চিরচেনা অথচ নতুন জগৎ
- নাসিম আহমাদ
- ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
নানা মত-পথ আর অনেক কল্পনা জল্পনার অবসান ঘটিয়ে সিলেট সফর আজ সোনালি অতীত। শিশুর স্বপ্নের মতোই লোভনীয় ছিল আমার কাছে এই সিলেট সফর। ১৪ নভেম্বর চতুর্দশী এক জ্যোৎস্না-ঝলমল রাত্রিতে ষোলোজনের এক বহর নিয়ে কমলাপুর জংশন থেকে রাত ১০টায় সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি।
এমনিতেই ট্রেন ভ্রমণ আমার কাছে এক ভীষণ আনন্দপ্রদ। এর উপর আবার আনন্দ ভ্রমণ, নতুন পথ, নতুন গন্তব্য,এক অদ্ভুত অনুভূতিতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম বারবার!
পদ্মা মেঘনা যমুনা, শুধু শুনেছিলাম কবিতার ছন্দে। দর্শন লাভ হয়নি কারো সাথে। এই প্রথম জ্যোৎস্নালোকের এক অপূর্ব প্রতিবিম্বে আলোকিত মেঘনার দর্শন করে আমাকে বিমোহিত করে।
রাত ২ টায় আমার চোখ থেকে ঘুম কেড়ে নেয় শ্রীমঙ্গলের নৈস্বর্গিক রূপ-মাধুরি। তার বনজ সুগন্ধি। কখনো জানালা দিয়ে কখনো বা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছিলাম মুগ্ধ নয়নে তার ক্লান্তিময় মাধুরী। পূর্ণিমার আছড়ে পড়া রূপোলি আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুরো বনভূমি। পথের দুই ধারে অবিচল পদে দাঁড়িয়ে আছে সারিসারি পর্বত। ঝাঁকড়া চুলের মতো পাহাড়ের আপাদমস্তক জড়িয়ে আছে এক জগদ্দল সবুজের সমারোহ।
শ্রীমঙ্গল শেষ হলেই আসে লাউয়াছড়া বন। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ আরেক প্রাকৃতিক লীলাভুমি। ঘন ঝোপঝাড়ের বাঁধন ছিঁড়ে, অরণ্যের গহীন গ্রীবাদেশ দিয়ে, তৃতীয় প্রহরের ঘনায়মান নীরবতায়- কিশোরীর নূপুর-নিক্কণের মতো মধুর ট্রেক্স সাউন্ড তুলে ছুটে চলছে আমাদের উপবন এক্সপ্রেস। কোনেরকম বিলম্ব না করে,অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স দেখিয়ে ভোর ৬টার আগেই পৌঁছে দেয় আমাদেরকে সিলেট মহানগরীতে।
প্রাচীন পুরাকীর্তি, তেল, গ্যাস, চা, তেজপাতা, চুনাপাথর আর অঢেল খনিজ সম্পদে ভরপুর এই তিনশত ষাট আউলিয়ার দেশ। বলা হয় পান আর পানি ঐতিহ্যের ধারক এই স্বর্ণ নগরী।
এখানকার আকাশ বাতাস, মাটি মানুষ সব কিছুই আমার বালক হৃদয়ে দারুণ এক অনুভূতির সঞ্চার করে।
সেই কাকডাকা ভোরেই স্টেশনের অদূরে বাস টার্মিনাল থেকে সারা দিনের জন্য একটা লেগুনা ভাড়া করা হয়। যাত্রা শুরুর আগেই সকালের নাস্তা সেরে নেই বিখ্যাত পানসি হোটেলে। এরপর শুরু হয় আমাদের জাফলং যাত্রা। সেই জৈন্তা রানীর দেশে। সূর্য এখনো পূর্ণ প্রতাপে সর্বত্র তার আধিপত্য বিস্তার করেনি। সুদূর মেঘালয়ের আড়াল থেকে মাত্রই মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে,সদ্য উদিত তার ঠোঁট থেকে বিকীর্ণ হচ্ছে মোলায়েম কণকপ্রভা। দূর থেকে দেখা যায় ঘন সবুজ আস্তীর্ণ মেঘালয় রাজ্য। প্রথমে মেঘ বলে দৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল কালো মেঘ যেনো হেলান দিয়ে আছে সেই শৃঙ্গে। কিন্তু শ্রীপুর চা বাগানে অল্প কিছুক্ষণের জন্য যখন যাত্রা বিরতি হয়,তখন সেই দৃষ্টিভ্রম স্পষ্ট হয়- গগনচুম্বী এই নয়নাভিরাম পর্বতমালা ক্ষুদ্র বাংলাকে বঞ্চিত করে হিন্দেরই শ্রী বৃদ্ধি করেছে। দূর থেকে কেবল দেখে নেয়ার মতো। কাছে এসে ছুঁয়ে অনুভব করার মতো নয়। সে এক সুন্দরতম লোভনীয় অথচ নিষিদ্ধ নগরী।
অল্প কিছুক্ষণ পর আবার আমরা রওনা দিলাম জাফলং-এর উদ্দেশ্যে। মাঝপথে অল্প সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি করলাম তামাবিল স্থলবন্দরে। আরেকটু সামনে এসে এক পলকের জন্য দেখে নিলাম শাপলার রাজ্য ডিবির হাওর। ঘন সবুজের মাঝখানে যেনো একটি রক্তিম লীলাকানন। সকালের সোনালি রোদের সাথে তাল মিলিয়ে অভাবনীয় এক দৃশ্যের অবতারণা করে- রক্তাভ পেখম তুলে চলে গেছে দৃষ্টিসীমার ওপারে। মিলিত হয়েছে সেই সুদূর লালিমায়।
সময়ের চেয়ে কাজের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ হওয়ার কারণে এখান থেকেও এক বুক অতৃপ্তি নিয়ে বিদায় নিতে হলো আমাদের। বেলা ১০টা নাগাদ এসে নামলাম প্রকৃতি কন্যা খ্যাত রূপকথার রাজ্য জাফলং। খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশ ঘিরে উপল মুখরিত এক নান্দনিক ভূস্বর্গ। এক দিকে ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ,অন্য দিকে ঘন বৃক্ষ বেষ্টিত খাসিয়া পল্লী।আর বিপরীত পাশে ঘন সবুজে ঢাকা মেঘালয়ের অভ্রভেদী পর্বতমালা, আকাশের বুকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি ফেরাতে মন চায় না। দেখতে দেখতে মন উদাস হয়ে যায়। আর তারই পদতল ছুয়ে,স্ফটিকস্বচ্ছ পানির এক খরধার শীতল প্রবাহ নিয়ে দুরন্ত কিশোরীর ন্যায় চলে গেছে মেঘালয় কন্যা পেয়াইন নদী।
জিরো পয়েন্ট থেকে সরাসরি আমরা চলে আসলাম খাসিয়া পল্লী। চিরচেনা বিশ্ব জগতের বাইরে এই খাসিয়া পল্লী আমাকে নতুন এক জগতের সন্ধান দেয়। তাদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, পোশাক-পরিধেয়, মাচার ওপর বাসা বেঁধে জীবন যাপন করা- সর্বোপরি এই নির্জন পানের বরজ আর ঘন ছায়াবীথিকার মাঝে নিমগ্ন তাদের জীবনাচার আমাকে দারুণভাবে বিস্মিত করে। খাসিয়া পল্লীর এক পাশেই অবস্থিত সংগ্রামপুঞ্জি চা বাগান। প্রথমেই চোখে পড়ে খাসিয়াদের চায়ের দোকান। নানা রকম চায়ের পসরা সাজিয়ে সেখানে এক জমজমাট বাজার বসিয়েছে। তাদের অকৃত্রিম অতিথিপরায়ণ মানসিকতার কল্যাণে প্রায় সব রকমের চায়ের স্বাদ সেখানে আস্বাদনের সুযোগ হয়। এখানের চা বাগান এতটা বিশাল, দৃষ্টির শেষ সীমা অবধি শুধু ঢেউ খেলা সবুজের সমারোহ, হেঁটে দেখে তার কিণার করার বৃথা চেষ্টা না করে গুটিকয়েক ছবি তুলে সেখান থেকে বিদায় নিলাম।
ফিরে আসি রূপকথার আরেক রাজ্য, মায়াবী-ঝর্ণায়। থরে থরে পাথর সাজিয়ে সেই ঊর্ধ্বাকাশ ঘিরে প্রকৃতি এখানে গড়ে তুলেছে আরেক স্বর্গরাজ্য।
হেমন্তের অনাবৃষ্টিতে পানি তার আপন গতি হারালেও সুপেয় পানিতে কৃপণতা করেনি জলদাত্রী এই শিলাপর্বত। জীবনের প্রথম এমন নৈস্বর্গিক নির্ঝর দেখা মাত্রই আনন্দে লাফিয়ে উঠি আমরা। বঙ্গসীমা অতিক্রম করে পাথরের গা বেয়ে, লতাগুল্ম ধরে ধরে উঠে যাই সুউচ্চ শিখরে। প্রস্তরময় পাহাড়,শীতল পানির প্রস্রবণ,আর ঘন শ্যামলীমার মিতালীতে নিজেকে আবিষ্কার করি বর্ণিল এক মায়াপুরিতে। সে উচ্ছ্বসিত আবেগঘন মুহূর্ত অক্ষরবন্দি করার মতো নয়। এই সৌন্দর্যের বিভা কাব্যের সূক্ষ্ম কল্পনা,কথার জাদু কিংবা ভাষার উপমা থেকেও আরো অনেক সুতীব্র।
মায়াবী ঝর্ণার সামনেই সাদামাটা এক হোটেলে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। পাহাড়ি মুরগির সাথে হরেক রকমের ভর্তা আর ডালের অপূর্ব স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
জাফলং-এর আকাশে এতক্ষণে দুপুরের গনগনে সূর্য পূর্ণ প্রতাপে আরোহণ করেছে। ঝাঁ ঝাঁ করছিল বিস্তীর্ণ প্রস্তর ভূমি। মেঘালয় কন্যা পেয়াইন বারবার ডাকছিল হাতছানি দিয়ে। আনচান করছিল মনটা গোসলের জন্য। কোনোরকম খাবারটা সেরেই মেতে উঠলাম জলকেলিতে। স্বচ্ছ শীতল পানিতে এক মুহূর্তেই সকল ক্লান্তি মøান হয়ে যায়। অবসিত দেহমন প্রাণ ফিরে পায়। দীর্ঘক্ষণ এখানে আমরা ঝাঁপাঝাঁপি করলাম। চঞ্চল শিশুর মতো একেবারে চোখমুখ লাল করে পরে উঠলাম।
বেলা ৩টার দিকে আবার পূর্ণ প্রাণশক্তিতে বলীয়ান হয়ে সতেজ মনে জাফলং থেকে রওনা দিলাম ফিরতি পথে। এখন আমাদের গন্তব্য লালাখাল। অপরাহ্ণের আরেক প্রাকৃতিক নৈস্বর্গ এই লালাখাল। দুই ধারের লাল মাটি আর শেষ বিকালের রক্তিম সূর্যের কণকপ্রভা লালাখালের স্বচ্ছ নীলজলে এক নান্দনিক দৃশ্যের অবতারণা করে। মাঝির সাথে আমাদের এক স্মরণীয় দাম কষাকষি হয় এখানে, এবং এর রেশ ধরে জলবিহারের পুরো সময় ধরে মাঝির সাথে চলতে থাকে আমাদের এক অমীমাংসিত স্নায়ু যুদ্ধ। নৌকায় নাড়া দিয়ে ওঠা, লাফিয়ে ছাদে ওঠে যাওয়া, হঠাৎ চিল্লিয়ে ওঠা, সে এক অদ্ভুত আনন্দঘন মূহূর্ত! লালাখালের স্বচ্ছ নীল জলের ওপরে, এমন রক্তিম বিকেলে, সে দিনকার নির্মল আনন্দ- যৌবনের উদ্দাম চাঞ্চল্য নিয়ে হয়তো বা আর কোনো দিনই ফিরে আসবে না। সন্ধ্যার পর পরই আমরা লালাখাল থেকে বিদায় নেই।
সবশেষে মূল শহরে শাহপরান-শাহজালাল মাজার দেখার আগে সিলেট নগরীর আরেক বিস্ময় হরিপুর আগুন পাহাড়, সেখানে গেলাম। পাহাড়ের ফাঁক ফোকরে দেয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেই হয়, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে অগ্নিশিখা। প্রকৃতির এক অপার বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছপালাহীন এই অগ্নিপর্বত। স্থানীয়দের কাছে এটি জ্বলা টিলা নামেও পরিচিত। রাত ৯টার দিকে সারা দিনের এক আবেগঘন বর্ণিল স্মৃতি জীবনের সাথে সংযোগ করে জৈন্তা রানীর দেশ থেকে বিদায় নিলাম।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা