সংগ্রামের প্রেরণা বেগম রোকেয়া
- আফতাব চৌধুরী
- ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সতীদাহ প্রথার যুগ পেরিয়ে মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছেন ২০২৪ সালে। অতীতে অনেক জ্ঞানী-গুণী ও সংস্কারবাদীরা মেয়েদের বন্দিদশা ঘুচিয়ে মুক্তির দিশা দেখাতে চেয়েছিলেন। মহিলাদের জন্য সঠিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করেছিলেন। তাদের পাশাপাশি কাজ করে গেছেন অনেক মহিলারাও, যাদের অবদান কখনোই আমাদের ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এরকমই একজন হলেন বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়ার জন্ম। বাবা ছিলেন জমিদার জহিরুদ্দিন আবু আলি হায়দার সাবের। বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামেই রোকেয়ার ছোটবেলা কাটে। রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের করিমুন্নেসার কাছে বাংলা ভাষা শিখেন রোকেয়া। দাদা ইবরাহিম সাবের শেখান ইংরেজি। ছোটবেলা পড়াশোনার জগৎটা কিছু খোলা থাকায় নানা বাধাবিপত্তি রোকেয়াকে দমচাপা করে রাখতে পারেনি।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেনের সাথে। বাইরের পৃথিবীটা খুলে গেল রোকেয়ার সামনে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাননি তিনি। আমৃত্যু কাজ করে গেছেন সমাজের উন্নতির জন্য। পাশাপাশি নিজেকে যুক্ত করে নিলেন সাহিত্য জগতের সঙ্গে মেয়েদের কষ্টের কথা নিয়ে বেশি করে ভেবেছেন বেগম রোকেয়া। শুধু ভাবেনইনি, লেখালেখি করেছেন এ বিষয়ে প্রচুর। প্রতিষ্ঠা করেছেন মুসলমান মেয়েদের জন্য প্রথম বিদ্যালয় ‘শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিনে ইসলাম’-এর মতো প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেছেন রোকেয়া। এ কথা ঠিক, তার কাজ ছিল বিশেষভাবে মুসলমান মেয়েদের মধ্যেই। কিন্তু তার ভাবনায় ছিল সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের মেয়েদের চোখের পানি মুছে দেয়ার অকৃত্রিম প্রয়াস। বাংলাদেশে বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরী যে কাজ শুরু করেছিলেন রোকেয়ার চেষ্টায় তা শাখা-প্রশাখায় বিস্তার লাভ করতে থাকে অচিরেই।
রোকেয়ার রচনার অনেক আগে মেয়েদের জীবন যাপনের হীনতার কথা বলেছিলেন আরো ক’জন। ১৯ শতকের মাঝামাঝি কৈলাশবাসিনী দেবী লিখেছিলেন ‘হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা’। কৃষ্ণভাবিনী দাসও তার লেখায় জানিয়েছেন, ‘মেয়েরা পুরুষের থেকে নিচুস্তরের কোনো জীব নয়।’ কিন্তু তাদের লেখালেখিকে একটুও খাটো না করে বলা যায়, রোকেয়া যেন তার সময়ের সবাইকেই অনায়াসে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন এবং মনে রাখতে হবে তিনি ছিলেন ওই সময়ের কোনো এক সম্ভ্রান্ত রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সদস্যা।
শিক্ষাই যে মেয়েদের মুক্তির প্রথম শর্ত হওয়া দরকার এ কথাটি রোকেয়া উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সবচেয়ে বেশি। ‘ডেলিসিয়া হত্যা’ নামে একটি লেখাতে রোকেয়া জানাচ্ছেন, ‘ইংরেজ রমণীর জীবন কিরূপ? আমরা মনে করি তাহারা স্ব^াধীন, বিদূষী, পুরুষের সমকক্ষা, সমাজে আদৃতা...। কিন্তু একবার তাহাদের গৃহাভ্যন্তরে উঁকি মারিয়া দেখিতে পাইলে বুঝি সব ফাঁকা...। কিন্তু দু’জনের মধ্যে একটি তফাৎ এই যে ইউরোপের মেয়ে বিদূষী, আর ভারতের মেয়ে নিরক্ষর। তাই ইউরোপের মেয়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আছে, যা ভারতের মেয়ের নাই।’
‘গৃহ বলিতে আমাদের একটি পর্ণকুটির নাই। প্রাণীজগতে কোনো জন্তুই আমাদের মতো নিরাশ্রয়া নহে। সকলেরই গৃহ আছে, নাই কেবল আমাদের।’ ‘মতিচুর’ প্রথম খণ্ডে ‘গৃহ’তে এরকমই লিখেছেন রোকেয়া। মনে পড়ে ভার্জিনিয়া উলফকে। প্রায় একই কথা লিখেছেন তিনি ‘এ রুম অব ওয়ানস রুম’ নামক বিখ্যাত বইয়ে। দেশ-কাল-গণ্ডির সীমা ছাড়িয়ে এভাবেই রোকেয়া হয়ে উঠেছেন মেয়েদের আপনজন। শিক্ষায় নারী-পুরুষের অধিকারের অসাম্যের বিরুদ্ধে ঝলসে উঠেন রোকেয়া। ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে রোকেয়া লিখেন, ‘স্বামী যখন কল্পনা-সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ নক্ষত্রমালা পরিবেষ্টিত হয়ে সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমণ্ডলের ঘন ফল তুলাদণ্ডে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাল ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনির গতি নির্ণয় করেন।’
‘মতিচুর’ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, সুলতানার স্বপ্ন, উপন্যাস ‘পদ¥রাগ’ এবং ‘অবরোধবাসিনী’ এগুলো রোকেয়ার রচনা। সংখ্যার দিক থেকে তেমন কিছু নয়। কিন্তু হƒদয় মথিত করা ‘রচনাগুলো নিয়ে যত নাড়াচাড়া করি, ততই অবাক হতে থাকি। সে সময়ে বসে, একা একা রোকেয়া কি করে ভেবেছিলেন এসব কথা, লিখে রেখেছিলেন নিজের ভাবনাগুলোকে ভাবলে এ সময়েও বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে পারা যায় না। ‘দজ্জাল’ প্রবন্ধে লেখিকা বলেছিলেন, ‘উন্নতির পথ কণ্টকাকীর্ণ, অতি কষ্টে অগ্রসর হইতে হয়, পদে পদে মানবের পদঙ্খলন হয়। উন্নতির পথে যত বিঘœ, কত বাঁধা। ও পথে পদ বিক্ষেপ করিবামাত্র ভুজঙ্গের শত ফণা গর্জন করিয়া উঠে। অবনতি স্রোতে একবার গা ভাসাইয়া দিলে আর কিছু করিতে হয় না, অনায়াসে গড়াইয়া গড়াইয়া নরককূপে পড়া যায়।’ আজো এ কথাগুলো যে কি রকম প্রাসঙ্গিক তা আর আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই বলেই মনে হয়। ১৯২১ সালে, ইংরেজের সঙ্গে অসহযোগিতার ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতারা। দেশকে স্বনির্ভরতার পথে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রতীক হিসেবে সবাইকে চরকা কাটতে বলা হয়। গ্রামগুলো কিভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে, কিভাবে দেশের মানুষ ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেশের উৎপাদনই গ্রহণ করবে, এসব ভাবনা-চিন্তা ছড়িয়ে আছে রোকেয়ার লেখালেখিতেও। যদিও কোনো ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ দেননি বেগম রোকেয়া। বাংলাদেশের রংপুরের এন্ডি শিল্পকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন রোকেয়া তার লেখার মধ্য দিয়ে। ‘এন্ডি শিল্প’ লেখাতে এন্ডির গুঁটি কি করে পুষতে হয় এর নিয়ম দিয়েছিলেন রোকেয়া তার লেখনীতে শুধু তাই নয়, এ ব্যবসাতে কত লাভ হতে পারে এরও বিশদ বিবরণ দিয়েছিলেন তিনি। চরকা আন্দোলনের ছাপ দেখি রোকেয়ার ‘বলিগর্ত’ নামে এক নকশায়। সেখানে পাওয়া যায় হিন্দু ও মুসলমান মেয়ে মিলে চরকা প্রচারের কাজ করছে।
নারী, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি প্রায় সব ক’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের ভাবনা চিন্তাকে জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন রোকেয়া। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে নানা সমস্যা, অসুবিধা ও সামাজিক ক্ষেত্রেও নানা প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলেছেন রোকেয়া। থামতে যেন তিনি জানতেন না! তাই মাত্র ৫২ বছরের কর্মময় জীবনে রোকেয়া আমাদের আশার আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। তার ‘অবরোধবাসিনী’ বইয়ের নিবেদন অংশে রোকেয়া লিখেছিলেন, ‘আমি কারমিয়ং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি। উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগরতীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর জীবনের পঁচিশ বৎসর ধরিয়া সমাজসেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিস¤পাত কুড়াইতেছি’। সুখ-দুঃখের কথা এভাবেই ব্যক্ত করেছেন রোকেয়া তার লেখালেখিতে।
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। জীবনের শেষ রাত্রিটি পর্যন্ত অনেক সময় স্কুলের ফাইল দেখেছেন তিনি। অবিরত নানান প্রশ্ন উঠে আসত তার মনে, আর এসব প্রশ্ন-উত্তর-যুক্তির সমন্বয়ে তার লেখা হয়ে উঠত তৎকালীন সময়ের জীবন্ত দলিল।
রাজনীতিতে মেয়েদের প্রবেশ আজ অবাধ। মেয়েরা আজ আকাশে উড়ছেন, পাতালে নামছেন। জীবনের নানা পেশায়, শাখায় নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছেন। নতুন নতুন পথের সাক্ষর রাখছেন। এমন স্বপ্নই রোকেয়া দেখেছেন। এক বৈষম্যহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন রোকেয়া আমাদের। আজকের রোকেয়া-পরবর্তী মেয়েদের তাই লড়ে যেতে হবে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সঠিক শিক্ষায়, যথার্থ ব্যাখ্যায় নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি সমাজের ভালোর জন্য কাজ করে যেতে হবে নিরন্তর। রোকেয়া চর্চার প্রয়োজনীয়তা এখানেই, সার্থকতাও।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা