২৪ দোলালো প্রিয় স্বাধীনতা
- নূরুন্নাহার নীরু
- ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বাবা কিছু বলার আগেই ফারহান বলে ফেলল, বাবা আমি অনুমতি নিতে আসিনি। বিদায় নিতে এসেছি। দোয়া করে দাও। একটু থেমে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আবার সে বলল, বাবা এ লড়াইতে অংশগ্রহণ আমার নৈতিক দায়িত্ব। কারণ আমিও ছাত্র। ছাত্রদের এ আন্দোলন ন্যায্য দাবির আন্দোলন। এ অবস্থায় স্বার্থপরের মতো নিরাপদ আশ্রয়ে নীরবে বসে থাকা কি পুরুষোচিত হবে? বলেই মাথাটা নুয়ে দিলো বাবার দিকে।
বাবার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বুঝলেন, মাত্র ইন্টারে পড়া ছেলে আমার বড় হয়ে গেছে। মুখে কিছুই বলতে পারলেন না অসুস্থ বাবা। হাত বুলিয়ে বিড় বিড় করে দোয়া করে দিলেন একটি প্রশান্তির হাসি হেসে। মায়ের ছলছল চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করার শক্তি নেই ফারহানের। জীবনের সর্বক্ষণের বিশ্বস্ত বন্ধু মা! কিন্তু এ মুহূর্তে মায়ের কাতর করুণ মুখাবয়ব দেখে বের হওয়া কঠিন হয়ে যাবে তাই মুখ ঘুরিয়েই চলে যেতে যেতে শুধু বলল, দোয়া করো মা! শুধু তো তোমার ছেলেই নয়, আরো কত মায়ের ছেলে আছে ওখানে! সবার একটাই দাবি। এ দাবি আমাদের অস্তিত্বের দাবি। আমরা কি স্বাধীন দেশের স্বাধীন জাতি নই? এক অদ্ভুত ধরা গলায় কথাগুলো বলেই নিজেই দরজা খুলে নেমে গেল ফারহান।
মা জানেন আজ কদিন ধরেই চলছে ওদের আন্দোলন। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো আশ্বাস বা সমঝোতার কথা না বলে; বরং কিছু উসকানিমূলক কথা বলে যাচ্ছে যা ছাত্রদের আত্মসম্মানে বিঁধবার মতো। আজ ওরা আরো বেশি বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। এটিই স্বাভাবিক। রীতিমতো জাত তুলে কথা! রাজাকারের বাচ্চা! এও কি হতে পারে? ছাত্ররা কতটা কষ্টে স্লোগানে স্লোগানে গগণ বিদারণ করছে, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার! কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’
আজ জানি কী ঘটে! মনের ভেতর কেমন একটা কু-টান অনুভব করছেন মিসেস শিরিন। শেষবারের মতো ছেলেকে দেখে নিতে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ছেলে ততক্ষণে মিশে গেছে সামনের বড় রাস্তার ভিড়ে। স্লোগান ছাড়া আর যেন কোনো শব্দ নেই আজ। বাতাসও দম বন্ধ করে পৃথিবীর ভার বহন করছে এক অনাগত সময়ের ডাকে। যতদূর চোখ যায় রাস্তার সীমানায় আটকে যায় মিসেস শিরিনের ব্যাকুল দৃষ্টি! হ্যাঁ শুধু আমার সন্তানই নয়, ঐ তো আরো কত মায়ের সন্তান। এ দাবি ওদের অধিকারের দাবি- এ প্রতিবাদ ওদের আত্মসম্মানের প্রতিবাদ! তোমরা বিজয়ী হও বাবা! আপন মনে বলে উঠলেন মিসেস শিরিন।
