শেক্সপিয়ারের ডেরায়
- মোয়াজ আফসার
- ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকে দেখা লন্ডনে মাদাম তুশোর মিউজিয়ামে। মোমের এ জাদুঘরে মোমের তৈরি এ পুতুল শেক্সপিয়ারে মন খুব একটা ভরে না। মনের ইচ্ছেগুলো কেমন যেন ডানা মেলে ওড়ে তাঁর ছোঁয়া জড়ানো গন্ধ পেতে। ঠিক করি এক উইকঅ্যান্ডে কবির জন্মস্থান স্ট্রাটফোর্ডে যাওয়ার। স্ট্রাটফোর্ড ওয়ারউইকশায়ারের ছোট্ট এক শহর। রোববার দিন। ঠিক সকাল নয়টায় বন্ধুু রনি ওর লাল রংয়ের হাইব্রিড টয়োটা প্রায়াস নিয়ে হাজির হয় আমার দোয়ারে। স্ট্রাটফোর্ডের উদ্দেশে আমরা গাড়ি ছোটাই। ব্যস্ত নগরী লন্ডন ছেড়ে গাড়ি মোটরওয়েতে উঠলে মিউজিকটা অন করে দিয়ে আমি রিলাক্সড মুডে সিটে হেলান দিয়ে বসি। জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাই। দেখি মাঠের পর মাঠ হলুদ ফুলে ছাওয়া সর্ষে ক্ষেত। তার ওপর খেলা করে ঝাঁকে ঝাঁকে ভ্রমর। দূর থেকে মনে হয় যেন হলুদ জমিনে কালো কারুকাজ করা ইরানি গালিচা। প্রায় দু'ঘণ্টা ড্রাইভে আমরা স্ট্রাটফোর্ড পৌঁছাই। আমাদের গন্তব্য এই শহরেই কবি শেক্সপিয়ারের বাড়ি। শহরে ঢুকার সাথে সাথে উৎসবের একটা আমেজ যেন আমাদের নাইয়ে দেয়। দেশী-বিদেশী প্রচুর লোকের জমজমাট আড্ডা যেন কবির শহরটিকে রাঙ্গিয়ে তুলেছে আলতার শিশি ভাঙা রঙে। লোকগুলো বেশির ভাগই ট্যুরিস্ট। পেছনে ব্যাকপ্যাক ফেলে হাতের ক্যামেরায় ধারণ করছে দৃশ্যের পর দৃশ্য। এদিক ওদিক করছে ছোটাছুটি। যেন প্রত্যেকেই সাথে করে নিয়ে যেতে চায় কবির শহর থেকে কবির পরশ মাখা একখ- স্মারক।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বাবা জন শেক্সপিয়ার আবাস গেড়েছিলেন ‘স্ট্রাটফোর্ড-আপন-আভন’ এর হেনলি স্ট্রিটে। এই ভিটায় জন আর মেরি আর্ডেন দম্পতির আট সন্তানের জন্ম। ১৫৬৪ সালের তেইশ এপ্রিল জন্ম হয় তাদের তৃতীয় সন্তান উইলিয়ামের। উইলিয়ামের বেড়ে ওঠা ওখানেই। বাবা ছিলেন স্ট্রাটফোর্ডের মেয়র।সেই সুবাদে গ্রামার স্কুলে তার পড়ালেখার সুযোগও হয়ে যায়। ১৫৮২ সালে বিয়ে করেন উইলিয়াম। তাঁর বয়স তখন আঠার বছর আর কনে অ্যানি হ্যাথাওয়ের ছাব্বিশ। বাবা মা'র সাথেই একসঙ্গে বসবাস করেন। ওখানে জন্ম হয় তাদের সন্তান সুসান্না হল,জুডিথ কুইনি আর হ্যামনেট শেক্সপিয়ারের। মাত্র এগারো বছর বয়সে হ্যামনেট মারা যান।
জন শেক্সপিয়ার ১৬০১ সালে মারা গেলে পুত্র উইলিয়াম শেক্সপিয়ার হন বাড়ির উত্তরাধিকারী। উইলিয়াম তার বোন জোয়ান হার্টকে মূল বাড়িসংলগ্ন ছোট দুই রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। বাড়ির অবশিষ্ট অংশ ইজারা দেয়া হয়। যেখানে একটি সরাইখানা বা মেডেনহেড গড়ে ওঠে। নাম দেয়া হয় ‘সোয়ান অ্যান্ড মেডেনহেড ইন’। ১৬১৬ সালে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের মৃত্যুকালে তার বড় মেয়ে সুসান্নার কাছে এ সম্পত্তি তিনি রেখে যান। আর সুসান্না যখন মারা যান তিনি একমাত্র সন্তান এলিজাবেথের কাছে তা হস্তান্তর করেন। এলিজাবেথ দু'বার বিয়ে করলেও তার কোন সন্তান ছিল না। ১৬৭০ সালে তিনি যখন মারা যান তখন বাড়িটি জন হার্টের বংশধরদের কাছে চলে যায়। হার্ট পরিবার ১৮০৬ সাল পর্যন্ত সম্পত্তির মালিক ছিলো পরে তা থমাস কোর্টের জিম্মায় চলে যায়। ১৮৪৬ সালে এক কসাই কোর্টের কাছ থেকে তা ক্রয় করে নেন। শেক্সপিয়ারের জন্মভিটা বিক্রির খবরটি চাউর হলে প্রবল জনরোষ ফুঁসে ওঠে। তখোন স্থানীয় উদ্যোগে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের স্মৃতিবিজড়িত ভবনটি অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। শুরু হয় সর্বজনীন প্রচারণা। চার্লস ডিকেন্স সমর্থিত প্রচারণা সফলতাও পায় দ্রুত। ১৮৪৭ সালে ‘শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্প’ তিরিশ হাজার পাউন্ডে এই সম্পত্তি ক্রয় করে। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে শেক্সপিয়ারের জীবনের গল্প জানা যায়। ট্রাষ্টের বিশ্বমানের সংগ্রহে রয়েছে শেক্সপিয়ারের লেখাসমূহ এবং তাকে নিয়ে লেখা অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ ও স্মৃতিচারণ। এই ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে রয়েছে শেক্সপিয়ারের জীবনের প্রত্যক্ষ প্রামাণ্য দলিল।
অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। কমেডি ও ইতিহাসনির্ভর নাটকে তিনি ভুবনবিখ্যাত। পৃথিবীর আশিটি ভাষায় তার লেখা অনূদিত এবং চলচ্চিত্রায়িত হয়। বিচিত্র এক মায়াবী চোখ ছিল তার। প্রকৃতির নানান রুপ-রস-গন্ধ দিয়ে উপভোগ করেছেন প্রকৃতিকে-প্রকৃতির সৃষ্টিকে। আর তার ওপর রঙ মিশিয়ে সমৃদ্ধ করে রেখেছেন বিশ্ব-সাহিত্যকে, যার ধারক-বাহক আমরা, আজকের পৃথিবী। তাকে ইংল্যান্ডের ‘জাতীয় কবি’ এবং ‘বার্ড অব আভন’ নামে অভিহিত করা হয়। একটি কিংবদন্তী শুনা যায়, হরিণ রান্না করার অপরাধে বিচারের হাত থেকে বাঁচতে লন্ডনে পালিয়ে গিয়েছিলেন শেক্সপিয়ার। সম্পূর্ণ অপরিচিত শহরে কাজের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে একসময় পেশাদার রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। নাট্যজগতের সাথে এই প্রত্যক্ষ পরিচয়ই তার অন্তরের সুপ্ত প্রতিভার বীজ ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হতে থাকে। একে একে সৃষ্টি করেন রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, মার্চেন্ট অব ভেনিস, হেনরি ফোর, জুলিয়াস সিজার, ওথেলো, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, কিং লিয়ার,অ্যাজ ইউ লাইক ইট ইত্যাদি।
এই শহরের সবকিছু বদলায়, বদলায়না কেবল শেক্সপিয়ারের আধাপাকা আঁতুড়ঘরটি। শেক্সপিয়ার যে ঘরে জন্মেছিলেন,সেই সাড়ে চারশ বছরের ঐতিহ্য ঘেরা ঘরটি যেমন ছিলো, তেমনটি আছে। দূর থেকে শেক্সপিয়ারের বাড়িটি নজরে আসলে অজান্তেই দেহমনে কেমন যেন একটা পুলক অনুভব করি। টের পাই, হাঁটার স্পিডটা হঠাৎ করেই যেন বেড়ে যায়। অধৈর্য মন চায় কত জলদি ঘরের ভেতর প্রবেশ করি। সাড়ে ৪০০ বছরের আদি ঘর, ঘরতো নয় সাড়ে চারশ বছরের এক ইতিহাস। ঘরের দরজা জানালা ভেতরের সব আসবাবপত্র সবকিছুই সেই সাড়ে চারশত বছর আগের। খুব কৌতূহল উদ্দীপনা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। দোতলায় কাঠের ফ্লোরে পা রাখতেই ম্যাচম্যাচ শব্দে হোঁচট খাই পয়লাই। জায়গায় জায়গায় কাঠ ক্ষয়ে কিছুটা ফাঁকফোকর তৈরি হয়েছে। পা ফেললেই খটখটিয়ে ওঠে নড়বড়ে দাঁতের মতো। খুব আস্তে আস্তে আমরা ভেতরে পা ফেলি। দেয়ালের কাঠের টুকরোগুলো মনে হয় যেন ঝুলে আছে। ভেতরে গাইড পুঁথির মতো করে সব বলে যায়। ভাল করে দেখি কবির খাটটি, যে খাটে কবি ঘুম যেতেন, বসতেন যে চেয়ারে। ঘরের আসবাবগুলো সব মাটির। ক্যান্ডল লাইট স্টেন্ড, থালাবাসন সবই। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ছুঁতে মানা। টেবিলের সাথে পাতা চেয়ার, দোয়াত- কলম টেবিলের উপরে। তার ব্যবহৃত গাউন লটকানো।দেখে মনে হয় এই বুঝি, এখনি কবি এসে দাঁড়াবেন, সম্ভাষণ জানাবেন আগত অতিথিদের।
শেক্সপিয়ারের ঘরটিকে যতœ করে আদি রুপেই রেখেছে ওরা, নতুনের প্রলেপ ওতে মাখায়নি। কিন্তু বুঝা যায় বাড়িটির ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে কত মেহনত তাদের করতে হয়। খরচা করতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। কবির ঘরে দেখা হলো সব। বই দিয়ে সাজানো বেশ ক’টি শোকেসও চোখে পড়ে। বিখ্যাত সব লেখকদের বই। বইগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। হঠাৎ চোখে পড়ে বাংলায় লিখা একটা বই। ঝিম ধরে যায় আমার শরীরে। এইখানে, এই মহাকবির ঘরে আমাদের বর্ণমালা অ আ ক খ গ - ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি আমি। লিখতে বসে আজ কোনোক্রমেই বইটির নাম আমার স্মৃতিতে আসে না। কিন্তু শো'কেসে দেখা সেই স্মৃতিটা মনে হলে আজো আমার আবেগে জোয়ার আসে- মোদের গরব, মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা