‘নীলঢেউ কবিতার প্রচ্ছদপটে’ অনন্ত ঘুমে
- চৌধুরী গোলাম মাওলা
- ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
দ্বিধার পাহাড় ডিঙিয়ে ভয়ে সংকোচে তার মুঠোফোনের নাম্বারটিতে আঙুল চেপে দিলাম। রিং হচ্ছিল, এক দুই তিন...
ঠিক চারটি রিং হওয়ার পরই আমি নিজ থেকে কল কেটে দিলাম তার বয়স এবং শারীরিক সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে। ঘড়িতে তখন রাত ১০টা পঁয়ত্রিশ। হয়তো শুয়ে পড়েছেন, ঘুমিয়ে গেছেন। না জানি তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিলাম! কিন্তু তিনি যে তখন জীবনের চূড়ান্ত ঘুমের প্রস্তুতি পর্বে আছেন- তা কি আমি বা আমরা কেউ জানতাম?
‘হায় মৃত্যু!
জন্ম হতেই চির শীতল সঙ্গী,
কাছে থাকে-
নিভৃতে থাকে মিশে দেহের সাথে, ছুঁয়ে দিতে নিথর আক্রোশে!’
চিরায়ত বাংলার এক অনন্য সন্তান অধ্যাপক আবু জাফর। জন্ম তার কুষ্টিয়া জেলার হরিনারায়ণপুরে কালী নদীর পাশে কাঞ্চনপুর গ্রামে। ১৫ মে, ১৯৪২, শুক্রবার।
স্কুলপর্ব শেষে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক, এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ছিলেন বরাবরই মেধাবী। চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে তার অধ্যাপনার শুরু। পরবর্তীতে কুষ্টিয়া কলেজেই অবসরপূর্ব (২০০০) পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন।
সারাটি জীবনই ছিলেন নিরন্তর সৃষ্টিকর্মে অবিরাম যোদ্ধা। উচ্চমানের সংবেদনশীল সৃজনে, মননশীল অপূর্ব সব সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপে, সাহিত্য এবং জীবনমুখী অভিজ্ঞতায় রাঙিয়েছেন জীবনের নানা সোপান।
১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে অপর দুই বন্ধু- সহচর মিলে চলে যান কলকাতায়। রণাঙ্গনের প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা টগবগে এই যুবক লেখেন রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ বই- ‘বংশী তলার যুদ্ধ : আগে ও পরে’।
সাহিত্যের শিক্ষক এবং সংস্কৃতিজন হিসাবে তার সাথে কলকাতা বেতার- ‘আকাশবাণী’-র দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ ব্যক্তির সাথে পূর্ব হতেই ছিল পত্রালাপ। দেবদুলাল তাদের একটি সাক্ষাৎকারও রেকর্ড করিয়েছিলেন ও বুদ্ধদেব বসু এবং প্রতিভা বসু দুজনই বাংলাদেশে তাদের শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন ঢাকায়। তাই স্বাধীনতার বিষয়ে তাদের আগ্রহ-উৎসাহ ছিল সীমাহীন।
‘অসহিষ্ণু মৌলবাদীর অপ্রিয় কথা’ (২০০৫) বইয়ের এক জায়গায় তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বুদ্ধদেব বসুর একটি বক্তব্য তিনি উল্লেখ করেন, ‘কী এমন হলো যে তোমরা হঠাৎ পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চাইছো! তোমাদের কত দিকে কত উন্নতি হচ্ছিল- ভালোই তো ছিলে। আমরাও তো দিল্লির অনেক অন্যায় অবিচারের শিকার, তাই বলে কি আলাদা হয়ে যাবো? এখন হয়তো আর ফেরার পথ নেই কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরা সবাই ভুল করছ। আমি তোমাদের লড়াইকে শ্রদ্ধা করি কিন্তু সমর্থন করি না!
প্রিয় কবির এমন কথায় আবু জাফর এবং তার সঙ্গীরা সেদিন মনঃক্ষুণœ হয়েছিলেন ভীষণভাবে। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে এই গুণীজন অধ্যাপনার পাশাপাশি বরাবরই সাহিত্য -সঙ্গীত রচনা, সুর ও পরিবেশনার নানা কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে রচনা করেন কালজয়ী দেশাত্মবোধক গান- ‘এই পদ্মা এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে’। বিবিসি’র এক জরিপে এই গান সর্বকালের সেরা বিশটি গানের অন্যতম।
প্রাণ ছুঁয়ে যাওয়া চিরায়ত লোকবাংলার গান এটি।
‘এই অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুঁয়ে
নির্ভয়ে নীল আকাশ রয়েছে নূয়ে
এক নীল ঢেউ কবিতার প্রচ্ছদ পটে
আনন্দ বেদনায় মিলন বিরহ সঙ্কটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়,
এ আমার দেশ, এ আমার প্রেম...
কত আনন্দ-বেদনায়,
মিলন-বিরহ সংকটে।’
অধ্যাপক আবু জাফরের নিজ ভাষ্য অনুযায়ী এই গান ১৯৭৩ সালে রচনার পাশাপাশি সুরও তিনিই করেছিলেন। রাজশাহী বেতারে প্রথম তার এবং তার সহধর্মিণী বাংলাদেশের লালনগীতির জননী ফরিদা পারভীনের দ্বৈতকণ্ঠে এ গান রেকর্ড করা হয়। পরবর্তীতে ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে রেডিও বাংলাদেশ ঢাকা কেন্দ্র এবং টেলিভিশন থেকে গানটি প্রচারিত হতে থাকে। ক্রমেই এই গান মানুষের কাছে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল যে, এই গান ছড়িয়ে পড়ে পথে-ঘাটে, সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
যেকোনো জাতীয় দিবসে শহরে বন্দরে,পাড়ায় মহল্লায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে যাইকে এই গান ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতো বাংলাদেশময়। প্রবাসী বাংলা ভাষাভাষীদের কাছেও এই গান ছিল তাদের বুকের ভেতরে লালন করা প্রিয় বাংলাদেশ সমতুল্য।
প্রসঙ্গক্রমে আজ একটি আবেগ মনের ভেতর থেকে গভীরভাবে নাড়া দিচ্ছে আর তা হলো : ১৯৭৭ সালে আমি নোয়াখালী সরকারি কলেজে প্রথমবর্ষের ছাত্র তখন। কলেজের একুশে ফেব্রুয়ারির ফাংশনে আমরা এই দেশাত্মবোধক গানটি পরিবেশন করি। তখনই গানের বাণী প্রথম পর্যবেক্ষণ করি। দোলায়িত হই সুরের দ্যোতনায়। গানের ভেতর হতে উৎসারিত মাটি ও মানুষের তথা দেশপ্রেমের নিবিড় বোধ, ভাবনা এবং আবেগ আমার যত অসংখ্য অর্বাচীন বালককেও যথিত করেছিল গভীরভাবে। ক্রমে তিনি অনেক জনপ্রিয় গান উপহার দেন জাতিকে।
‘তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম’/‘নিন্দার কাঁটা না বিঁধিল গায়ে / প্রেমের কি স্বাদ আছে বল’/‘তুমি রাত, আমি রাতজাগা পাখি’/‘আমি হেলেন কিংবা নূরজাহানকে দেখিনি’ / ‘ও পাখিরে আয় দেখে যা কেমন আছি’... অধ্যাপক আবু জাফর তার নিজের ভাষায় নিজেকে বলেছেন- ‘গীতপতঙ্গ’।
তিনি আরো লিখেছেন- ‘প্রথম তারুণ্যে প্রেমে পড়ার চেয়েও গানই ছিল আমার সকল অভিযান ও অনুরাগের কেন্দ্রবিন্দু।’
বৈষ্ণব পদাবলী, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, লালন ফকির, ... এসব নিয়েই তিনি দিনরাত ছিলেন মত্ত। এ সময়কালে তার রচিত উল্লেখযোগ্য বই ছিল : ১. হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল (গীতি রচনা); ২. আমার নিকৃষ্ট গান (গীতি রচনা); ৩ বাংলা গানের সুখ-দুঃখ (প্রবন্ধ); ৪. বাজারে দুর্নাম তবু তুমি সর্বস্ব (কাব্য); ৫. বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত কবিতা (অনুবাদ)। ... ত্রিশ বছরের অভ্যস্ত, মনোরম ও মায়াবী বিচরণ ক্ষেত্রে একদিন যেন অনুভব করলেন তার ‘ডানায় নেমে আসছে ক্লান্তি’। বুকের মধ্যে ‘হাহাকারের মেঘ’, ‘পাকস্থলীতে বিবমিষা’। ‘আপাত উপভোগ্য অথচ নীরব উপেক্ষায় তার অন্তরে ও অভ্যন্তরে সব যেন টলমল অবস্থার সৃষ্টি করে’। এ সময় বিশিষ্ট লোক-বিজ্ঞানী প্রফেসর ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার হাতে ভারতের মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক অধ্যাপক কে এস রামকৃষ্ণ রাওয়ের নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ Mohammad The Prophet পড়তে দেন এবং অনুবাদ করতে অনুরোধ জানান। শিক্ষাগুরু আবু জাফরের এই অসামান্য অনুবাদকর্মটি দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় চার পর্বে ছাপা হয়েছিল।
প্রবন্ধটি পাঠোত্তর তার কেবলই মনে হতে লাগলো ‘এই পৃথিবীতে সর্বজনচিত্ত অনুরাগ নিয়ে কাউকে যদি ভালোবাসতে হয় তবে তিনি হচ্ছেন কেবলমাত্র একজনই ... হজরত মুহাম্মদ (সা:)’।
আবু জাফর নিজেকে একজন আধাআধি মুসলমান বলেই ভাবতেন। ধর্মকর্মে মন ছিল বলা যায় খানিকটা, একজন স্যেকুলার মুসলিমের যতই। নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে তার মনে কষ্ট এলো, তিনি একজন মুসলমান হয়েও একজন হিন্দুর মতো করে মুহাম্মদ (সা:)-কে আবিষ্কার করতে পারেননি। তার মনে আঘাত করল কুরআনের একটি বাণী : ‘ইয়া আইয়ুহাল ইনসানু মা গাররাকা বিরাব্বিকাল কারিম।’ (সূরা ইনফিতার
- হে মানব সন্তান, কোন্ জিনিস তোমাকে তোমার মহান প্রভু থেকে গাফেল করেছে?
এরই মধ্যে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা”)-কে নিয়ে জনৈক ছাত্রের অশালীন বা কটু মন্তব্যে তিনি রাগান্বিত ক্ষুব্ধ ও অস্থির হয়ে ওঠেন। এই ক্ষুব্ধ অনুভূতি, আর একজন বিধর্মীর চোখে বিস্ময়কর সম্মানের আসনে আসীন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবকে নিয়ে বই লেখার ঘটনা তার ভিতরে একই সাথে অসীম লজ্জা ও অনুপ্রেরণার কারণ হয়ে ওঠে।
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা:)কে তিনি পেয়ে গেলেন জীবনের ‘পথ ও পাথেয়’রূপে। ১৯৯৫ সালে হজব্রত পালনের মধ্য দিয়ে জীবনের চিন্তা চেতনায়, মননে, সমগ্র মনোজগতে ঘটে যায় আমূল পরিবর্তন- ‘যে হাতে কাবার গিলাব ধরেছি, সে হাতে আর নয় জ্ঞাতসারে কোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি!’
হজপর্ব সম্পাদনের পূর্বে তার কথা ও সুরে রচিত হয় প্রায় পাঁচশত গান। পরবর্তীতে ৪০-৫০ টি হামদ-নাতও রচনা করেছিলেন। এর কিছু কিছু তিনি নিজে সুরারোপ করেছেন। কিছু গানের সুর দিয়েছেন তার সুযোগ্য কনিষ্ঠপুত্র নুমানী। উল্লেখ্য, অধ্যাপক আবু জাফর ছিলেন এক মেয়ে ও তিন ছেলের জনক। তারা হলেন যথাক্রমে : জিহান ফারিয়া, সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস ক্যাডার), ইমাম নীমেরী (ব্যাংকার), ইমাম নাহীল (কর্মকতা, অস্ট্রেলিয়ান অ্যাম্বাসি), ইমাম জাফর নুমানী (শিক্ষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়)।
ইসলামের বিশ্বজনীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার পর ‘সবকিছুই তার কাছে তুচ্ছ ও অর্থহীন মনে হতে থাকে।’ পরম অনুশোচনায় তিনি সম্পূর্ণরূপে গুটিয়ে নেন নিজেকে। নিভৃতচারিতায় আত্মোপলব্ধির কিনারে দাঁড়িয়ে এক গভীর ও সুদৃঢ় আধ্যাত্মিক অভিনিবেশে প্রবিষ্ট হন তিনি প্রভুর সন্তুষ্টির সন্ধানে।
একের পর এক তিনি রচনা করতে থাকেন দীর্ঘ কলেবরসমৃদ্ধ অনেক গ্রন্থ। এগুলো হলো : ১. তুমি পথ প্রিয়তম নবী তুমিই পাথেয়, ২. ইসলামের শত্রু মিত্র, ৩. ইসলাম ও আত্মঘাতী মুসলমান, ৪. মহানবীর (সা:) মহাজীবন, ৫. আল্লামা ইকবাল : কবি ও নকীব ৬. মোহাম্মদ (সা:) মহাবিপ্লবের মহানায়ক ৭. অসহিষ্ণু মৌলবাদীর অপ্রিয় কথা ৮. ফার্স্ট থিংস ফার্স্ট (অনুবাদ)। তার রচিত এসব গ্রন্থাবলীতে বিবৃত হয়েছে জীবনের গভীরতম শিক্ষা ও অভিজ্ঞানলব্ধ সত্য। সুন্দরের আবেগ অনুভূতি ও অনুপম উপলব্ধি। ইসলাম সঞ্জাত বিবিধ আধুনিক অনুষঙ্গ।
কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি যা থেকে পাঠক সহজেই লেখকের গভীর আত্মবিশ্বাস ও অতল- প্রজ্ঞার বিষয়ে সম্যক প্রাণিত অনুভব করবেন।
১. ...‘লোকে যাই বলুক, আমি বিশ্বাস করি এটা নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাক প্রদত্ত আমার খোশনসিবি, যে কারণে জাগতিক অন্য কোনো দিকে এখন আর মন যেতে চায় না। আর অন্য কোনো বিষয়কে আমি তেমন আকর্ষণীয় বোধ করি না।’
২. ‘আমি যা সর্বান্তকরণে অনুভব করি তা হলো ইসলামকে নিয়ে আমি যেটুকু যা লেখালেখি করি, সেটা ইসলামের খেদমত নয় এবং প্রকৃত অর্থে সেটা ইসলামের জন্যও নয়। বস্তুত সেটা আমার নিজের জন্য।’...
৩. ‘এই জাতি যখন কাফের মুশরিকদের দ্বারে দ্বারে অবনত মস্তকে হেদায়েত ভিক্ষা করে বেড়ায়, তখন সত্যই মনে হয় অতীত যত বড় দীপ্তই হোক এ জাতির ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই।’
৪. ...কী অপূর্ব তামাশা! তামাশাই বটে! তবে দুঃখ হলো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশের প্রতিকূলে এ ধরনের মারেফতি তামাশার কারণেই পুরো মুসলিম উম্মাহ আজ সারা পৃথিবীর কাছে তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে, পরিণত হয়েছে আল্লাহর গজবে।
৫. ‘আমার লেখা পড়ে কিছু পাঠক আহত ক্ষুব্ধ হতে পারেন, ইসলামবিদ্বেষীরা হতে পারেন রীতিমতো অস্থির ও আক্রমণাত্মক। কিন্তু আমার এই পার্থিব জিন্দেগীর সফর যেহেতু শেষ হয়ে আসছে, এই বয়সে ও সময়ে একমাত্র আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ ছাড়া আমার আর কোনো লক্ষ্য নেই।’ ৬.'শিল্প বিপ্লবের একতরফা পুঁজিবাদী প্রবৃত্তি তাড়িত কদাকার পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের হাহাকার বঞ্চনাতে অতিষ্ঠ। কাল মার্কসের ‘দাস ক্যাপিটাল’ ও সাম্যবাদের বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তিতে রুশ নেতা ধর্মহীন সমবণ্টন ব্যবস্থা ও সরবরাহের সর্ব নির্মাণ ধসে পড়ল ১৯৯২ সালে লেলিনগ্রাদে।...
আবু জাফর নিজের জীবন অন্বেষা দিয়েই বুঝে নিয়েছিলেন, ঘনীভূত অন্ধকারে নিমজ্জিত মানব বর্বরোচিত অসভ্যতায় হজরত মুহাম্মদ (সা:) এসেছিলেন পৃথিবীতে এক মহাবিপ্লব সাধন করতে। তাই তিনি মহা বিপ্লবের মহানায়ক।
এই মহানায়কের প্রেমে উদ্বুদ্ধ আবু জাফর শতভাগ নিশ্চিত হয়ে নতুনভাবে উপলব্ধ হলেন, ...আল কুরআন যা আল্লাহ পাক নির্ধারিত নির্ভুল ইসলামী জীবন বিধান এবং মহানবী (সা:)-এর সমৃদ্ধ বাস্তব জীবনাদর্শ যা মানুষকে প্রকৃত অর্থেই সম্মানিত করেছে, যুক্তি দিয়েছে সকল দাসত্ব থেকে। দিয়েছে সত্যনিষ্ঠ সরল সুন্দর জীবন যাপনের অন্তহীন প্রেরণা। বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মার বিচ্যুতি, বিকৃতি ও অনৈক্য তাকে আহত করেছে, হতাশ করেছে, তবু তিনি আশাবাদী। তার মূল্যায়নে মুসলমানরা আজ নিজেই নিজের আততায়ী। মহাকবি ইকবালের ‘নঙ্গে আদম নঙ্গে দ্বী নঙ্গে ওয়াতান’-কথাটিই তিনি উল্লেখ করে বলেন, বর্তমান মুসলিম উম্মাহ ইহুদিদের চেয়েও জঘন্য। তারা জাতির শত্রু, যানবতার শত্রু এবং ধর্মের শত্রু।
একান্ত ব্যক্তিক-রীতিতেই অধ্যাপক আবু জাফর প্রকাশ-অনিস্পৃহ, নিভৃতচারী ব্যক্তিত্ব। পার্থিব সব চাওয়া পাওয়া থেকে নিজেকে এতটাই আড়াল করে ফেলেছিলেন যে ঢাকা শহরে থাকলেও তিনি ছিলেন অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন। হতে পারতেন তিনি বহুভাবে নন্দিত। পুরস্কৃত, সম্মানিত। জোটেনি তার ভাগ্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ‘বাংলা একাডেমি’, স্বাধীনতা কিংবা একুশে পদক পুরস্কার।
ইসলামের মহান ও সুশীতল ছায়াতলে এসে প্রিয় নবীর (সা:)-এর চারিত্রিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যেন নৈতিক ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনই ছিল তাঁর সর্বোচ্চ অপরাধ। এ প্রেক্ষিতেই তাঁকে অবাঞ্ছিত করেছে এ জাতির তথাকথিত সুশীল ও প্রগতিবাদীরা। ধিক্! এই অসাধারণ গুণী ব্যক্তিত্বের অসংখ্য ভক্তের মধ্যে আমিও নগণ্য একজন। আজ ন্যূনতম মানসিক স্বস্তি অনুভব করছি এই ভেবে যে, এই অধমের প্রস্তাবনায় চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র অনন্য প্রতিভাধর অধ্যাপক আবু জাফর স্যারকে ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার-২০১৩ অর্পণ করে সম্মানিত করেছিল।
গত ৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৩টায় ঘুম থেকে ঘুমে মহান প্রভুরই ডাকে সাড়া দিলেন অধ্যাপক আবু জাফর। সাঙ্গ হলো তার ৮২ বছরের ইহকালীন সফর। উল্লেখ্য, তার জন্মের দিনটিও (১৫ মে, ১৯৪২) ছিল শুক্রবার। অর্থাৎ জন্মমৃত্যু তার একই দিনে, পবিত্র জুমাবারে!
হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। শামিল হয়ে যাও আমার (নেক) বান্দাদের মধ্যে। এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে।’ আল ফজর (২৭-৩০)
[পুনশ্চ : রাজধানী থেকে দূরে মফস্বলে পড়ে থাকা বহু কালজয়ী গানের এই বহুমুখী বিরল প্রতিভাধর মানুষটি একাধারে ছিলেন লেখক, গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। এমন প্রতিভাধর মানুষ সত্যিই বিরল। স্বল্প পরিসরে তার রচনার সামগ্রিক মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভব। ইচ্ছে ছিল আলোচ্য এ লেখাটিতে মূলত ২০০৭ সালে অধ্যাপক আবু জাফর স্যারের কুষ্টিয়ার বাসায় তার সাথে দুই ঘণ্টার সান্নিধ্য-স্মৃতিনির্ভর কিছু কথা বলে সমাপ্তি টানার। আজকের পরিসরে তা আর সম্ভব নয়। ইনশাআল্লাহ অন্য কোনো সময়,অন্য কোনো লেখায় সেসব কথা বলার ইচ্ছে রইল। -লেখক।]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা