শিল্পে কল্যাণময় জীবন ছবি
- মতিন বৈরাগী
- ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সাহিত্য যত সুন্দর করে সময়কে ধারণ করে, সৃষ্টি অন্যকোনো শাখায় ততটা স্পষ্টতার ছাপ সুস্পষ্ট হয় না। শিল্প সাহিত্য অতীত ও বর্তমানকে তুলনামূলকভাবে যত সুন্দর করে মানুষের জীবনাচারকে সময়ের ধারায় প্রতিষ্ঠিত রাখে তত নিখর্ঁুত সংবাদ আমরা ইতিহাস থেকেও পাই না। ইতিহাস ঘটনার পরিভ্রমণ, তা মূলত স্মৃতি এবং শ্রুতির। কিন্তু সাহিত্য থেকে আমরা অতীত সময়ের মানুষের সমাজের ক্রিয়াকাণ্ড অর্থনৈতিক ক্রমধারা এবং সমাজের ক্রমপরিবর্তনের রূপটি লাভ করতে পারি- ইতিহাস থেকে তেমন অভিজ্ঞতা নেয়া কঠিন। ইতিহাস কোনো একটি সমাজের বিপ্লব বা গণজাগরণের মূল অংশটিকে সংরক্ষণ করলেও ওই বিপ্লবের অন্তরগুঢ় কারণ ও কাহিনীর প্রেক্ষপটে যে বেদনাশ্রুর ক্রমতার সংবাদ নিকট/কিম্বা দূর অবস্থান পাঠক মননতন্তুতে যে স্বরাঘাত করে তা অনন্য; ঘটনা চক্রে বিপ্লব কিম্বা গণজাগরণ- আবার কোনো বিশ^াস ঘাতকতায় তা প্রতারণার মৌলিক হয়ে ইতিহাসের অংশ হলেও, মানব সংযুক্তি স্বজন হারানোর কান্না অর্থনৈতিক সংঘাত, বিষাদ বাস্তবতার অভিব্যক্তির মূল রূপটি আমরা নিকট সময়ে কিম্বা দূর সময়েও বুঝে নিতে পারি। জানতে পারি এমনকী একাত্ম হতে পারি জেনে/বুঝে নিতে। জেনে নিতে পারি মানুষের জীবন স্ফুর্তির আকাক্সক্ষা। কবিতার জন্য কবির সময়কাল নির্ণয় প্রয়োজন। যাতে কেউ কবিতায় তার শুরুর সময়টা জেনে নিতে পারে [একজন অখ্যাত বা নির্জন কবি বা লেখককে।] পাঠক তার সময়টাকে চিহ্নিত করে সেই সময়ের সমাজ, দর্শন, বিজ্ঞান সমাজচেতনা ও সৃষ্টির বিস্তারের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে সৃষ্টিশীলতার গভীরতম উদ্দেশ্য। কারণ প্রত্যেকটি সৃষ্টিশীল কাজের মাঝে স্রষ্টার উদ্দেশ্যের নিকট ও দূর থাকে। সৃষ্টি থেকেই বুঝে নেয়া যায় তাঁর সময়ে সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতিতে কী রকম জীবনপ্রত্যাশা চিত্র এবং জীবনবিরুদ্ধ আবর্তন বহমান ছিল/আছে। কবি লেখেন তার সময়কালে তার দেখা, তার শেখা, তার অনুধাবন ও স্বপ্ন। আর সে কারণে একজন কবি/লেখক/শিল্পী তার সৃষ্টির প্রেক্ষাপট নিয়ে আজই শুরু করে আজই শেষ করে না তিনি ভাবেন শব্দকে যাচাই বাছাই করে এবং প্রয়োগ করে। আর তাই তাকে কোনো একটা সময়ের স্বপ্নক্রিয়ার অনুবাদক বলে চিহ্নিত করা যায়।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাবনায় যে শব্দাবলী উচ্চারিত তা অধিকাংশই জমিনের নয় যেন আসমানী। রাষ্ট্র দ্বারা নিগৃহীত মানুষের জীবনছবির নন্দনও না। তার নন্দন আর আজকে নন্দনের মধ্যে ফারাক বিস্তর। রবীন্দ্রনাথ শেষকালের চর্চায় মাঠের মানুষের শরীর বৃত্তান্তে কতকটা সুন্দর দেখতে পেলেও তার সারাজীবনের সাধনায় ছিল উপনিষদীয় সত্যের নন্দন, কিন্তু তার কালেই এক তরুণ কবি ‘বিদ্রোহী’ লিখে জানিয়ে দিয়ে গেছেন প্রকৃত নন্দন কী এবং কেমন হবে হওয়া দরকার। শিল্প-সাহিত্য-কাব্যে যে সেই প্রাচীন বোধ থেকে উৎসারিত আজও আলোচিত তা সেই নন্দনের ইতোবৃত্ত মাত্র। ওই নন্দন আজ অনেকটাই অপ্রয়োজনীয়। কবি কাজী নজরুলের সৃষ্টিতে উৎসাহী পাঠক তাকে খুঁজে নিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে কষ্ট-দুঃখ-যন্ত্রণার চিত্র আছে, এমন কী কোথাও কোথাও তা উপড়ে ফেলবার জন্য বিদ্রোহের উচ্চারণ আছে, সে কারণে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের সৃষ্টির নন্দনে বিশাল ফারাক রয়েছে। কবিগুরুর মনভূমিতে উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধতার স্ফূলিঙ্গ নিরাপদ দেয়াশলাইয়ের মতো নিরাপদ থেকেছে প্রায় সর্বত্র পক্ষান্তরে নজরুলের উদ্দাম নন্দনে রয়েছে মানুষ, সাম্প্রদায়িক বেদনার উপশম আকাক্সক্ষা, উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধ উচ্চারণ। অন্য দিকে ঠাকুরের সৃষ্টিতে রয়েছে দফারফার শিল্প, প্রজ্বলনের আকস্মিকতার উচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রিত। তাঁর ‘গীতকাব্য অধিকাংশ মন্ত্র সাহিত্য; আধুনিক যুগের ঋষির দৃষ্ট নব-মন্ত্র-সংহিতা’ [রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা, দেবী প্রসাদ বন্দোপাধ্যায়] আর সেসব মানুষকে যুগযুগ ধরে যে অন্যায় শাসন ও শোষণের গীত শোনায় কি না, একমাত্র মোহমুক্তি না ঘটলে এর সঙ্গারোপ সম্ভব হবে না। সে কারণে তাঁর সৃষ্টির ভেতর আধুনিকতার উত্তরণ ঘটেছে সামন্ত-সমাজের ইতিহাসকে সামনে রেখে; আর এ যুগ আর একজন রবীন্দ্রনাথ তৈরিও করতে পারে না, যেমন পারে না মহাকাব্য সৃষ্টির উপাদান জোগাতে বা তার চাহিদা তৈরি করতে। একালে আর কালিদাস, একিলিস আসবে না কারণ তার চাহিদা নেই। তাই সাহিত্য কর্মও সমাজ চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। আজকের সমাজ ভেতরে বাইরে ভাঙছে, ভাঙনের মুখের এই সমাজে কবি শিল্পীর অন্তর্দর্শনও ভাঙাগড়ায় পড়েছে। দৃকভঙির পরিবর্তনের সংগে সংগে নির্মাণ কলায় এসেছে নতুন। তবে স্মরণে নিতে হবে যে কবি বা শিল্পীর সৃষ্টি কেবল তার মন-আবেগের আহ্লাদ নয়, তার দায় রয়েছে। এই দায় সমাজ রাষ্ট্র এবং মানুষের প্রতি। যে সৃষ্টি জনগণকে হেয় করে, কুসংস্কারে নিমজ্জিত করে, চেতনাকে শানিত না করে নির্জীব করে মানুষকে অধীন হতে শেখায়, তাতে যতই শিল্পানন্দ থাকুক তা অহেতুক এবং জঞ্জাল হিসেবেই মানুষের কাছে বিবেচিত হয়। কবি শিল্পী সাহিত্যিকের দায় খুব সামান্য নয়, বরং একজন রাজনীতিকের চেয়েও অনেক এবং অধিক। তাকে তার মনের সুন্দরটুকু জনগণের জন্য জনগণের প্রয়োজনীয় করে তার বোধগম্যতায় পৌঁছাতে হয়। তবেই সৃষ্টিতে সৃষ্ট হয় সেই নন্দন যার প্রাণ আছে। মনে রাখা প্রয়োজন এরিস্টোটলীয় নন্দন মূলত দাস সমাজের মনোবৃত্তিকেই প্রাধান্য দিয়েছে। আর সেই যাত্রা আজো টিকে আছে কেবল মাত্র মানুষকে তার মানসিক বন্দিত্বকে ভাঙতে পারছে না বলে। ঔপনিবেশিক যুগ শেষ হয়ে চলমান রয়েছে নতুন ঔপনিবেশিক যুগ, আর তার বদল যে আজ জরুরি, জরুরি জুলাই ‘অভ্যুত্থান বসন্তকে’ অনুধাবন করা। নজরুলের সৃষ্টি থেকে আমরা তার রসদ নিতে পারি।
তবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন জনচেতনার স্তরিক আকার আকৃতির প্রতি। যদি সৃষ্টি জটিল আবর্তধারণকারী হয় এবং সমাজচেতনা স্তর থেকে দূরগামী হয় তাহলে মানুষ তা বুঝতে না পারলে তাকে গ্রহণও করবে না। শিল্প সাহিত্য কেবল উপভোগের বিষয় নয় বরং উপলব্ধির বিষয়, যার মধ্যদিয়ে মানুষ নিজেকে জানতে বুঝতে এবং চিনতে পারে, চেতনা বিকাশে মুক্ত করতে পারে আপন দাস্য বৃত্তির বন্দীত্ব।‘মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত, /যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-’ এর শিল্পগুণ নিশ্চয়ই অনেককে আমোদিত করে।
প্রত্যেক দশকের কবিদের সামনে রয়েছে পূর্বজ অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। এখন দেখবার বিষয় হলো তারা কতোটুকু সেই অভিজ্ঞতার আলোকে নতুনকে নির্মাণে যুক্ত করে কাব্য যাত্রায় উৎরে যেতে পারছেন। ‘আসলে প্রতি যুগের প্রধান কবিরা ঐতিহ্যের সংগে মিলিয়ে ছোটো-ঠোঁটে যে সব বদল করে, তাতেই কবিতা নতুন হয়ে ওঠে। তারা মামুলি নিয়মেই লেখে, কিন্তু সেই মামুলিকেই এমন করে ব্যবহার করে যা পুরানো কবিরা করে নি। পুরানোর পুনরাবিস্কার এ মৌলিকতা থাকে এবং একই ছন্দ থেকে দুই কবি দুই রকম অর্থ তৈরি করে । এই সব ছোট ছোট সংকোচন, প্রসারণ,সংকলন বিকলন, পরিশীলন-এ আধুনিক কালের বিভিন্ন যুগচিহ্ন ধরা পড়ে [ বুদ্ধদেব বসু, স্বদেশ সংস্কৃতি]’ বাস্তবে তেমন খানিকটা ঘটলেও মূল পরিবর্তনটা আসে সমাজ বিবর্তনের ধারায় যার সংগে যুক্ত হয় নির্মোহ মানুষের মন। সত্য এই যে তারপরও এর গতি তীরতীব্র বেগা নয়, বরং সবকিছু ভাঙছে আর শ্লথ হচ্ছে এই নিয়মে। আমাদের প্রথম শতকের কবিদের মধ্যে আমরা সেই প্রবণতাগুলো লক্ষ করতে পারি। তবুও এ কথাটি অস্বীকার করা যায়না যে সকল নতুনের মধ্যে রয়েছে পুরানোর অভিজ্ঞতা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা