২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জীবনবাদী কবি মুকুল চৌধুরীর মৃত্যুচিন্তার চিত্রকল্প

-

ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে পাপড়ি প্রকাশনী, সিলেট থেকে বাংলা সাহিত্যের আশির দশকের শক্তিমান কবি মুকুল চৌধুরীর ‘মৃত্যুর চিত্রকল্প’ শিরোনামে একটি মূল্যবান কবিতাগ্রন্থ বেরিয়েছে।
তিন পর্বে বিভক্ত ছয় ফর্মার এই ব্যতিক্রম বইটির প্রথম পর্বে উনিশটি অগ্রন্থিত কবিতা। দ্বিতীয় পর্বে পনেরটি সদ্য রচিত কবিতা। সমাপনী পর্বে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের ছয়জন গুণী কবির ছয়টি চমৎকার মূল্যায়নধর্মী বক্তব্য।
মোট চৌত্রিশটি কবিতার বয়ান একত্র করে বলা যায়- মুকুল চৌধুরীর কাব্যদর্শন বিশ্বাসের শিকড় ও শাখা-প্রশাখাকে আরো শক্তিমন্ত চেতনায় শাণিত করে। পাঠকমাত্র ইহলোকের রংচট সম্পর্কে সচেতন হয়ে পারলৌকিক চিন্তায় ডুব দেবেন।
পুরো গ্রন্থে দেখা যাবে আলোর তৃষ্ণাকাতর একটি অসহায় আত্মার বিলাপ। যেমন- ‘আমাকে সেই আলোর কাছে নিয়ে যাও, যে আলোতে মুছবে/আমার আত্মার সকল আঁধার। (কবিতা- জীবনের ভাগফল)
কবিতা কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে তার কবি- বিষয়ক কবিতায় লিখেছেন : ‘কেননা কবিতা কোনো প্রত্যয়হীন বিষয়ের প্রতিবিম্ব নয়/ কবিতার মধ্যে জ্ঞানের কথা রয়েছে এবং/ নিশ্চয়ই কবিতার এক একটা শব্দ মধুর সমতুল্য/ আর কবিরাই হলেন কালের রাখাল।’
পৃথিবীতে শীত বসন্ত বরাবর থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত নিঃস্ব-রিক্ত মুমিন মুসলমানদের অন্তরের আগুন নিভেনি কোনোদিন। গ্রন্থের প্রথম কবিতায় কবি অনুশোচনার সুরে তাই বলতে চেয়েছেন- ‘তামাম নিঃস্ব রিক্ত পথচলা যাযাবরের মনে আগুন/এ আগুন অনন্ত পিপাসার আগুন।’
বাতিলের ধ্বংসকামী কবি অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত- কবে বিনাশ হবে বাতিলের রাজত্ব? নূরে মোজাসসাম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা: কবিতায় কবির প্রত্যাশাবোধক প্রশ্ন- ‘পথ শেষ কবে হবে-/ নোঙ্গর তুলবে বাতিল বিনাশ?
প্রকৃতপক্ষে মুকুল চৌধুরী মূল ঠিকানার কবি। আমাদের হৃত মুসলিম ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর কবি। যুদ্ধ নয় শান্তির ফায়সালা হোক পৃথিবীতে এই শাণিত চেতনা ও বোধের কবি।
আমাদের জাতিসত্তা বিনির্মাণে তার তুলনা ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের সাথে দেয়া অযৌক্তিক অযাচিত কিছু নয়।
আমরা জানি, জীবন সংক্ষিপ্ত, রিজিক নির্ধারিত আর মৃত্যু অবধারিত। গ্রন্থটির নামকবিতা ‘মৃত্যুর চিত্রকল্প’ কবি আবিদ আজাদকে উৎসর্গ করা হয়েছে। কবিতাটির শেষ চরণত্রয় পাঠককে নতুন উদ্দীপনায় প্রাণিত করবে। হতাশা দূর করে প্রতিটি মানুষকে মৃত্যুর ব্যাপারে আশাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত করবে বলে মনে হয়।
‘মৃত্যু তো এমনই। নির্মমও না, নির্দয়ও না;
সকল অসুখের চির নিরাময়/মৃত্যু এক দূর পথে দীর্ঘ সফরের প্রথম প্রান্তর।’
জীবনের আরেক নাম মৃত্যু। এবং মৃত্যুই জীবনের নিগূঢ় সারাৎসার /যেখানে মৃত্যু নেই, সেখানে জীবনও নেই/এবং জীবনই মৃত্যুর অস্থির ছায়ানীড়।- (কবিতা : বারবার মৃত্যু এসেছিল)
প্রসঙ্গত, হযরত আব্বাস রা: কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ আর্তনাদ করতেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো এর কারণ কী। তিনি বললেন ‘কবর হচ্ছে আখেরাতের প্রথম স্টেশন। এখানে যদি কেউ ছাড়া পেয়ে যায় বাকি ধাপগুলো পাড়ি দেয়া তার জন্যে সহজ হবে। আর এখানে কেউ আটকা পড়লে তার আখেরাত নিশ্চয়ই ভয়াবহ।
মুকুল চৌধুরীর জীবন দেখার চোখ অত্যন্ত ব্যতিক্রমভাবে গভীর। তিনি মৃত্যুকে দেখছেন পৃথিবীর বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে। আমার পৃথিবী কবিতায় এর উল্লেখ- ‘অতএব মুক্তি চাই। আমি মুক্তি চাই
জীবন অস্পষ্ট শব্দ, মুক্তিতে স্পষ্টতা দেখি।’
বাংলা কবিতায় মুকুল চৌধুরীর অন্যরকম গ্রহণযোগ্যতা তার সার্থক উপমা প্রয়োগের মুন্সিয়ানার মধ্যে নিহিত। তার উপমাগুলো কোনো রূপসী কবিতাকনের অবয়বে দুধে আলতার মতো। যেমন- কুয়াশা মোড়ানো অন্ধকার এক ধেয়ে আসছে মাঝে মাঝে/আমার পৃথিবীর দিকে। কার্তিকের সন্ধ্যার ফিনফিনে।/
কখনও বা মাকড়সার জালের মতো অস্বচ্ছ পাতা ফাঁদ। (কবিতা-আমার পৃথিবী)
পিঁপড়ার মতো কবিতাও নেমে আসবে শব্দের পিঠে সওয়ার হয়ে- (কবিতা : এক আশ্চর্য ভোরে)
বেশ কয়েকটি নিবেদিত কবিতা গ্রন্থটির সৃজনস্বাস্থ্যকে করেছে আরো মোহনীয়। পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। বিশেষ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীকে নিবেদিত ‘জেনারেল’ কবিতাটি। ‘ফররুখ আহমদ’ শিরোনামে কবি ফররুখ আহমদকে নিয়ে লিখেছেন : ‘তামাম দিনের শেষে সকালের সূর্য ওঠা ভোরে/লবিদের মতো তুমি এনে দিলে বিজয় খবর/ মানুষের রক্তে বহে যে রকম সবুজ বিনয়।’
১৯৮২ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের স্যার এফ. রহমান হলের সামনে গ্রেনেড বিস্ফোরণে দেশের দুই কীর্তিমান শিল্পীর মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে রচিত ‘ত্যাগ’ কবিতার বক্তব্য আমাদেরকে বিগত জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ছাত্র-জনতার সর্বোচ্চ ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কবির অনুপম বক্তব্য : ‘আর এরকম অলোক-সুন্দর দৃশ্য
ও অনুপম ত্যাগ/বহুদিন একদল বিশ্বাসী মানুষকে অন্তর্ভেদী সাহস যোগায়/ আর এ রকম
ত্যাগই হচ্ছে অগ্নিময় বিশ্বাসের জীবন্ত দৃষ্টান্ত।’
উৎসর্গ কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত মুকুল চৌধুরীর ইরানের ইসলামী বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা ইমাম আয়াতুল্লাহ রূহুল্লøাহ খোমেনিকে নিবেদন করে : ‘অভিযাত্রী পুরুষ’ কবিতাটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কবিতাটির শেষ চরণযুগল :
‘উজ্জ্বল উদ্যানে তুমি এশিয়ার অবাক বিস্ময়
মানুষের মুক্তিদণ্ড হাতে যেন আরেক তারেক।’
আদর্শ ও স্বাধীনতাপ্রিয় এই কবি তার দুটো ছোট ছোট কবিতায় তার বক্তব্য স্পষ্ট করেছেন:
আদর্শ ও প্রকৃত স্বাধীনতা বিবর্জিত সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে কবির অনুশোচনা: আদর্শ এখন অমরার দীপ্তি নয়/ বরং এক জ্বলিত কয়েদখানা / আদর্শ এখন বুলেট, পরীক্ষার স্পষ্ট যন্ত্রণা।
স্বাধীনতা অর্থ বিশ্বাসের অবিনাশে নতুন স্লোগান/.../ স্বাধীনতা অর্থ শহীদের লাশ নাগরিকের শিরোস্ত্রাণ।
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আক্রান্ত পৃথিবীতে বসবাসরত কবির একটি ব্যতিক্রম উজ্জ্বল কবিতা পুঁজির দহন। পাঠকৃন্দ কবিতাটি পাঠে নবশিহরণে পুলকিত হবেন।
নর-নারীর চিরায়ত প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কবিতা মুুকুল চৌধুরীর আরকটি প্রিয় বিষয়। ‘প্রতিবিম্ব’ কবিতাটি আত্মস্থ করে পাঠককুল নিশ্চয়ই অনেক রসদ পাবেন।
সিলেটের বিশিষ্ট কবি, শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহমদকে নিবেদিত এই বইটি দেশের প্রতিটি সমঝদার পাঠকের পাঠ করা উচিত বলে মনে করি।
প্রকাশক কামরুল আলম ও তার সযতেœ গড়া প্রকাশনা সংস্থা পাপড়িকে মোবারকবাদ। এত নিপুণতার সাথে নিখুঁভাবে বইটি প্রকাশের জন্য। কবি ও প্রচ্ছদশিল্পী নাইমুল ইসলাম গুলজার চমৎকার প্রচ্ছদ অঙ্কন করে বইটির বহিরঙরূপ অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছেন। আজকালকার বাজারমূল্যের সাথে মিল রেখে বইটির বিনিময় মূল্য বেশ যৌক্তিক বলে মনে হয়। আমি বইটির ব্যাপক পাঠ ও প্রচার কামনা করি।
মুকুল চৌধুরীর প্রতিটি কবিতা দীর্ঘ গবেষণা ও তীক্ষè নিরীক্ষার ফসল। ‘মৃত্যুর চিত্রকল্প’ নামক ব্যতিক্রম কবিতাগ্রন্থটি যুগ যুগ ধরে বাংলা সাহিত্যে টিকে থাকবে। কামনা করছি বাংলা সাহিত্যের অনন্য কাব্য প্রতিভা ইসলামী দর্শন ও ঐতিহ্যপ্রেমিক মুকুল চৌধুরীর সুস্থ সুন্দর দীর্ঘ জীবন।


আরো সংবাদ



premium cement