গ্রামীণ জীবন ও মানবিক মূল্যবোধ
- ফজিলা ফয়েজ
- ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
কবি জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য প্রতিভা। তার সাহিত্যকর্মে গ্রামীণ জীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে নারী প্রেম ও জীবনযাত্রার গভীর সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। জসীমউদ্দীনের আখ্যানমূলক কাব্য চারটি : ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ১৯২৯, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ১৯৩৩, ‘সকিনা’ ১৯৫৯ ও ‘মা যে জননী কান্দে’ ১৯৬৩। সবগুলো গ্রন্থেই নারী জীবনের চিত্র তার কবিতা ও কাহিনীতে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। তার সাহিত্যকর্মে নারীর সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট, আশা-নিরাশার চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
কবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় গ্রামীণ জীবনের চিত্র তুলে ধরা যাক।
জসীমউদ্দীনের কবিতায় নারীর জীবনকে বিভিন্ন দিক থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষত, ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ তার একটি অমর সৃষ্টি। যেখানে গ্রামীণ নারীদের সৌন্দর্য দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-কষ্ট, স্বপ্ন আশা, ত্যাগ ভালোবাসা এবং সামাজিক বাধা-বিপত্তির কথা উঠে এসেছে।
‘দেখেছি এই চাষী মেয়ের সহজ গেঁয়ো রূপ,
তুলসী-ফুলের মঞ্জরী কি দেব-দেউলের ধূপ!’
অথবা,
‘স্বামীর বাড়ীতে একা মেয়ে সাজু কি করে থাকিতে পারে,
তাহার মায়ের নিকটে সকলে আনিয়া রাখিল তারে।
একটি বছর কেটেছে সাজুর একটি যুগের মত,
প্রতিদিন আসি, বুকখানি তার করিয়াছে শুধু ক্ষত ।’
-নকশী কাঁথার মাঠ
এখানে কবি সাজুর বাড়ি থেকে দূরে থাকা একক স্ত্রীর জীবনের একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ চিত্রিত করেছেন। সাজু বাড়ি থেকে দূরে থাকতে পারে এবং একা থাকা সময়ে তার বুকখানি কত হাহাকার করে কবি সেই কষ্টের কথা উপস্থাপন করছেন।
তার মা সবাই তার পাশে রয়েছে, এটি একটি গ্রামীণ সমাজের রীতিনীতি ফুটে উঠেছে, যা একটি মেয়ের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
জসিমউদ্দীনের সাহিত্যকর্মে নারীর সংগ্রাম ও ত্যাগের নানা দিক ফুটে উঠেছে। তার কবিতায় নারীরা কখনো স্বপ্ন দেখে, কখনো আবার জীবনের কঠিন বাস্তবতার সাথে আপস করতে বাধ্য হয়। তবে, সেই সংগ্রামের মাঝেও নারীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং সৎসাহসের চিত্রও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
‘পেটে ভরা সে যে পায় না আহার পরনে ছিন্ন বাস
দারুণ দৈন্য অভাবের মাঝে কাটে তার বারো মাস।’
- বস্তির মেয়ে
ক্ষুধার্ত, দরিদ্র নারীর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, যার পেটে খাবার নেই এবং পরনে ছেঁড়া কাপড়। নারীর প্রতি মমত্ববোধ ও দুরবস্থা দেখে কবিমন ভাবে-
‘বস্তির বোন তোমারে বাঁচাতে পারিব না কোন মতে?’
‘কে পোড়াবে এই অসাম্য ভরা মিথ্যা সমাজ বাঁধ
তারপরে আজ লিখিয়া গেলাম অমর আর্তনাদ।’
- বস্তির মেয়ে
সমাজের অবিচার, অসাম্য এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন কবি। সেই সাথে সমাজের কাছে আর্তনাদ করেন। এই সমাজের অন্ধকার দিকগুলো কবে ভাঙবে, কবে এই সমাজের পরিবর্তন আসবে।
গ্রামীণ নারীর সাবলীলতা, সাদাসিধে এবং শালীনতার সৌন্দর্য বর্ণনা করে লেখেন-
‘হেতেই তারে মানিয়েছে যা তুলনাই নেই তার
যে দেখে সে অমনি বলে দেখে লই আরবার।’
ছিপ ছিপে তার পাতলা গঠন হাত চোখ মুখ কান
হেলছে দুলছে মেলছে গায়ে গয়না শতখান।’
-সোজন বাদিয়ার ঘাট
এখানে কবি নারীর শারীরিক গঠনের অদ্ভুত সুন্দরতার কথা বলেছেন, যার তুলনা কারো সঙ্গে করা সম্ভব নয়। তার সৌন্দর্য এতটাই প্রাকৃতিক এবং নিখুঁত বর্ণনা করছেন, তার হাত, চোখ, মুখ, কান- সব কিছুই যেন এক সুন্দর সঙ্গীতের মতো একে অপরের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। তার গয়না শাড়ির সঙ্গে হেলছে, দুলছে, এটি যেন নারীর জীবনযাপনের আনন্দ এবং সৌন্দর্য প্রকাশ করছে।
‘তাহারে কহিনু, সুন্দর মেয়ে! তোমারে কবিতা করি’
- মাটির কান্না
কবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় সাধারণত নারীর প্রতি অবিচার, নিষ্ঠুরতা এবং সমাজের অমানবিক আচরণের চিত্র তুলে ধরেছেন। নারীর প্রতি দেওয়া কলঙ্ক ও বিভিন্ন সামাজিক অত্যাচার জীবনের অন্ধকার দিকগুলোকে প্রতিফলিত করে।
‘কেউ দিল তারে বিষের ভাণ্ড, কেউবা প্রবঞ্চনা’
‘কেউ দিল ঘৃণা, কলঙ্ক কালি এনে দিল কোন জনা।’
-সকিনা, কাব্যগ্রন্থ, সকিনা
‘বিষের ভাণ্ড’ বলতে কবি এমন কিছু বোঝাচ্ছেন যা নারীর জীবনকে বিষাক্ত বা কঠিন করে তোলে, যেমন সমাজের অসহিষ্ণুতা, অবিচার বা নির্যাতন।
কবি জসীমউদ্দীন বাংলা কবিতায় এক অনন্য ধারার প্রচলন করেছেন। তার কবিজীবনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি গ্রামের জীবন ও সাধারণ মানুষের যাতনা-আনন্দের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ও সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন। তার সাহিত্য গ্রামীণ জীবনের সংগ্রাম, সৌন্দর্য এবং তাদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার।
তিনি এসব অধিকারের বিষয়ে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন, যা আজো প্রাসঙ্গিক। এটি আজো ইতিহাসে এক অমূল্য সংযোজন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা