১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ মাঘ ১৪৩১, ১৪ রজব ১৪৪৬
`
স্মৃতি বিস্মৃতির দোলাচল

সৈয়দ আলী আহসানের আলোকদিয়া

সৈয়দ আলী আহসানের আলোকদিয়া -

‘আমার পূর্ব বাংলা কবিতার কবি সৈয়দ আলী আহসান নামটি ইদানীং আর বেশ একটা উচ্চারিত হতে দেখি না। তার মৃত্যুর পর খুব বেশি একটা দিন তো যায়নি। তারপরও আমরা বিস্মৃত জাতি এত বড় মাপের একটা লোককে মনে রাখতে পারলাম না। জাতি হিসেবে এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন বড় মাপের ব্যক্তিত্ব তিনি। তাই তার নামের আগে পিছে কোনো বিশেষণ যোগ করে তাকে চিনিয়ে দেয়ার কোনো অভিপ্রায় এই অধমের নেই। সেন্টার ফর ন্যাশনাল কালচার (সিএনসি’র একজন পৃষ্ঠপোষক মরহুম সাংবাদিক, লেখক সানাউল্লা আখুঞ্জীর অনুপ্রেরণায় কবি সৈয়দ আলী আহসানের ধানমণ্ডির বাসায় কয়েকটি সাহিত্য সভায় যোগদানের এবং সে সুবাদে কবির খুব কাছে যাওয়ার আমার সোভাগ্য হয়েছিল। সে সাহিত্য সভাকে কেন্দ্র করে দু-একটি বিষয় আজও স্মৃতিপটে তরতাজা মনে হয়। সে সভায় ফুল-কুঁড়িরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। কবি তাদের একজনকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলেন, ‘বলত, ফুল আগে না কুঁড়ি আগে? জবাব এলো কুঁড়ি আগে, ফুল পরে। পাল্টা প্রশ্ন- তাহলে কুঁড়ি ফুল নয় কেন? জবাব এলো- সুন্দর লাগে না বিধায় আগপিছ করা হয়েছে। জবাবটি কবির মনঃপূত হয়েছিল। আর আমিও ভাষার একটা অন্তর্নিহিত সত্য, যা কিনা সব ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অনুধাবন করলাম।
কবি নজরুলের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে আমি কবির ‘বাজিছে দামামা, বাঁধরে আমামা কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ অধুনালুপ্ত দি বাংলাদেশ অবজারভারসহ আরো তিনটি ইংরেজি পত্রিকায় ছাপানোর জন্য পাঠিয়েছিলাম। আর সেটিই আমি কবির বাসায় সাহিত্যসভায় পাঠ করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। কবিতাটি পাঠ করার পর কবি আমার অনুবাদটি হাতে নিয়ে বেশি নয়, মাত্র ৪ কি ৫টি শব্দ পরিবর্তন করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি তার শব্দ চয়নে এতটাই মুগ্ধ হলাম যে, আমার মনে হলো আমি ঐসব পত্রিকা অফিসে গিয়ে সাহিত্য সম্পাদককে অনুরোধ করে এখনি কারেকশন করে দেই। কিন্তু হায়, তা আর হবার নয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশ অবজারভার, দি নিউ নেশান ও দি ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় আমার লেখাটি ছাপা হয়ে যায়। কবির হাতের পরষে আমার অনুবাদটি রূপা থেকে সোনায় পরিণত হয়েছিল। মনে মনে ভাবলাম, হায় কেন আগে কবির সাথে দেখা হলো না? এটা ১৯৯৯ সালের মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দিকের ঘটনা। এর তিন বছর পর অর্থাৎ ২০০২ সালের ২৫ জুলাই কবি ইন্তেকাল করেন।
কথায় কথায় অনেক কথা বলে ফেললাম। কিন্তু আসল কথা বলা হলো না। কথায় বলে মক্কার লোকেরা হজ পায় না। আসলেও ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম। কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আলী আহসান ১৯২২ সালের ২৬ মার্চ বাংলা প্রদেশের মাগুরার পূর্বে যশোর জেলার অন্তর্গত আলোকদিয়া গ্রামে এক বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আজ থেকে ৩৬ বছর আগ থেকে বৈবাহিক সূত্রে মাগুরায় আমার যাওয়া-আসা। তাই অনেকবার ভেবেছি আলোকদিয়ায় গিয়ে কবির জন্মস্থানটা দেখে আসব। কিন্তু যাব যাব করে আর যাওয়া হয়নি। কিন্তু, সেদিন অর্থাৎ গত ১২ ডিসেম্বর আমার সর্বকনিষ্ঠ শ্যালকের শ্বশুরালয় বাগবাড়িয়া গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মধুমতি নদীর তীরবর্তী সে গ্রামের পাকা রাস্তার মাইলফলকে একটি নাম দেখতে পেয়ে চোখটা যেন তাতে আটকে গেল। মাইলফলকে লেখাছিল আলোকদিয়া বাজার ৩ কি.মি.। মনটা আমার আনন্দে নেচে উঠল। শ্যালককে বলাম, মোটর বাইক স্টার্ট দাও, আলোকদিয়া যাব। প্রশ্ন করল, কেন, সেখানে কী। বললাম তুমি বুঝবা না, আগে চলো। পিচ ঢালা রাস্তা বেয়ে মাত্র কয়েক মিনিটেই চলে এলাম আলোকদিয়া বাজার। শ্যালক প্রশ্ন করল এবার কোথায় যাবেন? অপেক্ষা করো, এ কথা বলে একজন মুরব্বি মানুষের খেঁাজ করলাম। জুটেও গেলেন একজন। ষাটোর্ধ্ব ওই লোককে বললাম, ভাই, এটা তো আলোকদিয়া বাজার, তাই না? এখানে আলোকদিয়া নামে কোনো গ্রাম আছে? তিনি হঁ্যা, বলতেই আমি প্রশ্ন করলাম, আপনি কি সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের বাড়িটা চিনেন তিনি রাস্তা বাতলে দিলেন। নতুন জায়গা বিধায় চিনতে একটু কষ্ট হলেও সে মোতাবেক গিয়ে দেখি সে এক অজপাড়া গাঁ। যেন শত বর্ষ আগেকার কোনো গ্রাম। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, চিকন সরু রাস্তাটি কাঁচা নয়, পাকা। আর আছে বিদ্যুৎ। আমি বিস্ময়াবিভূত হয়ে দেখলাম, এ তো সে গ্রাম যে গ্রামের বর্ণনা আমরা তার লেখা আমার পূর্ববাংলা কবিতায় দেখতে পাই।
আমার পূর্ব বাংলা
‘আমার পূর্ব-বাংলা এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ
অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
সন্ধ্যার উন্মেষের মতো
সরোবরের অতলের মতো
কালো-কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো
বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি
আমার পূর্ব-বাংলা বর্ষার অন্ধকারের অনুরাগ
হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া
সিক্ত নীলাম্বরী
নিকুঞ্জের তমাল কনক-লতায় ঘেরা
কবরী এলো করে আকাশ দেখার
মুহূর্ত
অশেষ অনুভব নিয়ে
পুলকিত সচ্ছলতা
এক সময় সূর্যকে ঢেকে অনেক মেঘের পালক
রাশি রাশি ধান মাটি আর পানির
কেমন নিশ্চেতন করা গন্ধ--
সে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। আমরা যখন তার পিতৃভিটার বহিরাঙ্গিনায় পেঁৗছি তখন বেলা ১২টার সামান্য বেশি। কুয়াশার কারণে শুধু তখনই না, সারাদিনই সূর্যের দেখা মেলেনি। বহিরাঙ্গিনার দু’পাশে কবির পূর্বপুরুষদের কবর একের পর এক। এখানে আসলাম, অথচ কারো সঙ্গে দেখা হলো না, ব্যাপারটা কেমন হয়। এরূপ ভাবতে ভাবতে দেখলাম ছোট্ট একটা ফুটফুটে বাচ্চাসমেত একজন মহিলা বহিরাঙ্গিনায় আসছেন। সালাম দিয়ে বললাম, ‘এটাইতো সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের বাড়ি, তাই না? তিনি হঁ্যাসূচক জবাব দিলে সবিনয়ে তার নাম পরিচয় জানতে চাই। তিনি জানান, তার নাম তানজিদা। ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়ুয়া তানজিদা সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের চাচাতো, ভাস্তি। এর বেশি আর কোনো কথা হয়নি। পরে আমরা দু’জনে কবর জিয়ারত করে সেখান থেকে বিদায় নিলাম। এখানে বলে রাখা ভালো যে, সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের সমাধিস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, যে প্রতিষ্ঠানের তিনি ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন। আমরা যখন ফিরছিলাম তখন আমার মনের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা হাহাকার করছিল। আমি কেবলই ভাবছিলাম কোথায় এক নিভৃত আলোকদিয়া আর কোথায় সৈয়দ আলী আহসান! এ তো ছোট্ট আলোকদিয়া কিভাবে এত বৃহৎ মহীরুহের জন্ম দিলো!


আরো সংবাদ



premium cement
এনসিটিবি ভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে হামলা সংস্কার প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নির্বাচন : প্রধান উপদেষ্টা কে হবে মিয়ানমারের আগামীর নীতিনির্ধারক ফ্যাসিবাদীরা বিদেশে অর্থ পাচার করে অর্থনীতি ধ্বংস করেছে : সেলিমা রহমান নোবিপ্রবির সাথে চীনের শিহেজী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর মতিউরের স্ত্রী কানিজ কারাগারে, রিমান্ড শুনানি ১৯ জানুয়ারি মহেশখালীতে প্রেমঘটিত দ্বন্দ্বে যুবক খুন নাটোরে অগ্নিসংযোগের মামলায় দুলুসহ ৯৪ খালাস ক্রিড়া মন্ত্রণালয় ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়া উচিৎ : নূরুল ইসলাম বুলবুল ব্রাজিলের বাংলাদেশ দূতাবাসে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রমের উদ্বোধন চট্টগ্রাম বিএনপি নেতা শামীমকে শোকজ, সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না দিলে শাস্তি

সকল