১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

স্মৃতি যখন সামনে এসে দাঁড়ায়

স্মৃতি যখন সামনে এসে দাঁড়ায় -

আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। মনে পড়ছে টিনের তৈরি স্কুল ঘরটিকে। এল প্যাটার্নের সেই টিনের ঘরের পশ্চিম পাশের ক্লাসটি প্রাইমারির শেষ ধাপ, পঞ্চম শ্রেণীর। সেই শ্রেণীতে পড়াতেন আমার বাবার বন্ধু ও এই স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, আমার আব্বাও ছিলেন তাদের একজন, পড়াতেন ইংরেজি। আমি তাকে খুব ভয় পেতাম। তিনি পড়াতেন আর হাতে ধরা বেতটি নাচাতেন। তা দেখেই আত্মায় জল শুকিয়ে যেত। তেষ্টায় বুক কাঠ কাঠ ঠেকত। গলা দিয়ে স্বর বেরুতে চাইত না। সৈয়দ নওজেশ আলী প্রায় দিনই আমাকে টার্গেট করতেন। বন্ধুর পোলা কি লেখাপড়া করে সেটি যাচাই করাই ছিল তার রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব, এটিই আমি বুঝেছিলাম অনেক পরে। বলতেন, খানের পোলা কৃষ্ণচূড়া বানান করো। আমি তার দেয়া পড়া ঠোঁটস্ত করে আসতাম, যেকোনো মূল্যে। আমি বানানটিকে বহুকষ্টে আয়ত্ত করেছিলাম এবং হরহর করে সেই বানান আমি বলে দিতাম। তিনি খুব উচ্ছ্বসিত হতেন। আর যেদিন পারতাম না, থতমত খেয়ে তুতলাতাম, সেদিন তিনি আমার কান ধরে মুচড়ে দিতেন আর তার সঙ্গে চলত সেই নৃত্যময় বেতের চাটি। পিঠ লাল হয়ে যেত। আর খানের পোলা কর কী, সারা দিন কর কী? ক্লাসের পড়ারও সময় হয় না? যেদিন পড়া পারতাম সেদিন আমার প্রশংসা করে কাছে এসে বেতের একটি চাটি দিতেন। বলতেন, তর বাবারে কমু, তুই ভালো করছিস।
তিনি তুই-তুকারি করতেন। শুধু তিনি নন, সব মাস্টারই শিশুদের তুই তুকারি করতেন। আমরা এর কোনো বিকল্প জানতাম না। এই যেমন আমাদের আশপাশের কয়েকটি গ্রাম ছাড়া পৃথিবীতে আরো গ্রাম/শহর আছে, এটাও জানতাম না। আরেকটু বড় হলে জানলাম আইসড়া গ্রামের কাছেই আছে একটি শহর, টাঙ্গাইল তার নাম। মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরের ওই শহরে যেতে আমাদের পথে কতবার যে জিরাতে হতো, পানি খেতে হতো। তারপরও রাস্তা ফুরাত না। হাঁটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। আর রাস্তার ধারে টিউবওয়েল পেলেই, হাত-মুখ পা ধুয়ে নিতাম। কারণ, সড়কটিতে গরুর গাড়ি চলে ধুলার সাগর বানিয়ে ফেলে ছিল। আরো পরে, যখন আমরা কিশোরোত্তীর্ণ সদ্য যুবক হলাম তখন ওই সড়কটিতে ইট বিছানো শুরু হলো। একে নাকি বলে হেরিংবোন। তখন থেকেই টাঙ্গাইল শহর আমাকে টানতে শুরু করে।
আমি গ্রামের স্কুলের ছাত্র। ফাইভ থেকে সিক্স-এ উঠলাম। কি যে আনন্দ! সেই আনন্দের পেছনে ছিল সৈয়দ নওয়াজেশ আলী স্যারের মার খাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার আনন্দ। কিন্তু সেই আনন্দের সঙ্গে শঙ্কাও ছিল। কালিহাতী থানার আমাদের গ্রামের কাছেরই রোয়াইল গ্রামের এক হিন্দু মাস্টার,আমাদের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। জবরদস্ত স্বাস্থ্য তার, তিনি ধুতি আর ফুলহাতা শার্ট পরতেন। সেই শার্টের দুই পাশে ছিল পকেট। অধিকাংশ মানুষই ওই ধরনের শার্ট পরতেন। সেটাই ছিল গ্রামীণ শিক্ষিতজনের পোশাকের ডিজাইন। আমার আব্বাও ওই রকম শার্ট পরতেন। তবে আব্বার ছিল পাঞ্জাবি। পায়জামা আর মোকাসিন জুতো। তিনিও আব্বারই বন্ধু, সমসাময়িক, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, তিনি অঙ্কের টিচার, ক্লাস সিক্সে। হয়তো সেভেন, এইট পর্যন্ত তিনি অঙ্কই কষাতেন। আমার মনে নেই ওপরের ক্লাসে অঙ্ক পড়াতেন কি না। অঙ্ক না পারলে তিনি তার বড় বড় কিছুটা টলটলে টানা চোখ আর টানা ভ্রƒ নাচিয়ে বলতেন অঙ্ক ভালো না লাগলে তো তুই গোলায় যাবি, বলে তিনি তার বাঁ হাত দিয়ে আমার মাথা চেপে ধরে নিচু করতেন। তারপর ডান হাত মুঠি করা আঙুল দিয়ে কিল মারতেন। ধুম ধুম শব্দ হতো। তার সেই কিলের আওয়াজ আজও কানে বাজে।
এখানে আরো একটি ঘটনার কথা জানাই। বিশ্বনাথ চক্রবর্তী স্যার মজার এক মানুষ ছিলেন। তিনি পড়তে ও শিখতে ভালোবাসতেন। তিনি প্রমোশন পাবেন যদি এমএ করে ফেলতে পারেন। আমার অগ্রজ ড. মাহবুব সাদিক তখন করটিয়ার সা’দত কলেজের বাংলার শিক্ষক। ভাইও ছিলেন কিশোরজীবনে বিশ্বনাথ স্যারের ছাত্র। তিনি যা পরামর্শ দেয়ার দিলেন। বিশ্বনাথ স্যার এমএ ফার্স্ট পার্ট পাস করে গেলেন। মনে হয় তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শিক্ষকদের জন্য ট্রেনিংয়ে এসেছেন ঢাকা কলেজের পাশে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ বা ইনস্টিটিশনে। তিনি খবর নিয়ে এসেছিলেন যে আমি মহসিন হলে থাকি। এবং কাউকে দিয়ে খবর দিয়েছিলেন যে আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করি। খবর পেয়েই গেলাম। তিনি ছিলেন নাটকের রিহার্সেলে। তিনি যে নাটক করতে ভালোবাসতেন তা আমি জানতাম না।
আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। তিনি আধা ঘণ্টা পর এলেন। আরে, তুই আইছিস। তিনি খুব খুশি। স্যার কেন ডেকেছেন, এই কথাটা জিজ্ঞেস করবার আগে তার কুশল জানলাম। তিনি যে ফাইনাল দেবেন সে কথাও জানালেন। বললেন ভাইজানের কথা। তিনি একটু দূরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়ে গেছেন। তার এমএ ক্লাসের নোট দরকার। তিনি জানালেন কি কি দরকার। আমি সেগুলো টুকে নিয়ে গেলাম। তারপর আমার কাছে থাকা নোটগুলো দিয়ে এলাম তাকে একদিন পর। তারপর আর কোনো খবর নিইনি, নেয়ার সুযোগ পাইনি।
আমি সৈয়দ নওয়াজেশ স্যারের বেতের বাড়ি থেকে বেঁচে এসে পড়লাম আরেকজন বাঘের মামার কাছে। ভয় আর গেল না। আমি বৃত্তির জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। এইটের বৃত্তি পরীক্ষাও দিলাম, কিন্তু পেলাম না। অঙ্কে ডাব্বা। অঙ্ক ভয় আমাকে ডুবিয়ে দিলো। তাই নাইনে রেজিস্ট্রেশন করার পর আমাদের বিএসসি আবুল কাশেম স্যারের কাছে তিন মাস প্রাইভেট পড়লাম। ওই তিন মাসে যা শিখলাম সরল অঙ্ক যে আদতেও সরল এবং গরলও, মানে প্যাঁচ মারা সেটা জেনে খুর খুশি হলাম। তিনি পরে, পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন বলে শুনেছিলাম। তার শিখানোর জোরেই এসএসসিতে আমি লেটার মার্কস পাইনি। তিনি বলতেন সবার আগে সরল অঙ্কটি রাফ করে নিয়ে শেষ করবে। এটা পরীক্ষার শেষ দিকে করতে গেলে ভুল হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। তাই এই পরামর্শ। আর সরলে সাক্কা ১০ মার্কস পেলে ঐকিক নিয়মে বা সুদকষায় নম্বর পাওয়া কঠিন না। বেশি নম্বরের অঙ্কগুলো জানা থাকলে, আমরা বলতাম কমন পড়লে, সেগুলোই সব কিছুর আগে করতে হবে। জ্যামিতির বর্ণনা ঠিক মতো দিতে পারলেও ৮ এর মধ্যে ৪-৫এর বেশি নম্বর দিতেন না পরীক্ষকরা। মি এসএসসিতে ইতিহাসে ৬১ নম্বর পেয়ে লেটার্স মার্কসের অধিকারী হলাম। আমার সে খুশি কে দেখে? আমাদের সময় রেজাল্ট দিতে সংবাদপত্রগুলোতে। রেজাল্টের খবর পেয়ে আমরা প্রথমে স্কুলে গেলাম। সেখানে পেলাম বাচ্চু স্যারকে। তিনি আমাদের আরবির শিক্ষক আবার তিনিই কেরানির কাজটি করতেন। আমি ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশনের গলে তিনি ভেটকি দিয়ে বলেছিলেন আসল বয়স লিখলে তুই সরকারি চাকরি বয়স পাবি। তিনি আরেকটি ফরম দিয়ে বললেন জন্ম ১৯৫৫ লেখ। আমি নাছোড়বান্দা, কিন্তু আব্বার কাছে বলে দেবেন, এই ভয়ে লিখে দিলাম। তাকে রেজাল্টের কথা বললাম। তিনি পাইন। কে একজন বলল যশিহাটি কার কাছে নাকি নিউজ পেপার আছে। সেখানে রেজাল্টও আছে। শুনেই আমরা কয়েক বন্ধু দৌড়ালাম যশিহাটির দিকে। এবং পেলাম। সেটা ছিল রেজাল্ট বেরুবার একদিন পরের ঘটনা। সেই লোকটির কাছে থেকে আমাদের স্কুলের রেজাল্ট অংশ নিয়ে এলাম। রোল নম্বর ছিল ১৩৫৭/কিংবা ১৩৭০। এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে আজও আমার তহবিলে ওই পরীক্ষার প্রবেশপত্র ইনট্যাক্ট আছে। আমার রোল নম্বরের পাশে একটি স্টার বসানো।
আমি কিন্তু কখনোই ভালো ছাত্র ছিলাম না। মাঝারি মানের ছাত্র। তবে অন্যদের চেয়ে আমার আইকিউ নাকি ভালো ছিল। আমি কখনোই টের পাইনি। এখন কিছুটা টের পাই। আমার তৃতীয় নয়ন আছে, বুঝতে পারি।


আরো সংবাদ



premium cement
‘আপত্তিকর ভাষা’ ব্যবহারে শাস্তি পেলেন জোসেফ শ্রীমঙ্গলে হত্যা মামলায় প্রেমিক গ্রেফতার জামায়াত নেতা কাজী ফজলুল করিমের মৃত্যুতে ড. রেজাউল করিমের শোক প্রকাশ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে মাঠে থাকব : মুন্না আমতলীতে ব্যবসায়ীকে আত্মহত্যার প্ররোচনায় জড়িতদের বিচার দাবি সিরিয়া নিয়ে আশা ও শঙ্কা ইসরাইলের সিরিয়ায় বাশারের পতনে ইসরাইল কতটুকু লাভবান অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের ৫৭৯ কর্মকর্তা লক্ষ্মীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহত ৫ এ দেশে রাজনীতি করতে হলে জনগণের সেবক হয়েই রাজনীতি করতে হবে : সেলিম উদ্দিন এখন সময় শান্তি ও স্থিতিশীলতার : অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী

সকল