একা
- শাওন আসগর
- ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বারবার মুনমুন একা হয়ে যায়। এরকম একা হবার বিষয়ে সে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। একটা মানুষের জীবনে একা হবার ঘটনা হতেই পারে কিন্তু ওর বিষয়টি একটু আলাদা মনে হয়।
মানুষের মুত্যু হবে এটাই নিয়ম তাও সে জানে মানেও স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু আছে যার সাথে মুনমুনের সাক্ষাৎ, তা সে মেনে নিতে পারছে না। যেমন বাবার মৃত্যু : বাবা মারা গেলেন অফিসে নিেেজর চেয়ারে বসেই। এরকম ঘটনার কথা মুনমুন শুনেনি কখনো। শুনেছে কেউ অফিসে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেছে এবং তারপর মারা গেছে। কিন্তু তার বাবার বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন রকম ঘটলো। অফিসের ছুটি হলে পিওন যাবে বাবার অনুমুতি নিতে, তখন গিয়ে দেখে বাবা শেষ।
মুনমুন একা হলো। মায়ের মৃত্যু আরো ভয়ানক। মুনমুন জারিন আর হিমেল তখন মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেছে বাবার দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। গ্রামের বাড়িতে গিয়েই মিলাদের ব্যবস্থা করার প্ল্যান আগে থেকেই। মোবাইলে আত্মীয়স্বজনকে জানানো হয় এবার লোকজনদের দাওয়াত করে এই উপলক্ষে একবেলা ভরপেট খাওয়ানো হবে। সময়মতো বাড়ি গেলো ওরা। সব আয়োজন হলো ঠিকঠাক। বিকেলে লোকজন কমে গেলো বাড়ি থেকে। কয়েকজন উঠোনে বসে বাবাকে নিয়ে কথা বলছে। বাবা খুব ভালো লোক ছিলেন। একজন বলছেন তিনবছর হলো বাবার জমি বর্গা নিয়েছেন কিন্তু টাকা দিয়ে ছাড়ানো হচ্ছে না তবু বাবার কোনো রাগ অভিমান নেই। আহা কতো ভালো মানুষ হলেই এসব রাগারাগিতে যায় না। বাবার প্রশংসা মুনমুনের কানে এলে সে সুখি হয়। নিজের কাছেও বাবার অনেক সম্মান সংরক্ষণ করেছে সে। তো বিকেলে উঠোনে কয়েকজন মিলে কথা বলছেন্ এমন সময় কে যেনো মাকে ডাকলেন। মা নেই আশেপাশে পাশে। মুনমুনেরও ভেতরটা কেঁপে ওঠলো। মাতো অন্য কারো বাড়িতে এই সময় যাবেন না।
মুনমুন নিজেই বের হলো মায়ের খুঁজে। জারিনও মাকে খুঁজতে থাকে। অবশেষে বাড়ির উঠোনের দক্ষিণ পশ্চিম পাশে মেহমানদের জন্যে যে পাকা টয়লেট রয়েছে তার দরোজা লক করা দেখে মুনমুনের সন্দেহ হলো। সে ওখানে গিয়ে লক করেও সাড়া শব্দ না পেয়ে চিৎকার করে ওঠলো। কয়েকজন মিলে দরোজার লক ভেঙ্গে দেখে মা মরে আছেন ওখানে।
মুনমুন একা হলো। বাবা নেই মা নেই। শহরের চারপাশ থেকে বানের জলের মতো দুঃখ ওকে ঘেরাও করে। সংসারের কোনায় কোনায় কঠিন শ্রমের ঘাম না ঝরালে মুনমুনের মনের উঠোনে সিটি করপোরেশনের ডাম্পিং স্টেশনের মতো ঘিনঘিনে ময়লার স্তুপ বসে। ও ক্লান্ত হয়ে একটু জিরোতে বসলেই ভাবে ওর কাঁধে কতো বড় দায়িত্ব দিয়ে তাঁরা চলে গেলেন। সে হাড়ে হাড়ে টের পেলো যখন জারিন আর হিমেলকে নিয়ে জীবন গোছাতে লাগলো গ্রীষ্ম বর্ষায় জীবনের হুটহাট শতো ঝামেলায় যন্ত্রণায়। ওদের পাড়াশোনা করা আর নানুর দেয়া এক টুকরো জমিতে নিজেদের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করা। বাবাতো সারাজীবন সরকারি চাকুরি করেও এই শহরে কিছুই করে গেলেন না। কেবল মৃত্যুর পর কয়েক লাখ টাকা পাওয়া ছাড়া বাবার আর কোনো সম্পদ নেই গ্রামে বা শহরে।
মুনমুন বাবার টাকা অপচয় করলো না। মামাদের ডেকে বাড়ির তৈরির জন্য পরামর্শ করলো। একটা ঠাঁই না হলে কোথায় যাবে এই তিনজন? মামারা খুব সাহায্য করলো বাড়ি গড়তে। এক চিলতে টুকরো জমিতেই পনেরো বাই পয়ত্রিশ ফিটের তিনতলা বিল্ডিং করে দিলেন মামারা। ভেতরে সিঁড়ি করার কারণে আর পথের জন্য একটু অংশ ছাড়ার কারণে তাও কষ্ট করে প্ল্যান করে দাঁড় করানো হলো। এই-ই শান্তি মুনমুনের জন্য। সে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতেই যেতেই জারিন আর হিমেলের পড়াও চলতে লাগলো।
সময় এলো সুসংবাদ দেয়ার জন্যে। জারিনের বিয়ের আলাপ। ছেলে লন্ডন থাকে। জারিনকে তাদেরও পছন্দ আগে থেকেই। কোনো বড় চাওয়া পাওয়া নেই। মুনমুন হ্যা বলে দিলো। জারিনের বিদায়ের দিনে মুনমুনের শহর কাঁদলো। বাইরে লোকদের আনন্দ হলেও তার চোখের পানি যেনো বেয়ে বেয়ে পড়লো বুক পর্যন্ত বাবার কবর হয়ে মায়ের স্মৃতি ঘেরা আঁচল পর্যন্ত। তার বারবার মনে হলো কখন যে সে জারিনের বোন থেকে মা হয়ে গিয়েছিলো। কীভাবে জারিনকে বড় করেছে সেসব স্মৃতির বাক্স খুলে টুকরো টুকরো সুখ দুঃখের কথা তাকে ভাসিয়ে গেলো চোখের জলবন্যায়।
মুনমুন একা হয়ে গেলো আবার। হিমেলও মনমরা হয়ে থাকে। তবে মুনমুনের আদরে শাসনে নিজের রেজাল্ট ভালো করে। কী মনে এলো তার, মুনমুনকে বলতো--আপু আমি বাংলাদেশে পড়বো না আর। দেখো দেশের অবস্থা খুব খারাপ। দলাদলি মারামারি। আর পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ, ঘর থেকে বের হলেই সন্দেহ। আমি কোনো রাজনীতি করি না তবু প্রেসার আমার ওপর। ওদের সাথে যেতে হয়, আড্ডা দিতে না গেলে ভবিষ্যত খাারাপ করে দেবে।
মুনমুনতো জীবনের ঘা টেনে টেনেই অভ্যস্থ। সে জানে হিমেল শুধু নয়, বাংলাদেশের সব শান্তিপ্রিয় মানুষই এখন ইচ্ছে করেই পালাতে চায় দেশ থেকে। অনেকে মরতেও চায় সরকারের আগ্রাসি কর্মে। হত্যা গুম মামলা আর বাক স্বাধীনতা হরণের যে চর্চা তাতে এখানে বেঁচে থাকার চেয়ে মরণও অনেক শ্রেয়।
মুনমুনের কলেজ বন্ধু হাসান কামরুল সেদিন বলছিলো--মুন এখন যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে দেশে। মানুষের নির্যাতনের সব খবর আসছে, আয়না ঘরের খবর, গুম হবার খবর, ছাত্র নির্যাতনের খবর, তাতে আমিও আর ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমিও চলে যাবো মিছিলে, হয়তো গুলি বুকে নিবো, মরবো। চারদিকে এতো অনিয়ম এতো অত্যাচার আর নিতে পারছি না। দেখো মানুষ কীভাবে জেগে ওঠছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এই সরকারকে আর বরদাস্ত করবো না। তোমার সাথে হয়তো আর জীবন গড়া হলো না।
মুনমুনের ভেতরটা ধুক করে ওঠে। ভেতরে হাহাকার ঝড়ের বাতাস বয়ে যায়। এ বাসায় হাসানের প্রায়শ আগমন আর তার আলোচনাকে মুনমুন ভিন্ন এক অবলম্বন ভেবে রাখে। হাসানকে সে জবাব দেয় না। হাসান অনেক বছরের বন্ধু বলে বুঝে ফেলে মুনমুনের মনে কষ্টটুকু। সে নিজেই প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে--আচ্ছা আমি যাবো না। কিন্তু তোমার কী উচিত নয় আমাদের বিয়ের কাজ সেরে ফেলা। ?
মুনমুন ধীরে ধীরে চোখ রাখে হাসানের মুখের ওপর। কথাও বলে--হিমেলকে বাইরে পাঠিয়ে পরে ডিসিশান নেবো। আরো মাস তিনেক ওয়েট করো।
হিমেল চলে যায় দক্ষিণ কোরিয়ার এক ভার্সিটিতে। মুনমুন একা হয়। গ্রীষ্মের অপরাহ্ন অথবা কোনো পাতাঝরা বৃক্ষের মতোই তার ভেতর শুন্যতা ভর করে। ঘরের আসবাবপত্র নীরব হয়। পানির কল থেকে জল পড়ে চোখের কান্নার মতো। পথের কুকুর ডাকে মিহিসুরে মায়াভরা বিরহ কণ্ঠে। মুনমুন একা হয়। ওর একাকিত্বের ভার নেয়ার কেউ নেই যেনো।
হাসানকে বিয়ে করে মুনমুনের জীবন পাল্টে যায়। কিন্তু ভেতরে তুষের আগুনের মতোই জ¦লতে থাকে জারিন আর হিমেলের বিদায় স্মৃতি। তাছাড়া চারদিকে তখন চরম আন্দোলন। ছেলেরা জেগে ওঠেছে কোটা নিয়ে, বৈষম্য নিয়ে। জেলায় জেলায়, পথে পথে ওদের শ্লোগানের নতুন শব্দ। ওদের ভেতর ভয়হীন যাত্রা, ওরা আর পুলিশে ভয় পায় না। বিজিবিকে তোয়াক্কা করে না। ওরা সংগঠিত হয় আর বলতে থাকে--এক দফা।
সাথে রাজনৈতিক দলগুলোও ফুঁসে ওঠে। এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো তারা। যুবকদের অপ্রতিরোধ্য যৌবন শক্তির সাথে নিজেদের সামর্থকে এক করে নেমে আসে পথে।
একদিন, দুপুর। যেদিন মুনমুনকে নিয়ে হাসান যাবে ওদের গাজিপুরের বাসায় বাবাকে দেখতে সেদিনই উত্তরা আজমপুরের কাছে গিয়ে নামলো। অপজিট থেকে, পূর্ব দিক থেকে, পশ্চিম দিকের গলি থেকে, গ্রাম থেকে, উপজেলা থেকে, নদি থেকে, হোটেল থেকে, গ্যারেজ থেকে ছাত্র জনতার মিছিল। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে ব্যর্থ। শব্দ আর ধোঁয়া। পরপর শব্দ গুলির শব্দ। দ্রুত দৌড়াতে লাগলো মুনমুন কিন্তু পেছনে তাকিয়ে দেখে হাসান লুটিয়ে পড়ছে গুলি খেয়ে। মাথায় আর কিছু ঢুকছে না। চারদিকে প্রাণান্তকর ছোটাছুটির ভেতরই মুনমুন হাসানকে জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর, কলজের ঠিক মাঝখানে। চিৎকার করে ওঠে সে, একবার দাঁড়ায়, একবার বলতে চায়--আমাকেও মারো। একা একা থেকে কী লাভ আর।
হাসানের দেহ আনা হয় শনির আখড়ায় নিজের বাড়িতে। ‘মুনমুন লজে’। এমনিতে ছোট্ট বাড়ি তার ওপর সিঁড়ির কাছে হাসানের গোসল কাফনের কাপড় পড়ানো। অবশেষে হাসানের বাবার কাঁধেই ওঠলো হাসানের লাশ পরদিন সকালে।
মুনমুন একা। ওর জীবনের এই একা হবার ঘটনাগুলোর ভার আর সইতে পারছে না সে। সে আর ঘরের বাইরেও যেতে পারছে না। বাইরে যেতে চাইলেই মনে হয় সিঁড়ির পাশে হাসানের লাশ। লাশ ডিঙ্গিয়ে কীভাবে যাবে সে ?
মুনমুন। মুনমুনের ঘরে বাবা নেই, মা নেই, জারিন নেই, হিমেল নেই। হাসানের বিমর্ষ মলিন নিথর দেহ যেনো এখনো সিঁড়ির কাছে। পাগল হয়ে যাবে সে? কোনো কথা নেই তার মুখের গহবরে। ঘরের পোষা বেড়ালটিও চুপ। নিজের পোশাকে, খাবারেও খেয়াল নেই, অফিসের কাজ-তাতেও মন নেই। মুনমুন এখন খুব একা, কেনো? কোনো সঠিক ব্যাখা সে খুঁজে পায় না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা