কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মিলন ও সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা শিরাজী
- আবু হেনা আবদুল আউয়াল
- ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
তৎকালীন বঙ্গীয় রাজনীতিতে মুসলিম পুনর্জাগরণ ও ইসলামের অন্যতম খাদেম কবি সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা শিরাজী। পিতা ‘অনল প্রবাহ’ খ্যাত কবি ও মডার্ন মুসলিম নেতা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। পিতার নেতৃত্বগুণ, বাগ্মিতা ও কাব্য প্রতিভার উত্তরাধিকার নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সিরাজগঞ্জে পিতার প্রতিষ্ঠিত ‘বাণীকুঞ্জে’ ১৯০৯ সালের ১৫ মার্চ তার জন্ম। মাতা বেগম ওয়াজেদুন্নেসা। মাতা-পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি।
বাল্যকাল সিরাজগঞ্জে কাটিয়ে কিশোরউত্তীর্ণ যুবক আসাদ উদ্দৌলা শিরাজী আধুনিক শিক্ষা লাভের জন্য কলকাতায় যান। কিন্তু সেখানে ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়ায় লেখাপড়ায় আর অগ্রসর হতে পারেননি তিনি। ১৯২৭ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস উপলক্ষে কলকাতার হাইড পার্কে আয়োজিত জনসভায় ব্রিটিশবিরোধী জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়ার অভিযোগে ১৮ বছরের সদ্য যুবক আসাদকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দী রাখা হয় দীর্ঘদিন। ১৯৩০ সালে ছাড়া পেয়ে তিনি পিতার মতোই রাজনৈতিক ময়দানে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং আমৃত্যু সংগ্রামী রাজনীতি ও ইসলাম প্রচারে আত্মনিবেদিত ছিলেন। সংগ্রামী জীবনে তিনি ১৩ বার কারাবরণ করেন, তবু আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।
বস্তুত পিতার মৃত্যুর পর (১৯৩১) তিনি পিতার শূন্যস্থান পূরণ করেন। পিতার মতোই রাজনীতি ও লেখালেখি অব্যাহত রাখেন।
মুসলমানদের কুসংস্কার দূর করে শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে আধুনিকমুখী করার লক্ষ্য নিয়ে সমমনাদের নিয়ে গড়ে তোলেন বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মিলন। এর সভাপতি হন তিনি নিজে এবং সম্পাদক করেন কর্মবীর এম সেরাজুল হককে। তারা মুসলিম তরুণদের জাগরণ প্রয়াসী। তাই তারা কবি কাজী নজরুল ইসলামকে অনুষ্ঠানের সভাপতি ও অন্যান্য দেশনেতাকে আমন্ত্রিত অতিথি করে সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ কনফারেন্সের আয়োজন করেন। আয়োজনে আসাদ উদ্দৌলা শিরাজীকে সভাপতি ও সেরাজুল হককে সম্পাদক করে একটি শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও গঠন করা হয়, যার কমান্ডার হলেন আজিজুল ইসলাম চৌধুরী ও ডেপুটি কমান্ডার স্থানীয় বিএল স্কুলের ছাত্র ইজাব উদ্দীন আহমদ।
যথাসময়ে নজরুলকে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করার অনুরোধ জানিয়ে সেরাজুল হক নজরুলকে পত্র লিখেন। নজরুল দাওয়াত কবুল করলে আসাদ উদ্দৌলা শিরাজী কলকাতায় গিয়ে নজরুল ও অন্যান্য দাওয়াতিদের সাথে সাক্ষাৎ করে দিন-তারিখ ঠিক করেন। দাওয়াত কবুল করে নজরুল ২.১১.৩২ তারিখে সেরাজুল হককে লেখেন, ‘[...] আপনাদের নেতা আসাদ উদ্দৌলা শিরাজীর মাধ্যমে আপনাদের সাদর আমন্ত্রণ পেলাম। যে সময় সারা বাংলাদেশ আমার বিরুদ্ধে, সেই সময় এই বিদ্রোহীকে আপনারা তরুণদের পথ প্রদর্শনের জন্য ডেকেছেন, ধন্য আপনাদের সাহস!’
বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মিলন উপলক্ষে আসাদ উদ্দৌলা ও সিরাজুল হক মিলে একটি ইশতেহার তৈরি করেন এবং তা সিরাজুল হক কর্তৃক প্রকাশিত-প্রচারিত। এ প্রচারপত্রে তরুণ সম্মিলনীর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কবি নজরুলসহ দেশবরেণ্য নেতাদের আমন্ত্রণ, মুসলমানদের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে, ‘সকল জাতির ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছে কিন্তু বাংলার মুসলমান আজও নিদ্রিত। মাজহাবি বিবাদ, আশরাফ-আতরাফের প্রভেদ, ইংরেজি শিক্ষিত ও আলেমদের মধ্যে অনৈক্য, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কৃষি-শিল্পে পশ্চাৎপদ, অর্থ-সামর্থ্যে অনুন্নত, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও শক্তিহীনতায় বিরাট মুসলমান সমাজ মহা-মরণের পথে ছুটিয়াছে। এই মরণমুখী জাতিকে জ্বলন্ত, জীবন্ত ও গৌরবান্বিত করিয়া বাঁচাইয়া রাখিতে হইলে চাই শিল্প, স্বাস্থ্য ও শক্তি সংগঠন, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস বিদূরণ এবং সখ্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। তাই আমরা বাংলার কর্মী-যুবক বন্ধুদিগকে একত্র করিয়া জাতির সেবায় নিয়োজিত করিবার জন্য এই মহা সম্মিলনীর আয়োজনে প্রবৃত্ত হইয়াছি। কবিবর কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব সভাপতির আসন গ্রহণ করিবেন। ইহা ছাড়াও আলেমশ্রেষ্ঠ বিখ্যাত দেশনেতা মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খান, মাওলানা ইসলামাবাদী, মাওলানা পীর বাদশা মিঞা, কবি আবদুল কাদির, ব্যারিস্টার এস ওয়াজে আলী, ভূতপূর্ব কমিশনার খান বাহাদুর, মৌ. আবদুল মোমেন, এমএলসি প্রফেসর ছানাউল্লাহ প্রভৃতি নিমন্ত্রিত হইয়াছেন।
আমরা প্রত্যেক মুসলমান ভ্রাতাকে এই কনফারেন্সকে জয়যুক্ত করিতে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহানুভূতির জন্য অনুরোধ করিতেছি। যে কোনো প্রকার সাহায্য সাদরে গৃহীত হইবে। এই মহতী ব্যাপারে কমপক্ষে দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবক মোজাহেদ প্রয়োজন। ভলেন্টিয়ারগণ আহার ও বাসস্থান পাইবেন।’ (দ্র: এম এ হামিদ, টি কে কর্মবীর সেরাজুল হক, ১৯৬৬ : ১২৭)
১৯৩২ সালের মোতাবেক ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ১৯ ও ২০ কার্তিক সিরাজগঞ্জ শহরের যমুনা তীরবর্তী সিনেমা হলে বহু আকাক্সিক্ষত সেই বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অন্যদের মধ্যে শিল্পী আব্বাস উদ্দীনও অংশ নেন। নজরুল দীর্ঘ এক লিখিত ভাষণ দেন, যাতে ভূমিকা অংশ ছাড়াও ‘বার্ধক্য ও যৌবন’, ‘গোঁড়ামি ও কুসংস্কার’, ‘অবরোধ ও স্ত্রী’, ‘সঙ্গীত-শিল্প’ ও ‘শেষ কথা’ শিরোনামে অত্যন্ত সুন্দর, সুশৃঙ্খল, যুক্তিগর্ভ ও আবেগঘন উপস্থাপন ছিল, যা শ্রোতা সাধারণকে আকৃষ্ট করে। (ঐ, ১০৩-১১৭)
এই বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ কনফারেন্সের বেশ ক’বছর পরে- ১৩৪৮ (১৯৪১) সালে সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা শিরাজী ও সেরাজুল হক অনুরূপ উত্তরবঙ্গ মুসলিম কনফারেন্সের উদ্যোগ নিয়ে তাতেও নজরুলকে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করার জন্য পত্রযোগে আমন্ত্রণ জানান। সে পত্রে সে সময়ের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নজরুলকে জাতির পথ-প্রদর্শকরূপে আবির্ভূত হতে আহ্বান জানানো হয়, ‘আপনি লেখনী ও কবিত্বের ভিতর দিয়া যে চিন্তাধারায় জাতিকে মাতোয়ারা করিতেছেন, সকলকে সমপর্যায়ে সে সাম্যমন্ত্রে ও একতাবন্ধনে আবদ্ধ করিতে আপনি যেভাবে অভিযান চালাইতেছেন, তাহাতে জাতি চিন্তাধারার গতি ফিরাইয়া নূতনভাবে চিন্তা করিয়া যাইতেছেন। তাই আজিকার এই রাজনৈতিক বিবর্তন ও পুনর্গঠনের সন্ধিক্ষণে যদি আপনি কর্মক্ষেত্রে নামেন, জাতিকে বলিষ্ঠ ও মুক্ত করিতে সত্যই ইচ্ছা পোষণ করেন- তাহা হইলে স্বার্থ-শিকারীদের শয়তানি-দুর্গ চুরমার হইয়া যাইবে। জাতি চায়-আজ সত্যকার নেতা- সত্যকার পথ প্রদর্শক। আশা করি আপনি আমাদের কনফারেন্সের সভাপতিত্ব করিবার এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া বাধিত ও উৎসাহিত করিবেন।’ (ঐ, ১১৯)
নজরুল সে সময়ে সাহিত্য ও রাজনীতির চেয়ে অনেকটা সঙ্গীতের সাধনায় নিয়োজিত। ওই পত্রের উত্তরে তিনি নিজের অপারগতার কথা উল্লেখ করে লেখেন, ‘পেটের দায়ে আমার কণ্ঠ হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ওই ট্রেড মার্কের শিকলের সহিত সংলগ্ন, আমার কণ্ঠে মহাবাণী উচ্চারিত হইবে কি করিয়া? আমাকে সভাপতিত্ব করিবার জন্য যে অনুরোধ করিয়াছেন আমি যদি যোগ্য হইতাম, নিশ্চয়ই এ আহ্বান মাথানত করিয়া স্বীকার করিতাম।’ (ঐ, ১২০) উপরন্তু ওই পত্রোত্তরে তিনি সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা শিরাজীর নেতৃত্বগুণের ভূয়সী প্রশংসা করেন। জাতির জন্য তার ত্যাগ, সংগ্রামশীলতা, বাগ্মিতা ও পাণ্ডিত্যের প্রসঙ্গ অসাধারণ বাকচাতুর্যে তুলে ধরেন নজরুল। তিনি লেখেন, ‘আমাদের জাতীয় দুর্গতির নিরন্ধ্র অন্ধকারে নূরের আলো-নূরের মশাল শিরাজীর হাতে। আমাদের তথা মুসলিম সমাজের কর্তব্য- প্রতিভার এই নরচন্দ্রকে কেন্দ্র করিয়া সংঘবদ্ধ হওয়া।’ (ঐ, ১২১)
শিরাজীর নেতৃত্বে আস্থা স্থাপন করে নজরুল আরো লিখেছেন, ‘আধ্যাত্মিক জগতের যে অপূর্ব ব্যাপার আমি সত্য সত্যই প্রত্যক্ষ করিয়াছি তাতে বাংলা-আসামের তরুণ মোজাহেদদের এমামতি করিবার, নেতা হইবার, নিশান উড়াইবার একমাত্র অধিকারী শ্রীমান সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা শিরাজী। আমার ধ্যানজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রই সে শুধু নয়- সে আমার এমাম-নকিব। আপনারা জানেন না, কিন্তু আমি জানি, শিরাজী কত বড় শক্তির অধিকারী।’
নজরুলের পর্যবেক্ষণ ভুল ছিল না। সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা শিরাজী পিতার মতোই আদর্শে অটুট, সংগ্রামে আপসহীন ও অসাধারণ নেতৃত্বগুণে যথার্থ দেশনেতা হয়ে ওঠেন। চল্লিশের দশকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একজন অনন্য সিপাহসালার তিনি। সিরাজগঞ্জের বাইরেও তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একজন সিপাহসালার হয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালান এবং নিজে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হন। দেশভাগের সময় সিলেটকে পূর্বপাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে গণভোট উপলক্ষে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ১৯৪২ সালে সিরাজগঞ্জে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উল্লেখ্য, সে সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি জনউদ্দীপনাধর্মী অনেক কবিতা, গান ও প্রবন্ধ রচনা করেন। প্রাপ্ত তথ্য থেকে তার গ্রন্থগুলো হচ্ছে : ‘ঝড়ের পাখি’ (কবিতা ও গান), ‘তূর্যনাদ’ (কবিতা) (১৯৫৮), ‘নজরানা’ (গান-গজল) (১৯৬০), ‘কিশতি’ (গান-গজল) (১৯৫৬) ‘বাজিছে দামামা’ (কবিতা ও গান), ‘আমাদের তপস্যা’ (প্রবন্ধ), ‘বিপ্লবী তরুণ’ ও ‘আসাম ডাকিতেছে’ নামক গ্রন্থ দু’টি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। এ ছাড়াও ‘নয়া জামানা’ নামে একটি মাসিকপত্র সম্পাদনা করেন।
দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা