০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

বাংলার ঐতিহ্য নবান্ন উৎসব

বাংলার ঐতিহ্য নবান্ন উৎসব -

ষড় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। একেক ঋতু একেক রকম বৈশিষ্ট্য, রূপ, রঙ নিয়ে আবির্ভাব হয় আমাদের সামনে। কার্তিক অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হেমন্তকাল বাংলাদেশে। কার্তিকেই ধানের গাছে দুধ ছড়া আসে। তারপর পূর্ণাঙ্গ ছড়ায় পরিণত হয়। কৃষকরা তাদের সন্তানের মতো পরিচর্যা করে এই ধান গাছের। এক সময় পরিপক্ব ধান গাছে রূপ লাভ করে। ধানের ছড়ায় হলুদ রঙ আসতে শুরু করে। কৃষক কিছুটা প্রশান্তিতে থাকে ফসল নিয়ে। সবুজ ধানের গাছে সোনালি রঙের পাকা ধানের ছড়া এ এক অন্যরকম ভালোলাগা। একসময় ধান পেকে কাটার উপযুক্ত হয়। কৃষকের মনে থাকে আনন্দের হাসি। পরিপূর্ণ ধান পাকলে কৃষকরা দলবেঁধে ধান কাটতে মাঠে যায়। শীতের আমেজ কিছুটা তখন লাগতে শুরু করে। হালকা হালকা কুয়াশা দেখা যায় প্রকৃতিতে। ভোরবেলা কৃষকরা উঠে পড়ে। চাষি বউ কিছু খেতে দেয় তাকে। তারপর কিছু শুকনো খাবার গামছায় বেঁধে দিয়ে দেয়। কৃষক মাঠে চলে যায় কাস্তে হাতে। স্বপ্নের ধান কাটা শুরু হয়। বেলা বাড়তে থাকে হেমন্তের মিষ্টি রোদ ছুঁয়ে যায় কৃষককে। কখনওবা চাষিবউ নিজেই তার জন্য জমিতে খাবার নিয়ে যায়। বাড়ি এসে খাওয়ার সময় নেই। অনেক কাজ সামাল দিতে হবে। ক্ষেতের আইলে গামছা পেতে খাওয়ার জন্য বসে পড়ে। পরম মমতায় চাষিবউ তাকে খাইয়ে ফিরে আসে বাড়ি। খাওয়া শেষ করে কিছুটা তামাক সাজিয়ে নিয়ে আয়েশ করে টেনে নেয় হুক্কা। তারপর আবার কাজে মন দেয়। সারা দিন চলে ধান কাটা। তারপর আঁটি বাঁধা, এই আঁটি বাড়িতে নিয়ে আসা, ধান মাড়াই করা অনেক কাজ। অপর দিকে বসে নেই চাষিবউ। তারও অনেক কাজ ধান মাড়াই করার জন্য উঠোন লেপা, টুকরি মেরামত ধান সেদ্ধ করার চুলা তৈরি কত কি! ধান কেটে বাড়ি নিয়ে আসলে তা মাড়াইয়ের কাজে লেগে যায় পরিবারের সবাই। কেউবা ধান সেদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত কেউবা তা রোদে শুকানোর কাজে ব্যস্ত। খাওয়ার সময়টি পর্যন্ত অনেক সময় পাওয়া যায় না কারণ দিন ছোট হওয়ায় রোদ চলে যাবে। ধান শুকানোর জন্য সমতল জায়গায় কোদাল দিয়ে সমান করে লেপে অস্থায়ী খলা তৈরি করা হতো। সেখানে রোদ উঠার আগেই ধান পা দিয়ে মেলে দেয়। রোদ এসে সেই ধানের উপর পড়ে। চাষিবউরা যতœ সহকারে সেই ধান সারা দিন উল্টিয়ে পাল্টিয়ে নেড়ে দেয়। এভাবে কয়েকদিন রোদে দেয়ার পর ধান শুকিয়ে গেলে ঘরে তোলা হয়। কিছু ধান কৃষকরা সেদ্ধ ছাড়া অল্প রোদ দিয়ে বিক্রি করে। আগে সেদ্ধ ধান ঢেঁকিতে ভানা হতো। এখনকার সময়ে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন ধান ভাঙার মেশিন এলেও সেকালে ঢেঁকি, চেহাইট ব্যতীত কোন বিকল্প ছিল না। দু’জন মিলে ঢেঁকিতে পাড় দিতো একজন ধান হেলিয়ে দিতো। এভাবে তালে তাল মিলিয়ে দিনভর, রাতভর চলতো ধান ভানার কাজ। অল্প শীতেও শরীরে দরদর করে ঘাম ঝরতো। তবুও মনের সুখে ধান ভানতো চাষিবউরা। ধান ভানা হলে তা কুলা দিয়ে ঝেড়ে চালুনি দিয়ে চেলে চাল তৈরি করা হতো। তারপর কিছুটা অবসর পেতো কৃষাণ- কৃষাণীরা। এবার ঘরে ঘরে মেতে উঠতো নবান্ন উৎসবে। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি হতো পিঠা পায়েস। এই পিঠা পাড়া প্রতিবেশীর সবার ঘরেই বিলানো হতো। আবার মধ্য রাত পর্যন্ত কয়েক ঘরের মহিলারা এক সাথে বসে পিঠা তৈরি করতো। পিঠা তৈরির সময় কত আনন্দ বেদনার গল্প হতো তা বলে শেষ করা যাবে না। এ সময় মেয়েরা তাদের বাবার বাড়ি বেড়াতে আসতো, জামাইসহ কয়েকদিন বেড়াতো তারা। এছাড়াও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নতুন চালের পিঠা নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার একটা প্রচলন ছিল। গাঁয়ে নানান উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। পল্লীগ্রামের নানাবিধ সংস্কৃতি নিয়ে এসব অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতো। তার মধ্যে বাউল গান, লোক কিচ্ছা, কবি গান, ষাঁড়ের লড়াই, জারি গান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব নানাবিধ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি নিয়ে সমাপ্তি হতো নবান্ন উৎসবের। বর্তমান সময়ে সেসব অনুষ্ঠান আর রীতি নেই বললেই চলে। অনেক কমে গেছে নবান্ন উৎসবের আমেজ। তবে কিছু কিছু জায়গায় হয় এখনও। প্রবহমান সময়ের সাথে সাথে আজ চাপা পড়তে যাচ্ছে আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য নবান্ন উৎসব। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য নবান্ন উৎসবকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। পরিচয় করিয়ে দিতে হবে আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের সাথে।


আরো সংবাদ



premium cement