আজ জুলাই পেরিয়ে আগস্ট। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে চলছে ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন। কোটা আন্দোলন থেকে শুরু হলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। ওরা এখন রাজপথে। দাবি একটাই- বৈষম্যের বিরোধ চায় ওরা। ২০১৮ সালে একবার নেমেছিল রাজপথজুড়ে এই ছাত্ররাই। কী নৈপুণ্যতার সাথেই না ওরা রাজপথের গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ফারহান তখন একেবারে শিশু। পঞ্চম শ্রেণীতে পাঠরত সে শিশুটিও বলছিল- আমিও তো ছাত্র। আমিও যাব ওই আন্দোলনে।
বাবা তখন সুস্থ ছিলেন। তবু ছেলেটির বয়স চিন্তা করে নিজেই রাস্তায় নেমে সহযোগিতা করে সন্তানকে আশ্বস্ত করেছিলেন। এরপর হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। কিন্তু সেখানেও বয়সের অপরিপক্বতার দোহাই তুলে আটকানো গিয়েছিল ফারহানকে। কিন্তু এবার! এবার আর কোনো বাধা নয়, নয় কোনো আশ্বস্ততা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হোক প্রকৃত নাগরিকের পরিচয়। মা-বাবা দুজনেই তাই নীরব সমর্থনে এগিয়ে দিয়েছেন একমাত্র সন্তানকে।
মনে পড়ে যায় একাত্তরের স্মৃতি। একেবারেই ছোট মিসেস শিরিন। তবু মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ার চলে যাওয়ার দিনটি স্পষ্ট মনে আছে তার। এভাবেই মা-ও বিদায় দিয়েছিলেন ভাইয়াকে উথালপাতাল হৃদয়াবেগকে সংযত রেখে। যুদ্ধে ভাইয়া নিখোঁজ হন। পরিবারটি হয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। কিন্তু নীতিবান বাবা কখনো এর সনদ উঠায়ে সুবিধা নিতে রাজি ছিলেন না। ফলে সে সনদ করতলগত হয় অন্য কোনো সুবিধালোভীর। তবুও ফারহান মুক্তিযোদ্ধা মামার ভাগ্নে!
মুক্তিযোদ্ধা! শব্দটা মাথায় বাজতেই মিসেস শিরিন হারিয়ে গেলেন দূর অতীতের দিগন্তে। ঘরে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। আপা, ভাইয়া, মামা। তিনজনের তিন অবস্থান থেকে সে কি ত্রস্ততা! দিনভর মিছিল আর সোচ্চার স্লোগানে ওদের কর্মতৎপরতা বাবার বাসাটিকেও বানিয়ে ফেলেছিল একটি দুর্গের মতো। উত্তাল মার্চের সে দিনগুলোতে আজকের মিসেস শিরিন দেখেছিলেন বাবা নিরপেক্ষ সরকারি কর্মকর্তা হলেও ভাইবোন, মামার সুবাদে সব বড় বড় নেতারাও এসে শলাপরামর্শ, নীতি নির্ধারণ করছেন ওখানে ওই বাসাতে বসেই। আর মা ছিলেন আপ্যায়নে অনাবিল উদারহস্ত। মা যেন প্রস্তুতই থাকতেন ওদের সময়-অসময়ের রান্না খাওয়া নিয়ে।
বুবু যা আছে তাই দাও। আমাদের সময় কম। এই বলে অ্যাডভোকেট মামা হাজির হতেন এক দল নেতাকর্মী নিয়ে। ভাইজান চলে আসতেন ছাত্রদের নিয়ে। মা হাসিমুখেই বলতেন, ‘সমস্যা নেই। তোরা খেয়ে যা। আমাদের জন্য আবার বসিয়ে দিচ্ছি।’
তৎকালীন কলেজের জিএস মেঝ আপারও ছিল একদল কর্মী। পরবর্তীতে তাদের মধ্য থেকেই একজনকে আগরতলায় পাঠিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে আনেন আপারা! আপাদের মিছিলের কথা খুব মনে পড়ে। বোরকা পরা ছাত্রী! অথচ হাত উঁচিয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সে কী স্লোগান! আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে পোশাক কোনো বাধাই নয় তাই যেন শিখিয়েছিলেন আপারা!
যে অন্যায়, অনাচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানিদের সাথে সেই একই চিত্র দেখতে হচ্ছে আজ নিজ ভূমে নিজ দেশীর সাথে! এও কি মানা যায়? ১৮সালের আন্দোলন মর্মান্তিকভাবে দাবিয়ে দিয়ে সরকার তার স্বৈরাচারী রূপটাই উন্মোচন করে দিয়েছিল। তাই তো শিশু ফারহান এখন সমুত্ত হয়ে বুঝতে পারছে এ শুধু প্রতিবাদ নয় অধিকারের লড়াই। ’২৪-ওর ছোট্ট হৃদয়কে দুলিয়ে দিয়েছে প্রিয় স্বাধীনতায়। খালামনির কাছে কতবার শুনেছে একাত্তরের বীরত্বগাঁথা। কিন্তু আফসোস! সেই একাত্তরের স্বাধীনতার কথকেরাই জনগণের উপর দানব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ নেই কোনো ভিন্ন পথ, নেই ভিন্ন মতের স্বাধীনতা! সব যেন ভিনগ্রহ থেকে আগত!
খালামনির এমনি বক্তব্যে উজ্জীবিত হয়ে উঠত ফারহান।
১৭ বছরের তরুণ কিশোর ফারহান যেনো জন্ম থেকেই দেখছে স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু। বাবাকে পঙ্গু বানিয়েছে দিনের পর দিন মিথ্যা মামলা সাজিয়ে হাজতে রেখে। একটু ভিন্ন মতের হওয়াতে একমাত্র ছোট চাচা ও বিসিএস ক্যাডার হতে পারেনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও। আবার এখন বলছে চাকরির কোটায় ৫৭ শতাংশই থাকবে মুক্তিযোদ্ধার বংশধররা। অথচ কজন আছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা? সব তো টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কেনা! এভাবে চলতে দিলে মেধার মূল্য হারাবে, দেশ উজাড় হবে মেধাবীদের বলিতে।
হঠাৎ টিয়ার শেলের শব্দে উৎকীর্ণ হয়ে ওঠেন মিসেস শিরিন। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ দিগি¦দিক। পুলিশ দৌঁড়াচ্ছে হায়েনার রূপে। কী চায় ওরা? কী করবে? অস্ত্র হাতে এরা কারা উর্দুওয়ালি না কি বাঙালি? একাত্তরে উদির্ পরা ওরাই না তো? চোখে ধাঁ ধাঁ লেগে যায় মিসেস শিরিনের। নাহ এরা তো আমার দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী! কী ব্যাপার! আর্মির গাড়ি কেন? স্বগোক্তি করে করেই মিসেস শিরিন সামনের অবস্থা বুঝতে আরো ঝুঁঁকে পড়েন বারান্দায়। কিন্তু নাহ; ধোঁয়া আর চিৎকার ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এ সময় ঘরে থাকা নয়।
বোরকাটা চাপিয়ে দ্রুত নেমে পড়েন শিরিন। অন্তত পানি এগিয়ে দিয়েও যদি সহযোগিতা করা যায়। রাস্তার দিকে এক রকম দৌড়ে যেতে থাকেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ থমকে দাড়ান। একটি রিকশা এদিকেই আসছে। কাকে যেন কোলে নিয়ে ধরাধরি করে কজন আসছে ওই রিকশায়। রক্তাক্ত চেহারাটা বোঝা যাচ্ছে না। রিকশাটি শিরিনের সামনে এসে থেমে যায়। বুকের ভেতরটি মোচড় দিয়ে উঠল তার। চেয়ে দেখে এ যে তারই বুকের ধন, তারই কলিজার টুকরা ফারহান। সারা শরীর রক্তাক্ত। নিথর পড়ে আছে দেহটি!
তার চোখের সামনে যেনো একাত্তরের সেই দৃশ্য, ‘খালাম্মা! বোরহান শহীদ হয়ে গেছে। আমরা পারলাম না ওকে বাঁচাতে। পাক সেনারা ওকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। বলেই রাতের আঁধারেই চলে গিয়েছিল ছেলেগুলো উঠোনে ভাইয়ার নিথর দেহটি রেখে। মা বাকরুদ্ধ হয়ে ধপাস পড়েছিল।
আজ ৫৩ বছর পর আবার সে দৃশ্য! সেই সংলাপ! মাথা ঘুরে চোখ অন্ধকার শিরিনের! গোটা পৃথিবীটাই যেন কেঁপে উঠল। এর মধ্যেই কানে কানে কেউ যেন বলে উঠল মা! মাগো! ’২৪ দোলালো প্রিয় স্বাধীনতা!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা