২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

স্বপ্নের হাতছানি

-

এখনকার মতো তখনো জীবনটা দুর্বিষহ ছিল। জীবনের প্রতিটি উপসর্গ দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। কষ্ট-ক্লেশ, বিরহ-বেদনা, যাতনা-যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিল। কিন্তু জীবনের এই দুর্বিষহতার আঁধারেও এক পশলা আলো ছিল। আলোর স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নের আলো ছিল। বেবাক ব্যথা-বেদনা, যাতনা ও যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করেই আমি তখন স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্নসায়রে ডুব দিতাম। স্বপ্নসরোবরে সন্তরণ করতাম।
আমি স্বপ্ন দেখতাম, স্বপ্নরা আমায় দেখত। আমি স্বপ্নকে আশ্রয় দিতাম, স্বপ্নরা আমায় প্রশ্রয় দিত।
আমি স্বপ্নদের হাতছানি দিতাম, স্বপ্নরা আমায় হাতছানি দিত। কখনো এই স্বপ্ন, কখনো ওই স্বপ্ন। কত কত স্বপ্ন। বিভিন্ন ধরনের, হরেক রকমের। ছোট স্বপ্ন। বড় স্বপ্ন। রাঙা স্বপ্ন। রঙিন স্বপ্ন। সবুজ স্বপ্ন। সোনালি স্বপ্ন। দিবাস্বপ্ন। নিশিস্বপ্ন। কান্না ও হাসির স্বপ্ন। ভালোলাগা ও ভালোবাসার স্বপ্ন।
স্বপ্নরা আমার ছিল, আমি স্বপ্নদের ছিলাম। স্বপ্নরা আমায় সঙ্গ দিত, সান্ত¡না শোনাত। আমিও স্বপ্নদের সঙ্গ নিতাম, সঙ্গী হতাম। আমি স্বপ্নদের স্পর্শ করতাম, ওরা আমায় ছুঁয়ে দিত। ওরা থাকত আমার অন্তরে, আমি থাকতাম ওদের অভ্যন্তরে।
এভাবেই আমি স্বপ্নদের সঙ্গে হৃদ্যতা করলাম, স্বপ্নরা আমার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা করল। কিন্তু এই হৃদ্যতা ও অন্তরঙ্গতা আমার দুর্বিষহ জীবন বরণ করতে পারল না। আমার কপালের লিখনও খণ্ডন করতে পারল না। তাই আমার সুন্দর সুন্দর স্বপ্নগুলো শুধু ‘স্বপ্ন’ই ছিল! ডানাভাঙা ছিল! তবুও আমি স্বপ্ন দেখতাম। আমি স্বপ্ন দেখতাম কোনো সবুজ দ্বীপের, সোনালি মাঠের। যেখানে জীবনের স্নিগ্ধতা আছে, যৌবনের পূর্ণতা আছে।
কিন্তু জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রত্যেকটি পাদবিক্ষেপে আমার রাঙা স্বপ্নগুলো ভাঙা শুরু করল। আমার সামনে। আমার আড়ালে। আমার জ্ঞাতে। আমার অজ্ঞাতে। আহ! এত আদর, কত বাৎসল্যে স্বপ্নগুলোকে লালন করতাম।
স্বপ্নগুলোও আমায় কত ভালোবাসত। তবুও জীবনের নির্মমতা এবং নির্মমতার জীবনের কাছে আমার স্বপ্নগুলো হার মানতে বাধ্য হলো।
তাই আমার রাঙা স্বপ্নগুলো ক্রমে ক্রমে ভাঙা শুরু করল। আমার সবুজ স্বপ্নগুলো বিচ্ছিরি হতে লাগল। স্বপ্নের আলো, আলোর স্বপ্ন, সবই শুধু স্বপ্নেই থাকল। জীবনটা আগের মতো দুর্বিষহই রইল। ঠিক তখন স্বপ্নগুলো উড়াল দিলো। হয়তো আমায় ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে!
আমি তাদের বাধা দেইনি। আমি তাদের কে? কিংবা কী? আমি তো স্বপ্ন দেখার উপযুক্ত নই। স্বপ্ন আমার অনুকূলে নয়। এভাবেই স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা নিয়ে জীবনপথে বারবার আমি পথ চলি। পাথেয় হিসেবে থাকে স্বপ্নভঙ্গব্যথা!
আমি পথ চলি। চলি তো চলিই। আঁধার পথ। আলোহীন পথ। স্বপ্নহারা পথ। স্বপ্নছাড়া পথ। জীবনের দুঃসহ পথ। দুঃসহ জীবনের পথ।
জীবনের এই মরীচিকাময় পথের হাজারো পথিকের সঙ্গে আমিও যেন হারিয়ে গেলাম বিবর-গহ্বরে!
হঠাৎ স্বপ্নহীনতার নিকষ কালোয় এক পশলা আলো জ্বলে উঠল। আমার সমগ্রসত্তায় যেন অজানা এক শিহরণ খেল। নিজের অজান্তেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলো আবারো আমায় হাতছানি দিলো। আমার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো প্রত্যাবর্তনের জানান দিলো। তবে এখনকার স্বপ্নগুলো আগের চেয়ে উজ্জ্বল, পূর্বের চেয়েও আলো ঝলমল। আমি জানি এটা আমার হেঁয়ালি। এসব স্বপ্ন নয়, মরীচিকা। তাই এই স্বপ্নগুলোও একসময় আমার থেকে বিদায় নেবে। আমায় ছেড়ে চলে যাবে। আমি তখন আবার হারিয়ে যাবো অনিশ্চয়তার অতলে। আমি আবারো ডুবে যাবো স্বপ্নহীনতার সরোবরে। তখন আমার জীবন আবার দুঃসহ হয়ে উঠবে। কিন্তু এই যে জীবনের দুর্বিষহতা, তার মাঝে বারবার স্বপ্নের ঝলমলতা, এসব নিয়েই মানুষের জীবন। এসব নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। কিংবা বেঁচে থাকার ভান ধরে। কারণ এগুলোও যে বেঁচে থাকার উপকরণ। এগুলোও যে বেঁচে থাকার সঞ্চয়ন। তাই তো বারবার স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়েও আমি স্বপ্ন নিয়েই পথ চলি। আমি স্বপ্নদের হাতছানি দেই, স্বপ্নরা আমায় হাতছানি দেয়। এভাবেই চলতে থাকি দিনের পর রাত, রাতের পর দিন। এই পথচলায় ক্লান্তি আছে, শ্রান্তি আছে। কিন্তু বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই।


আরো সংবাদ



premium cement