র নিরীক্ষা। ফলে তার প্রতিটি কবিতার বই বাংলা কাব্যসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলেই আমরা মনে করি।
২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রকাশনা সংস্থা ‘সংযোগ’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতার বই ‘চমক দেখি তার’। আগের বইগুলোর কবিতার মতোই এই বইয়ের কবিতায়ও তার শৈল্পিক নিরীক্ষা চোখে পড়বে। ‘চমক দেখি তার’ শিরোনামে দীর্ঘ একটি কবিতা বইয়ের শুরুতে রয়েছে। এ কবিতাটি লেখা হয়েছে সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। চার, পাঁচ কিংবা ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তেই বেশির ভাগ কবি কবিতা লেখেন। কিন্তু সাত মাত্রায় লেখা কবিতার সংখ্যা তেমনভাবে আমাদের চোখে পড়ে না। কারণ সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্তে বাক্য তৈরি করে কবিতা রচনা বেশ দুরূহ। খুব মেধাবী কবি না হলে এ কাজটি করা সম্ভব নয়। আর সম্ভব হলেও সেই কবিতা শব্দের জগাখিচুড়ি হয়ে যায়। কিন্তু ‘চমক দেখি তার’ কবিতায় সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্ত এতই নিপুণ উপায়ে সজ্জিত হয়েছে যে, পড়তে পড়তে বিস্মিত হতে হয়। কবিকে মনে হতে থাকবে, শব্দের জাদুকর। শব্দের সাথে প্রগাঢ় প্রেম না থাকলে সাত মাত্রায় প্রতিটি পর্বকে শৃঙ্খলিত করা সম্ভব নয়। বলেছি বটে শব্দেরা শৃঙ্খলিত, কিন্তু প্রতিটি পর্বে শৃঙ্খলিত সাত মাত্রার শব্দের স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতা কোত্থাও সামান্য বিঘিœত হয়নি; বরং পাঠক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করবেন, পর্বভুক্ত শব্দ স্বকীয় ব্যঞ্জনা ছাড়িয়েও বিষয়ের বিস্তৃতির দিকে কোনো গূঢ় ইঙ্গিত যেন বহন করছে। জহিরুল সত্যিই শব্দের জাদুকর। তা না হলে সাত মাত্রার মতো দুরূহ মাত্রাবৃত্তে এহেন শৈল্প-নৈপুণ্য প্রকাশ করতে পারতেন না। পাঠক ভাবতেই পারেন, একটু চেষ্টা করলেই যেকোনো কবি সাত মাত্রার পর্বে কবিতা নির্মাণ করতে পারেন। যতটা তাদের ভাবনা, নির্মাণশৈলী ততটা সহজেই ঘটে যাওয়ার কৌশল নয়। কাজী জহিরুল ইসলাম এ বিষয়ে বইয়ের ভূমিকায় আমাদের জানাচ্ছেন, ‘সাত মাত্রা হলেই হবে না, এর অভ্যন্তরীণ বিন্যাসও ঠিক থাকতে হবে। কিছুতেই ৪+৩ বা ২+৩+২ বিন্যাসে লিখলে হবে না, লিখতে হবে ৩+৪ বিন্যাসে। প্রথম তিন মাত্রা যেকোনো বিন্যাসে, মানে ১+২ বা ২+১ বা ১+১+১ এ তৈরি করা যেতে পারে, কিন্তু পরের চার মাত্রা তৈরি করতে হবে ২+২ বা ১+১+১+১ বা ১+১+২ বা ২+১+১ বিন্যাসে। ১+২+১ বিন্যাসে লিখলে ছন্দটা হোঁচট খাবে।’ তো, পর্বের এই সূক্ষ্ম গাণিতিক হিসাব অনুসরণ করে সাত মাত্রার পর্বে মাত্রাবৃত্ত ছুন্দের যে নিরীক্ষা দীর্ঘকবিতাটিতে জহিরুল করেছেন, তার এই শিল্প-কুশলতাকে ঈর্ষা না করে কোনো কবিরই উপায় থাকে না। বলা দরকার, কবিতাটি প্রায় দেড় হাজার পর্বে বিন্যস্ত। দীর্ঘ এই পর্ব নির্মাণে জাত-ছান্দসিক না হলে ছন্দের এহেন নিখুঁত কারুকাজ সম্ভব নয়। প্রতিটি পর্বের শুরুতে রয়েছে তিন মাত্রা, এরপর চার মাত্রা। আমরা জানি, ছন্দের বেশির ভাগ কবিতায় সাধারণত অপূর্ণ একটি পর্ব থাকে বাক্যের শেষে। এই কবিতায় কোত্থাও অপূর্ণ পর্ব নেই। প্রতিটি পর্বই সাত মাত্রার। একটি বাক্য পড়ে দেখা যাক, ‘ভ্রাতৃহত্যার/নিঠুর চর্চায়/মানুষ সেই থেকে/পাচ্ছে নিষ্ঠুর/পাপের মন্ত্রণা।’ প্রতিটি পর্ব শুরু হয়েছে তিন মাত্রা দিয়ে, এরপর চার মাত্রা। কী অভূতপূর্ব প্রবহমানতা!
আজকাল কবিদের বলতে শোনা যায়, ছন্দের প্যাটার্নটাই সেকেলে। কবিতাকে হতে হবে ছন্দমুক্ত, স্বাধীন। স্বাধীনতার মানে তারা কী বোঝে, তারাই জানে। স্বাধীনতারও কিন্তু একটি নিয়মতান্ত্রিকতা থাকে, বিধান থাকে। প্রকৃতি রাজ্যে প্রতিটি উপাদানই নির্দিষ্ট ছন্দে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পাদন করে চলেছে। প্রত্যেকের ভেতরই রয়েছে সম্মিলিত ঐক্যের সুসংহত ছন্দ। তবে সেই ছন্দ আমাদের কানে এসে পৌঁছায় না। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা সেই ছন্দের কথা জানেন। আর জানেন সুফি-সাধকরা। বলতে কী, ছন্দের শৃঙ্খলা ভেঙে যেদিন কবিতা লেখা শুরু হলো সেদিন থেকেই বাংলা কবিতার বারোটা বেজে গেছে। খুব শক্তিশালী কবি না হলে ছন্দশূন্য পঙ্ক্তিকে কবিতা করে তোলা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ তো জ্বলজ্বল করছেন। আরো অনেকেই আছেন। ছন্দশূন্য কবিতা প্রচলন হওয়ার কারণেই প্রলাপের মতো বাক্য লিখে হরেদরে এই দেশে যে কেউ কবি হয়ে যাচ্ছে। এদের বেশির ভাগ কবিতাই পাঠকের মাথার ওপর দিয়ে যায়। কবিরাও জানে না, তারা কী লিখছে। কিন্তু কবি যে হতেই হবে, এই খায়েশ তাদেরকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে। আমাদের পাঠক যেহেতু গণমাধ্যমের গুজব শুনে সাহিত্য পাঠ করে, এ কারণে সাহিত্যমান তাদের কাছে কোনো বিষয় বহন করে না। তারা দেখে, কবি হিসেবে যশ।
‘চমক দেখি তার’ ছাড়াও অন্যান্য বইতেও কাজী জহিরুল ইসলাম ছন্দের কবিতা লিখেছেন। এরই পাশাপাশি ছন্দকে হটিয়ে দিয়ে গদ্যের ঢঙে সাজিয়েছেন শব্দপুঞ্জ। অথচ পাঠক সেসব কবিতা পড়েও মুগ্ধতার আবেশ কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। কারণ, শব্দের গাঁথুনির ভেতরই লুকনো রয়েছে দোলায়িত ছন্দের সূক্ষ্ম কারুকাজ। তো, ছন্দের যে নিরীক্ষা ‘চমক দেখি তার’ বইতে কবি করেছেন সেই নিরীক্ষা বাংলা কবিতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কাব্য ও ছন্দ গবেষকদের জন্য এই বইটি অবশ্য পাঠ্য হিসেবে গণ্য।
ছন্দের নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে কবিতায় যে ভাব ও ভাবনার স্ফুরণ ঘটেছে তা যে কোনো প্রজ্ঞাবান মানুষের দার্শনিক পর্যটন। অসংখ্য বিচিত্র বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটেছে কবিতার নানা পঙক্তিতে। কখনো ধর্মগ্রন্থ ও পৌরাণিক বর্ণনা, কখনো দর্শন-বিজ্ঞান, আবার কখনো সমসাময়িক আন্তর্জাতিক রীতিনীতি। বহুবর্ণিল চিত্রকল্পে কাজী জহিরুল ইসলাম বিধৃত করেছেন অসংখ্য উপমা, যা কবিতার সৌন্দর্যকে রাঙিয়ে দিয়েছে নক্ষত্রসম মৌলিক দ্যুতিতে। বইটির শিরোনামে যার চমকের কথা বলা হচ্ছে সে আসলে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড। মহাবিশ্বের আদি-অন্ত-স্থিতিজুড়ে যে লীলাচক্র সেই চক্রের প্রতি মুহূর্তের চমক এই বইয়ের প্রতিটি বাক্য। এ কথাটি হয়তো বাড়িয়েই লিখে ফেললাম। কিন্তু প্রাজ্ঞজন মাত্রই জানেন, ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যের শত ভাগের মধ্যে মাত্র চার ভাগ এখন পর্যন্ত মানুষ জানতে পেরেছে। তাও এসব মানুষের বেশির ভাগই বিজ্ঞানী। কাজী জহিরুল ইসলাম বিজ্ঞানী নন, কবি। ফলে তার আত্মোপলব্ধির ভেতর তিনি ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য যতটা ধরতে পেরেছেন ততটাই শৈল্পিক সৌন্দর্যে রাঙিয়ে নির্মাণ করেছেন এই কবিতা। প্রকৃতি রাজ্যের লীলাদৃশ্যে চমকে চমকে উঠছেন আর লিখছেন ব্রহ্মাণ্ডের শত-সহস্র চমক। কবিতাটি শুরুর তিনটি বাক্য পড়া যাক :
মনের মসজিদে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নফল প্রার্থনা করো হে মুসাফির।
বেথেলহেম থেকে মক্কা-মদিনায় ছুটছো অহেতুক,
পূজোর অর্ঘ্য তো দেবার মূল গৃহ হৃদয় মন্দির।
এই তিন বাক্য আসলে প্রবেশক দরজা। মানে, ব্রহ্মাণ্ডের অন্দর মহলে ঢোকার আগে প্রস্তুতিমূলক বাণী। পাঠককে আত্মার আয়নায় মনোদৃষ্টি নিবদ্ধের অনুরোধ করছেন কবি। হৃদমন্দিরেই তো রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের সব উপাদান। এরপর একে একে পাঠক পর্যটন করতে থাকেন মহাবিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কখনো সৃষ্টির আগে, কখনো সৃষ্টির পরে, আবার মহাবিশ্ব ধ্বংসের পরবর্তী পটভূমিকায়। এই যাত্রাই পাঠক চমকে উঠবেন। শিহরিত হবেন। কখনো রোমাঞ্চিত হবেন। ‘চমক দেখি তার’ দীর্ঘ কবিতাটির পর ১৯টি কবিতা রয়েছে বইতে। প্রতিুুটি কবিতাই প্রথম কবিতাটির সম্প্রসারণ। কিংবা বলা যেতে পারে, ব্যাখ্যামূলক এক ধরনের কাব্যকীর্তি। বইটির পাঠশেষে মনস্বী পাঠক নিশ্চিত হবেন যে, বাংলা কবিতার ইতিহাসে এই বইটি কালোত্তীর্ণ হওয়ার গুণাবলিসম্পন্ন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা