০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১, ৬ রজব ১৪৪৬
`

কবি ও কবিতার আলাপ

-


দু’টি বর্ণে কবি শব্দটি গঠিত হয়েছে এবং তিনটি বর্ণে গঠিত হয়েছে কবিতা শব্দটি। ‘কবি’ ও ‘কবিতা’ শব্দ দু’টি উচ্চারণে সহজ মনে হলেও বোধগম্যতায় রয়েছে ব্যাপক গভীরতা। একজন কবি তার কবিতায় সময়কে ধারণ করে মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকেন। কবি তার কবিতার মাধ্যমে চৎবফরপঃরড়হ জানিয়ে দিতে সক্ষম হন। এক শ’, দেড় শ’ কিংবা দুই শ’ বছর পরে হলেও তার চৎড়ঢ়যবপু মিলে যায়। শব্দ দুটোর গভীরতার এ এক অনন্য কারণ। শিল্পমান বজায় রেখে মানুষের আবেগ অনুভূতি প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো কবিতা। মানুষের হৃদয়-কথা, ভালো লাগার কথা, মন্দ লাগার কথা, প্রতিরোধ কিংবা প্রতিবোধের কথা সবসময় প্রত্যক্ষভাবে বলার ফুরসত হয় না। অথচ অনায়াসে এসব কথা কবিতায় বলা যায়। কবি তার কবিতার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে একজন বীরের মতো রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে পারেন। ঘুমন্ত জাতিকে জাগাতে পারেন। আলস্যে ভরা দেহকে টেনে তুলতে পারেন অনেক উচ্চতায়। স্বপ্নহীন মানুষকে দেখাতে পারেন সীমাহীন স্বপ্ন।
বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা কবিতা লিখতে আসে। কারো কবিতা হয় কারো কবিতা হয় না। কবিতা না হলে অনায়াসে পণ্ডশ্রম হয়। দীর্ঘ দিন পরে ব্যর্থ শ্রমের দরুন অনুতপ্ত হতে হয়। কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে যায়। দুমড়ে-মুচড়ে যায় কবি হওয়ার স্বপ্ন। কবিতা লিখতে আসা অনেকেই নিয়ম মানতে নারাজ। কবিতায় নিয়মপ্রয়োগ নিয়ে অনেককে হাস্যরস করতে দেখা যায়। আবোলতাবোল লিখে কবিতা হিসেবে চালিয়ে দিতে চায়। বোঝাতে চায় তারা নতুন ধারার কবিতা লেখার প্রয়াস চালাচ্ছে এবং কবিতায় আধুনিকতা টিকিয়ে রাখছে। প্রকৃতপক্ষে কতিপয় অসংলগ্ন উক্তির মাধ্যমে কবিতায় আধুনিকতা ধরে রাখা যায় না এবং কবি হিসেবে সাহিত্যাঙ্গনে নিজেকে টিকিয়ে রাখা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
নিয়মহীন কবিতা কখনো আধুনিক নয়। নিয়মহীন কবিতার কবিও আধুনিক নয়। প্রাচীন যুগের চর্যাপদের কবিরা সে সময়ে আধুনিক ছিল। মধ্যযুগের কবিরা তাদের সময়ে আধুনিক ছিল। যেকোনো কবি তার নিজস্ব সময়ে আধুনিক। তবে কবিতা-কানুন অস্বীকার করে কেউ আধুনিক কবি হতে পারে না। আর উত্তরাধুনিক কবি হওয়া তো দূরের কথা।
একজন কবি জাতিকে পথ দেখান। সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন, যার কবিতায় মিলে যায় ভবিষ্যৎবাণী। তিনি কবিতা লিখতে গিয়ে যদি অকবিতা লেখেন তবে এটা হবে হাস্যকর। খাঁটি কবিদের কবিতার প্রথম দু’চার পঙ্ক্তি পড়লেই খাঁটি কবিতা শনাক্ত করা যায়। আর কৃত্রিম কবিদের অকবিতার প্রথম পঙ্ক্তি পড়লেই অনায়াসে অকবিতা চিনতে পারা যায়। কবিতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি কবিতার প্রথম দু’চার পঙ্ক্তি পড়ে নেয়া যাক। যেসব পঙ্ক্তিজুড়ে রয়েছে কবিতার বিভিন্ন অনুষঙ্গ।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের প্রথম শক্তিশালী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতায় লিখেছেন-

রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাধ,
ঘটে যদি পরমাদ,
মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।
উপরোক্ত চারটি পঙ্ক্তি দিয়ে কবি তার ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতাটি শুরু করেছেন। তিনি পঙ্ক্তিগুলো সাজিয়েছেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। প্রথম ও চতুর্থ পঙ্ক্তি লিখেছেন ৮+৮ এর চালে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঙ্ক্তি সাজিয়েছেন শুধু ৮-এর চালে।
পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের অন্যতম প্রধান কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘মানুষ’ কবিতায় বলেছেন-
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
পড়ামাত্রই উপলব্ধি করা যায়- পঙ্ক্তিগুলো মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আরোগ্য-১০’ কবিতাটি লিখেছেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। কবিতাটির প্রথম কয়েক পঙ্ক্তি পড়ে নেয়া যাক-
অলস সময়-ধারা বেয়ে
মন চলে শূন্য-পানে চেয়ে।
সে মহাশূন্যের পথে ছায়া-আঁকা ছবি পড়ে চোখে।
কত কাল দলে দলে গেছে কত লোকে
সুদীর্ঘ অতীতে
জয়োদ্ধত প্রবল গতিতে।
ছয়টি পঙ্ক্তিই অন্ত্যানুপ্রাসে সাজানো হয়েছে। যার দরুন প্রতিটি পঙ্ক্তির শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
কবি জীবনানন্দ দাশের অধিকাংশ কবিতায় বিভিন্ন ধরনের ওসধমবৎু খুঁজে পাওয়া যায়। কবির ভাষায়-
এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে শান্তি আসে মানুষের মনে;
এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে;
জামের আড়ালে সেই বউ কথা কওটিরে যদি ফেল দেখে
একবার-একবার দু’প্রহর অপরাহ্নে যদি এই ঘুঘুর গুঞ্জনে
ধরা দাও- তাহলে অনন্তকাল থাকিতে যে হবে এই বনে;
-এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে
প্রথম পঙ্ক্তিতে ‘ঘুঘুর ডাক’ এবং চতুর্থ পঙ্ক্তিতে ‘ঘুঘুর গুঞ্জন’ অঁফরঃড়ৎু রসধমবৎু হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে ‘সবুজ শাখা’, ‘হলুদ পাখি’, তৃতীয় পঙ্ক্তিতে ‘জামের আড়ালে’, ‘বউ কথা কও’ এবং পঞ্চম পঙ্ক্তিতে ‘বনে’ শব্দগুলোর মাধ্যমে কবি ঠরংঁধষ রসধমবৎু ব্যবহার করেছেন।
গদ্য কবিতার সুষমা গঠনে দক্ষ কবি শামসুর রাহমানের ‘হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল’ কবিতার প্রথম কয়েক পঙ্ক্তি পড়ে নেয়া যাক-
হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল হয়ে কেঁদেছে ক’দিন তার
খবর রাখেনি কেউ। শূন্যতায় বেড়িয়েছি ভেসে,
যেন আমি কাটা ঘুড়ি, অনেক কষ্টেও মৃদু হেসে
সহজে নিয়েছি মেনে সামাজিকতার অত্যাচার।

প্রথম পঙ্ক্তিতে কবি সংশয়মূলক ‘যেন’ শব্দটি উহ্য রেখে প্রতীয়মান উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করেছেন। এখানে হৃদয়কে নিঃসঙ্গ চিলের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আবার তৃতীয় পঙ্ক্তিতে সংশয়মূলক ‘যেন’ শব্দটি উল্লেখ করে এবং ‘আমি’ শব্দটিকে কাটা ঘুড়ির সাথে তুলনা কোরে কবি বাচ্যোৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করেছেন।
কবি আবুল হাসান লিখেছেন-
চিকন কঞ্চির মতো ছিপছিপে রোদের ভিতরে আসি
কে আমাকে নুইয়ে দেয় মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!
-বয়ঃসন্ধি
কবি প্রথম পঙ্ক্তিতে দক্ষতার সঙ্গে পূর্ণোপমা প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছেন। এখানে ‘চিকন কঞ্চি’ উপমান, ‘রোদ’ উপমেয়, ‘ছিপছিপে’ সাধারণ ধর্ম, ‘মতো’ সাদৃশ্যবাচক শব্দ।
কবিতার উপাদানের খোঁজে এবার কবি সায়ীদ আবুবকরের ‘তুমুল বৃষ্টির পর রাতে’ কবিতার প্রথম কয়েক পঙ্ক্তি পড়ে নেয়া যেতে পারে-
সাবধানে ফেলো পা, কাদায় ডেবে যেতে পারে,
খেজুরের পায়েসের মতো কি-নরম হয়ে আছে বাংলার মাটি,
খানাখন্দ ভরে আছে বৃষ্টির পানিতে,
আলকাতরার মতো ঘন অন্ধকারে চারদিকে বসেছে শব্দের মেলা,
সায়ীদ আবুবকর দ্বিতীয় এবং চতুর্থ পঙ্ক্তিতে সাধারণত চারটি বিশিষ্ট অঙ্গ ঠিক রেখে পূর্ণোপমার সার্থক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে ‘বাংলার মাটি’ উপমেয়, ‘খেজুরের পায়েস’ উপমান, ‘নরম’ সাধারণ ধর্ম এবং ‘মতো’ তুলনাবাচক শব্দ। চতুর্থ পঙ্ক্তিতেও কবি পূর্ণোপমা প্রয়োগ করেছেন। চতুর্থ পঙ্ক্তিতে ‘অন্ধকার’ উপমেয়, ‘আলকাতরা’ উপমান, ‘ঘন’ সাধারণ ধর্ম এবং ‘মতো’ সাদৃশ্যবাচক শব্দ।
খাঁটি কবিদের কখনো ছন্দ কখনো শব্দালঙ্কার আবার কখনো অর্থালঙ্কার ব্যবহার করতে দেখা যায়। একজন খাঁটি কবি উপাদানহীন কবিতা লিখতে নারাজ। তবে একজন প্রকৃত কবি ছন্দ অলঙ্কার প্রয়োগ না করেও কবিতায় নতুনত্ব আনতে পারেন। হাজার বছরের পুরনো ধ্যানধারণা ভেঙে গড়ে তুলতে পারেন নতুন আইডিয়ার মিনার। এটি তার স্বাধীনতা এবং ব্যতিক্রমী দক্ষতা। কবিতায় নতুনত্ব একধরনের অনুষঙ্গ বলে আমরা মনে করি। একজন কারুশিল্পী যেমন নিত্য ব্যবহৃত জিনিসের শৈল্পিক রূপায়ণ ঘটান, তেমনি একজন জাতকবি নিত্য ব্যবহৃত শব্দের মাধ্যমে কবিতাকে শৈল্পিক রূপ দান করতে সক্ষম হন। কবিতার কারুকাজে নিজেকে নিমগ্ন রাখেন।

 

 

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বৃত্তির তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ সাফা মাধ্যমিক বিদ্যালয় অ্যাডহক কমিটির সভাপতি আল আমিন শান্তিতে ঘুমাতে চাইলে অবৈধ ইসরাইলিদের ফিলিস্তিন ত্যাগ করতে হবে : ইয়েমেন কিশোরগঞ্জে উন্নত পদ্ধতিতে ইট উৎপাদন বিষয়ে মতবিনিময় কুয়কাটায় শুরু হতে যাচ্ছে মাসব্যাপী ‘পর্যটন মেলা’ প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করছে স্ত্রীসহ সাবেক এমপি শিখরের নামে দুদকের দুই মামলা খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রা : ফিরোজার সামনে নেতাকর্মীদের ভিড় সিলেটে তাফসির মাহফিল বৃহস্পতিবার, প্রধান আলোচক মিজানুর রহমান আজহারি রংপুরের পাঁচে পাঁচ, ঢাকার টানা চার হার কুয়েটে ১০৬৫ আসনের বিপরীতে ২৪ হাজার ৫২৭ শিক্ষার্থী

সকল