ফিরে দেখা
- মুহাম্মদ কামাল হোসেন
- ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০, আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:০৪
রাকিবের জীবনের গল্পটা ছিল এক দুঃসহ লড়াইয়ের গল্প। তার শৈশব কেটেছিল দারিদ্র্যের কঠিন ছায়ায়। তার বাবা মারা গিয়েছিলেন, যখন সে মাত্র ছয় বছরের। সংসারের ভার তখন একেবারে মা হামিদার কাঁধে এসে পড়ল। মা ছিলেন এক অসাধারণ সংগ্রামী নারী। বিয়ের পরই সংসার চালানোর জন্য সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, আর বাবার মৃত্যুর পর সেই ত্যাগ যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। দিনভর অন্যের বাড়িতে কাজ করা, রাতে সেলাই করে অল্প কিছু টাকা রোজগার- এভাবেই চলত তাদের দিন।
গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করত রাকিব। পড়ালেখায় সে বরাবরই ভালো ছিল। কিন্তু সংসারের অভাব তার জীবনকে শৈশবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছিল। অন্য ছেলেরা যখন খেলাধুলায় মেতে থাকত, রাকিব তখন ধান কাটার কাজ করত কিংবা গরুর জন্য ঘাস কাটতে মাঠে যেত। অভাব তার কাছে শেখায়নি কোনো প্রকার অভিযোগ, বরং শিখিয়েছে স্বপ্ন দেখা।
রাকিবের জীবনে একমাত্র আশার আলো ছিল তার মা আর স্কুলের সহপাঠী মায়া। মায়া ছিল তার চেয়ে এক বছর ছোট। দুজনের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব ছিল, যা ধীরে ধীরে গভীর ভালোবাসায় রূপ নেয়। মায়ার সঙ্গে স্কুল শেষে গ্রামের মেঠোপথে হাঁটতে হাঁটতে রাকিব মনে করত, এই পথেই একদিন তার স্বপ্ন পূরণ হবে।
একদিন বিকেলে ধানক্ষেতের আলে বসে মায়া রাকিবকে বলেছিল, ‘দেখিস, তুই না একদিন অনেক বড় মানুষ হবি। আমার খুব গর্ব হবে তখন।’
রাকিব হেসে বলেছিল, ‘তোর স্বপ্ন আমি ভাঙতে দেব না, মায়া। ইনশাআল্লাহ একদিন তুই সত্যিই গর্ব করবি।’
তাদের এই ছোট ছোট স্বপ্নগুলো রাকিবের দিন কাটানোর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল। কিন্তু সময়ের কঠিন বাস্তবতা তাকে সেই স্বপ্ন থেকে বারবার দূরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
রাকিব যখন অষ্টম শ্রেণীতে উঠল, তখন তার মায়ের শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়ল। ডাক্তার জানালেন, তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার। সেই টাকা কোথায় পাবে রাকিব? স্কুল ছাড়তে বাধ্য হলো সে। দিনরাত কাজ শুরু করল মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য। আর সেই সঙ্গে মায়ার পরিবারের পক্ষ থেকে চাপ বাড়তে লাগল বিয়ের জন্য।
রাকিব বারবার মায়াকে বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘কিছু দিন অপেক্ষা করো, মায়া। আমি ঠিকঠাক সব সামলে নেবো।’
কিন্তু জীবন তো আর অপেক্ষা করে না। মায়ার বাবা-মা তাকে এক ধনী পরিবারের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। রাকিব শূন্য হাতে ফিরে এলো তার কঠিন বাস্তবতার কাছে। মায়াকে হারানোর কষ্টে সে ভেঙে পড়ল, কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার নিজেকে সামলাল।
একদিন মাকে বাঁচানোর স্বপ্ন নিয়ে রাকিব গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে এলো। শহরে সে প্রথমে একটা গার্মেন্টসে চাকরি নিল। সারাদিন কাজ করত, আর রাতে চেষ্টা করত নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার। এখানে এসে সে এক নতুন সংগ্রামের মুখোমুখি হলো। শহরের নিষ্ঠুর বাস্তবতা, মানুষের নির্লিপ্ততা আর একাকিত্ব তাকে প্রতিনিয়ত গিলে খাওয়ার চেষ্টা করত।
এরই মাঝে একদিন রাকিব খবর পেল, মায়ার স্বামী একজন অত্যন্ত রুক্ষ মানুষ। মায়া সুখী নয়। কিন্তু এই খবর তাকে কিছু করার সুযোগ দেয়নি। সে বুঝতে পারল, মায়াকে ভুলে যাওয়াই তার জন্য একমাত্র উপায়।
শহরে কয়েক বছর কাজ করে রাকিব একসময় নিজের একটা দোকান খুলল। ছোট্ট মুদি দোকান, কিন্তু তার জীবনের বড় স্বপ্নের সূচনা। দোকানের আয় দিয়ে সে মায়ের চিকিৎসা চালাত এবং ছোট বোন সুমীর পড়াশোনার খরচ বহন করত।
