১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

হেমন্তের রূপ বৈচিত্র্য

-

প্রভাতের শিশির ভেজা খামে বাংলার রূপ বৈচিত্র্যে আগমন ঘটে এই হেমন্ত ঋতুর। হেমন্তে আমাদের প্রকৃতিক রূপ বৈচিত্র্যে পরিবর্তন সাধিত হয়। সবুজ ধানের ক্ষেত ধীরে সোনাবরণ রঙ ধারণ করে। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে হিন্দোল তুলে কৃষাণ কৃষাণীর মনোপ্রাণ। চলে নবান্নকে বরণের নানামুখী আয়োজন। এই দিকে শীতল আবহে প্রাকৃতিক পরিবেশও হয়ে ওঠে এক অসাধারণ উপভোগ্য। হেমন্ত আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আনে নানা মাত্রিকতা। হেমন্তকে নিয়ে কবি সাহিত্যিকরা রচনা করেন কালজয়ী কাব্য গদ্য। যে গদ্য কবিতায় ফুটে ওঠে আমাদের প্রাকৃতিক রূপ সৌন্দর্যের অপার বর্ণনা।
আমাদের প্রকৃতি কখনো কোমল আবার কখনো রুক্ষ, কখনো শান্ত আবার কখনো বৈরী আবহাওয়ায় অশান্ত; আবার কখনো অতি গরম কখনো শীত। আর এই বৈশিষ্ট্য আমাদের প্রকৃতিকে করে তুলেছে এক অনন্যরূপে। আঁধার না থাকলে যেমন আমরা আলোর কদর বুঝতাম না ঠিক চড়াই উৎরাই না থাকলে জীবনের স্বার্থকতাও খুঁজে পেতাম না। তেমনই ঠিক প্রকৃতিটা তেমন রুক্ষ কোমল, শান্ত অশান্তের মাঝে প্রকৃতির স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। ভাদ্র আশ্বিনের কাঠফাটা রোদ, অসহ্যনীয় তাপদাহের পরে কোমল পরশ নিয়ে হাজির হয় হেমন্ত। বাতাসে হিম হিম শীতলতার মখমল আবেশ। মনোপ্রাণ জুড়ানো এক অন্যরকম প্রশান্তময় আবহ। রাতভর পত্র পল্লব ঘাসে জমে ওঠে শিশির। শিশিরভেজা পথঘাট হয়ে ওঠে এক স্বপ্নিল ভূঁই। প্রভাতের মায়াবীয় এই শিশিরের পাখিরা চুমু এঁকে দেয় আলতো করে। ধান ক্ষেতের আলে আলে দূর্বাঘাস হেসে ওঠে এক স্বর্গীয় আবহে।
হেমন্তের মাঝামাঝি আমাদের মাঠজুড়ে বিস্তৃত নয়নাভিরাম ধান ক্ষেতের মাঠগুলো এক বর্ণিল অপরূপ সাজে সেজে ওঠে। ধানের শীষ পরিপক্ব হয়ে নুয়ে পড়ে। শীতল বাতাসে নেচে ওঠে ধানের নরম নরম শীষ। ধানের শীষে বাতাসে দোল খাওয়া আমাদের রূপ বৈচিত্র্যে সংযোজন করেছে আরেক নতুন চিত্র। সবুজ ধান ক্ষেত একসময় ধীরে ধীরে সোনা বরণ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ধান ক্ষেতে দিনমান উড়ে যায় ঘাসফড়িং প্রজাপতিসহ রঙ বেরঙের পোকা মাকড়। আর এই পোকা মাকড় শিকারে ওড়ে বেড়ায় আমাদের দেশীয় পাখ পাখালি। এই দৃশ্য আমাদের গ্রামীণ জীবনের অনন্য এক দৃশ্যপট তৈরি করে চলছে। গ্রামীণ জনপদে এই সময়ের প্রধান ফসল ধান হলেও ধানের সাথে সাথী ফসল হিসেবে চাষ হয় মাসকলাই, খেসারি, মশুর ডাল। শাক সবজি চাষ হয় প্রচুর। যদিও শীতকালীন সময়ে আমাদের দেশে বেশির ভাগ সবজি চাষের মোক্ষম সময় কিন্তু হেমন্তে শুরু হয় তার পূর্ব প্রস্তুতি। কৃষকরা বিভিন্ন সবজির বীজতলা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটান।
বর্ষার পর শরত, তারপর হেমন্ত। হেমন্তের শুরুতে ধান ক্ষেতগুলোতে পানি জমে থাকে। আর এই জমে থাকা পানিতে আমাদের দেশীয় প্রজাতির মাছ জন্মে। গ্রামীণ জনপদে এসব ক্ষেতের এক কোণে ছোট করে কাটা হয় পুকুর সদৃশ গর্ত আর এই গর্ত সেচ দিয়ে সপ্তাহান্তে কৃষকরা দেশীয় মাছ ধরেন। এই চিত্র আমাদের গ্রামীণ জীবনে এক অন্য রকম আবহ তৈরি করে। আবার অনেক সময় ধান ক্ষেতের ভেতরের পানিতে বড় বড় শোল টাকি কই পুঁটি তেলাপিয়া মাছ পাওয়া যায়। রোদের তাপে এক সময় শুকিয়ে যায় ধান ক্ষেত তারপর ইঁদুরের উৎপাত। ধান পাকতে শুরু করলে ইঁদুর ধান কেটে কেটে মাটির গভীরে গর্ত খুঁড়ে সেই ধান জমা করে অন্য সময় সেই ধান খায়। ইঁদুরের হাত থেকে ধান বাঁচাতে কৃষকদের বেশ পাহারাদারি করতে দেখা যায়। যতেœ গড়া ফসল ক্ষেতে হেঁটে হেঁটে নজরদারি করেন তারা।
ধান পাকতে শুরু করলে গ্রামীণ ছেলে মেয়েরা ধান ক্ষেতে লুকোচুরি খেলে। এই দৃশ্য শহুরের একগুঁয়ে জীবনে কল্পনার অতীত। ছেলে মেয়েরা দু দলে ভাগ হয়ে এক দল লুকিয়ে পড়ে আর অন্যদলের কাজ হয় তাদের খুঁজে বের করা।আবার অনেকে বিকেলে ফসলের আলে আলে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ঘুড়ি উড়ায়। এই যেন এক স্বপ্নপুরী। এখানে দৃশ্য হয়ে উঠে ঠিক এক অনন্য।
এক সময় কাক্সিক্ষত ধান পাকে। শুরু হয় ধান কাটার পর্ব। কৃষকদের দিনমান কী যে পেরেশানি। জারি সারি গান গেয়ে গেয়ে ধান কেটে ধান মাড়ার কাজ চলে। গৃহস্থের উঠোন মধ্যরাত অবধি ব্যস্ত। পুরুষেরা ব্যস্ত ধান কাটা মাড়ানোর কাজে আর মহিলারা সেই ধান সিদ্ধ করে উঠোন কিংবা চাতালে শুকিয়ে গোলায় তোলার কাজে ব্যস্ত। এই কষ্ট তাদের খুব একটা ছোঁয় না। আনন্দে আনন্দে চলছে ধান তোলার কাজ। এক দিকে চলে ধান শুকানোর মহোৎসব অন্যদিকে খড় শুকানো খড়ের গাঁদা তৈরির কাজ। এই সময়ের সংগৃহীত এই খড় সারা বছর গবাদি পশুকে খাওয়ানো হয়।
মাসাধিককাল অসহনীয় কষ্টকর সময় পার করার পর আমাদের গ্রামীণ জীবনে আসে উৎসবের আমেজ। এই উৎসব নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। গোলায় ধান তোলার কাজ সম্পন্ন হলে এবার শুরু হয় নতুন চালের তৈরি পিঠাপুলি ও মুখরোচক খাবার তৈরির মহোৎসব। ঘরে ঘরে ফিরনি পায়েশ পিঠাপুলির রঙ বেরঙের আয়োজন। ঘরে ঘরে নতুন ধানের খই ভাজা হয়। আর এই ঐতিহাসিক আয়োজন ঘিরে আমাদের গ্রামীণ জীবন হয়ে উঠে অসাধারণ অনাবিল। হেমন্তের শেষের দিকে শীতের ঘনঘটা শুরু হয়ে যায়। এই সময়ে জমে ওঠে নবান্নের নানা উৎসব। উৎসবে উৎসবে মেতে উঠে আমাদের দেশ। নবান্নের উৎসব হিসেবে গ্রামীণ জনপদে বিভিন্ন গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করতে দেখা যায়। খেলাগুলোর উল্লেখযোগ্য হলো- লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, হাঁড়িভাঙ্গা ইত্যাদি। এই সময় অঞ্চলভেদে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গ্রামীণ হাট কিংবা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসে নবান্ন মেলা। মেলায় খই, মোয়া, পিঠাপুলির পসরা সাজানো হয়। আবহমান কাল থেকে এসব উৎসবে বাড়ির ঝি জামাইদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়।ঝি দের নাইওর আনা হয়।
হেমন্তে নতুন চালের মুহুর্মুহু ঘ্রাণের পাশাপাশি বনজ ফুলের মন মাতানো ঘ্রাণও পাওয়া যায়। এই ঋতুতে ফোটা উল্লেখযোগ্য ফুলগুলো হলো- গন্ধরাজ, শিউলি, মল্লিকা, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ আশোক, ছাতিম, বকফুল। এসব ফুলেল ঘ্রাণে ও সৌন্দর্যে হেমন্তকে করে তোলে এক অনন্য রূপে।
বাংলাদেশ রূপ প্রকৃতির এক অপার ভাণ্ডার। ছয়টি ঋতুর ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আমাদের দেশকে করেছে বিশ্ব দরবারে স্বপ্ন আর কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। আর এই অপার সৌন্দর্যের অংশীদার হেমন্ত। আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিশাল এক অংশ দখল করে আছে এই হেমন্ত ঋতু।


আরো সংবাদ



premium cement
‘আপত্তিকর ভাষা’ ব্যবহারে শাস্তি পেলেন জোসেফ শ্রীমঙ্গলে হত্যা মামলায় প্রেমিক গ্রেফতার জামায়াত নেতা কাজী ফজলুল করিমের মৃত্যুতে ড. রেজাউল করিমের শোক প্রকাশ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে মাঠে থাকব : মুন্না আমতলীতে ব্যবসায়ীকে আত্মহত্যার প্ররোচনায় জড়িতদের বিচার দাবি সিরিয়া নিয়ে আশা ও শঙ্কা ইসরাইলের সিরিয়ায় বাশারের পতনে ইসরাইল কতটুকু লাভবান অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের ৫৭৯ কর্মকর্তা লক্ষ্মীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহত ৫ এ দেশে রাজনীতি করতে হলে জনগণের সেবক হয়েই রাজনীতি করতে হবে : সেলিম উদ্দিন এখন সময় শান্তি ও স্থিতিশীলতার : অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী

সকল