এরপর অনেক বছর কেটে গেল। রাকিবের মা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। সুমীও কলেজে ভর্তি হলো। এদিকে রাকিবের দোকানও বেশ চলছিল। কিন্তু মায়ার স্মৃতি তাকে কখনোই পুরোপুরি ছাড়েনি।
একদিন রাকিব এক অদ্ভুত খবরে হতবাক হলো। মায়ার মেয়ে রিমি তখন গুরুতর অসুস্থ। তার চিকিৎসার খরচ চালাতে মায়া প্রায় পাগল হয়ে গেছে। এই খবর পেয়ে রাকিবের হৃদয়ে এক অদ্ভুত অস্থিরতা তৈরি হলো। একদিকে মায়ার প্রতি তার পুরোনো ভালোবাসা, অন্যদিকে আত্মসম্মানের প্রশ্ন।
রাকিব অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল, সে মায়াকে সাহায্য করবে। কিন্তু নিজের পরিচয় গোপন রাখবে। সে মায়ার মেয়ের চিকিৎসার খরচ গোপনে পাঠাল। মায়া কখনো জানতে পারল না, কে এই মহান সাহায্যকারী।
মায়ার মেয়ে আস্তে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। রাকিবের সাহায্যের কথাও ততদিনে জেনে গেছে মায়া। এদিকে রিমি একদিন রাকিবের দোকানে এসে হাজির। মায়ার পাঠানো ছোট্ট একটা চিঠি হাতে নিয়ে সে বলল, ‘মা আপনাকে ধন্যবাদ দিতে বলেছেন। আপনি যে এতবড় সহায়তা করেছেন, তা তিনি কখনো কোনো দিন ভুলবেন না।’
রাকিব চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ল। মায়া লিখেছিল, ‘আমার জীবনে অনেক ভুল হয়েছে। তবুও তোমার মনের বড়ত্ব দেখে আমি কৃতজ্ঞ। হয়তো এই ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু আমার মেয়ে তোমার ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়েছে এতেই আমি তৃপ্ত।’
চিঠিটা পড়ে রাকিবের চোখ ভিজে উঠল। সময় তাকে মায়া থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেও তাদের সম্পর্ক যেন কোনো এক অদৃশ্য সুতায় বাঁধা ছিল।
রিমির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রাকিব দেখল, মেয়েটি ঠিক তার মায়ের মতো অভিমানী, কিন্তু হৃদয়ের ভেতরে অনেক মায়া। রিমি রাকিবকে নিজের জীবনের গল্প বলল, তার সংগ্রামের কথা, তার মায়ের কষ্টের কথা।
রাকিব সেদিন রাতে নিজেকে অনেক হালকা মনে করল। মায়াকে সে হয়তো হারিয়েছে, কিন্তু রিমির মাধ্যমে তাদের সম্পর্কের একটা ছায়া টিকে আছে।
রাকিব নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ভেবেছে। এই কঠিন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে গিয়েও সে বুঝতে পেরেছে, জীবনের মানে হলো এগিয়ে চলা। হারানোর কষ্ট থাকে, কিন্তু সেই কষ্টই তো আমাদের শক্তি দেয় নতুন কিছু গড়ার। নিজের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে রাকিব একা একা বলল, ‘জীবন আসলে একটা চক্র। আমরা পেছনে ফিরে তাকাই, কিন্তু ভবিষ্যৎ আমাদের সামনেই থাকে। স্মৃতি কষ্ট দেয়, আবার সেই স্মৃতিই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।’
রাকিবের জীবনে এখন আর কোনো অভাব নেই। তার মা সুস্থ, তার বোন উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। কিন্তু তার মনের ভেতর সেই মায়ার স্মৃতি আজও অমলিন, বেঁচে আছে। মায়া হয়তো তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, কিন্তু তাদের একে অপরের জন্য করা ত্যাগ আর ভালোবাসা চিরকাল থেকে যাবে সময়ের ওপারে।
সময় বহমান। বসে থাকে না। রাকিবের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আজ থেকে কয়েক বছর আগে, যখন সে শহরে এসে তার মায়ের চিকিৎসার জন্য সংগ্রাম করছিল, তখন তার দৃষ্টি ছিল শুধুমাত্র একটিই মায়ের সুস্থতা। সেই দিনগুলো ছিল চরম কষ্টের, কিন্তু সে কখনো হার মানেনি। সময়ের সাথে তার সংগ্রাম অবশেষে ফল দিয়েছে। তার মা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, সুমী কলেজে ভর্তি হয়েছে এবং রাকিবের ছোট মুদি দোকান এখন একটা লাভজনক ব্যবসায় রূপ নিয়েছে। তবে সব কিছু সুন্দর হলেও, রাকিব কখনো একাকিত্বের অনুভূতি থেকে মুক্তি পায়নি। মায়ার স্মৃতি এখনো তার হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটে বসে ছিল।
রিমির মাধ্যমে সে একবার মায়ার কাছ থেকে একটা অদৃশ্য যোগাযোগ পেয়েছিল। যদিও মায়া আর রাকিবের মধ্যে সম্পর্ক অতীত হয়ে গেছে। তবুও রাকিব জানত, মায়ার প্রতি তার অনুভূতিগুলো কখনো মুছে যাবে না। রিমির সঙ্গে কথা বলে সে অনুভব করেছিল, মায়ার মধ্যে যে সংগ্রাম ছিল, সেটিই তার জীবনে বাস্তব হয়ে উঠেছে। রিমি তার মায়ের মতোই সংগ্রামী এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। সে জানত তার মা কখনো তাকে ছেড়ে চলে যাবে না, তবে তার নিজের জীবন ও সংগ্রাম তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। রাকিবও আজ বুঝতে পেরেছিল, জীবন কখনো থেমে থাকে না। সংগ্রামের মাঝেই নিহিত জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য।
এরপর একদিন রাকিব সিদ্ধান্ত নিল, সে তার মায়ের জন্য একটা কিছু করবে, যা তাদের জীবনের স্মৃতি হিসেবে থাকবে। সে একটি ছোট্ট বাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিল। এটি ছিল তার মা ও বোনের জন্য একটি স্থায়ী আশ্রয়স্থল, যেখানে তারা সুখে ও শান্তিতে থাকতে পারবে। এই বাড়ি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায়, রাকিবের মনে একটা অদ্ভুত শান্তি নেমে আসল। সে জানত, তার জীবনের সব সংগ্রাম ও কষ্টের পর, এটা ছিল তার পরিবারের জন্য একটি উপহার, একটি নতুন সূচনা।
অবশেষে রাকিব নিজের হাতে তৈরি করা বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে একদিন তার চোখ ভিজে উঠল। এটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। সে জানত, মা ও বোনকে সুখে রাখার জন্য এই ছোট্ট বাড়ি তার জীবনের এক অমূল্য উপহার। মায়া হয়তো তার জীবনে আর ফিরে আসবে না, কিন্তু তার প্রেরণা এখনো রাকিবের মধ্যে বেঁচে ছিল। মায়ার কথা মনে করে রাকিব মনে মনে বলল, ‘তুমি কখনো না ফিরে এসেও আমার জীবনে আজও আছ। তোমার স্বপ্ন আমি কখনো মিথ্যা হতে দেইনি।’
বাড়িটি যখন শেষ হলো, রাকিব তার মাকে নিয়ে সেখানে একদিন বসেছিল। মা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘বাজান, তুই আজ এত কিছু করতে পেরেছিস, আমার মাথা গর্বে উঁচু হয়ে যায়। তোর সংগ্রাম দেখে আমি বিশ্বাস করি, একজন মানুষ যদি নিজের স্বপ্নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে, তবে কোনো কিছুই তাকে থামাতে পারে না।’
রাকিব হেসে বলল, ‘মা, তুমিই তো আমার সব কিছু। তোমার সংগ্রাম আর ভালোবাসাই আমাকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।’
এরপর সুমীও বাড়ি ফিরে এলো। সে কলেজের পাঠ শেষ করে স্বপ্ন দেখছিল তার নিজের ভবিষ্যতের। রাকিব তার জীবনের সংগ্রামগুলোর কথা স্মরণ করে বলল, ‘এটা আমাদের নতুন শুরু, সুমী। দেখিস আমরা আমাদের সমস্ত স্বপ্নগুলোকে ইনশাআল্লাহ একদিন পূর্ণতা দেব।
সেই দিন রাকিব অনুভব করল যে, জীবনের চলার পথে হারানো কিছুই আসলে সত্যি হারানো হয় না। প্রতিটি মানুষ তার জীবনে কোনো না কোনো সময় নিজের সংগ্রাম ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবেলা করে। রাকিব জানত, যাদের কাছে একদিন সে হারিয়ে গিয়েছিল, তাদের প্রতি তার ভালোবাসা ও আত্মসম্মান চিরকাল বেঁচে থাকবে।
সকালবেলা তার চোখের সামনে সব কিছু শান্ত, সুন্দর এবং পরিপূর্ণ ছিল। আজ তার জীবন যেন এক অবিশ্বাস্য যাত্রার পরিপূর্ণ চক্র, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি স্মৃতি তাকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল। পেছনে ফিরে তাকানো আর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলা, এই দুইয়ের মাঝে সে অনুভব করল, জীবন আসলে শুধুমাত্র এগিয়ে চলার নাম, যতই কঠিন হোক না কেন। রাকিব বুঝতে পারল, তার সংগ্রামের সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো সেই শান্তি, যা তাকে তার জীবনকে এক নতুনরূপে দেখতে সাহায্য করেছিল। স্মৃতি কখনোই চলে যায় না, তারা জীবনের প্রতিটি মূহূর্তে এক ধরনের আলো ছড়ায়, যা মানুষকে জীবনকে ভালোবাসতে এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে শেখায়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা